Logo
×

Follow Us

গল্প

স্মরণ

দস্যু বনহুর ও রোমেনা আফাজ

Icon

মামুন রশীদ

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:৩৪

দস্যু বনহুর ও রোমেনা আফাজ

রোমেনা আফাজ ও তার রচিত দস্যু বনহুরের প্রচ্ছদ। ছবি: দেশকাল পত্রিকা

‘দস্যু বনহুরের ভয়ে দেশবাসী প্রকম্পমান। পথে-ঘাটে-মাঠে শুধু ওই এক কথাদস্যু বনহুর, দস্যু বনহুর। কখন যে কোথায় কার ওপর হানা দিয়ে বসবে কে জানে। ধনীরা তো সবসময় শঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের ভয়ই বেশি। দস্যু বনহুরের জন্য কারও মনে শান্তি নেই। দস্যু বনহুর যে কে, কেমন তার আসল রূপ, তা কেউ জানে না। কোথা থেকে আসে সে, কোথায় চলে যায়, তাও কেউ বুঝতে পারে না। গভীর রাতে জমকালো একটা অশ্বপৃষ্ঠে দেখা যায় তাকে। গোটা শরীরে তার কালো পোশাক। মাথায় কালো কাপড়ের পাগড়ি। মুখে একটা কালো রুমাল জড়ানো। কোমরের বেল্টে গুলিভরা রিভলভার। বিশেষত অন্ধকার রাতেই বনহুর হানা দেয়। শহরে-বন্দরে, গ্রামে, পথে-ঘাটে-মাঠে সব জায়গায় হয় তার আবির্ভাব।’ 

এভাবেই দস্যু বনহুরের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেন রোমেনা আফাজ। দস্যু বনহুর, শুধু মনিরা বা নূরীর হৃদয় হরণকারীই নয়, হাজার হাজার পাঠকের হৃদয়ে তার অবস্থান। একজন দস্যুও মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই নিতে পারে, মানুষ তার জন্য আকুল হতে পারে, মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হতে পারে, তার উদাহরণ তৈরি করেন রোমেনা আফাজ। পাঠকের আগ্রহের, হৃদয় হরণকারী বনহুর কেমন ছিলেন? সিরিজের প্রথম বই দস্যু বনহুরের প্রথম পাতাতেই সে বর্ণনা, ‘বনহুরের নামে মানুষ যতই আতঙ্কিত হোক না কেন, আদতে বনহুর ছিল অত্যন্ত সুন্দর সুপুরুষ। মনও ছিল তার উদার-মহৎ। দস্যুবৃত্তি বনহুরের পেশা নয়- নেশা। খেয়ালের বশে সে দস্যুতা করত। দস্যুতায় বনহুর আনন্দ পেত। হয়তো এক ধনীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে বিলিয়ে দিত সে দীন-হীন গরিবদের মধ্যে। নয় ফেলে দিত সাগরের জলে। অদ্ভুত ছিল বনহুরের চালচলন। বনহুরের প্রাণ ছিল যেমন কোমল, তেমনি কঠিন। বনহুরের সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার অশ্ব তাজ। যেখানে যেত বনহুর, তাজ হতো তার সঙ্গী, নিজ হাতে সে তাজকে ছোলা খাওয়াত, গা ঘষে দিত, এমনকি তাজ যখন ঘাস খেত, বনহুর পাশে বসে খেত রুটি আর মাংস। মাঠে যখন চরত, বনহুর বসে থাকত তার পাশে। হয়তো শিস দিয়ে ঘাস খাওয়াত। তাজও তেমনি ভালোবাসত বনহুরকে। বনহুরের ইঙ্গিত তাজ বুঝত। তাজ ছিল অত্যন্ত চালাক ও বুদ্ধিমান অশ্ব। তার গতিও ছিল উল্কার মতো দ্রুত। অন্ধকারেও তাজ কোনোদিন পথ হারাত না।

দস্যুতা করতে গিয়ে অনেক সময় বনহুর তাজকে বাইরে রেখে প্রবেশ করত অন্দর বাড়িতে। হয়তো ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বনহুরকে অন্য পথে প্রাচীর টপকে পালাতে হতো। বনহুর শুধু একটি শিস দিত, সঙ্গে সঙ্গে তাজ গিয়ে হাজির হতো তার পাশে। বনহুর প্রাচীরের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ত তাজের পিঠে। তারপর আর কে পায় তাকে! তাজের লাগাম ছিল না! বনহুর তাজের কাঁধের কেশ ধরে উবু হয়ে থাকে, তাজ ছুটত হাওয়ার বেগে। তাজের পিঠে ছুটে চলেছে বনহুর।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রোমেনা আফাজ

প্রান্তরের বুক চিরে গহিন বনে প্রবেশ করল বনহুরের অশ্ব। এবার তার গতি কিছুটা মন্থর হয়ে এলো। গহিন বনের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথ ধরে ছুটতে লাগল তাজ। ভোরের আলো তখন গহিন বনকে অনেকটা হালকা করে এনেছে।’ 

প্রথম বই দস্যু বনহুর। দ্বিতীয় বই দস্যু বনহুরের নতুন রূপ। তারপরের বইগুলোর মাঝে রয়েছে- সৈনিক বেশে দস্যু বনহুর, নাথুরামের কবলে মনিরা, দুর্ধর্ষ দস্যু বনহুর, ছায়ামূর্তি, মনিরা ও দস্যু বনহুর, সাগরতলে দস্যু বনহুর, সর্বহারা মনিরা, ঝিল শহরে দস্যু বনহুর, ঝিন্দের রানী, দস্যু দুহিতা, বন্দিনী, মায়াচক্র, চিত্রনায়ক দস্যু বনহুর, কান্দাইয়ের পথে দস্যু বনহুর ইত্যাদি। 

দুই
দস্যু বনহুর চরিত্রটির স্রষ্টা রোমেনা আফাজ। তার লেখালেখির শুরু মাত্র ৯ বছর বয়সে। ‘বাংলার চাষি/মুখে নাই হাসি/পেটে নাই ভাত/খাটে দিনরাত।’ মায়ের অনুপ্রেরণায় লেখা প্রথম ছড়া। মা আছিয়া খাতুনও ছিলেন সাহিত্য অনুরাগিণী। মায়ের সাহিত্যানুরাগ মেয়েকেও স্পর্শ করে। ‘বাংলার চাষি’ শিরোনামের ছড়াটি লেখার পর রোমেনা আফাজ তা পাঠিয়ে দেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার দপ্তরে। তখন রোমেনা আফাজের পরিবার থাকত কলকাতাতেই। বাবা কাজেম উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক। তার তখনকার কর্মস্থল ছিল কলকাতায়। ৯ বছরের কিশোরীকে অবাক করে যথাসময়ে ছড়াটি ছাপার অক্ষরে স্থান পায় মোহাম্মদীর পাতায়। লেখার জগতে ছাপার হরফে নাম দেখার মধ্য দিয়ে এই যে প্রবেশ, এরপর রোমেনা আফাজ প্রতিনিয়ত নিজেকেই পেছনে ফেলেছেন খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা দিয়ে। সাহিত্যের নানান শাখায় তিনি কাজ করেছেন। লিখেছেন ছোটগল্প, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, গোয়েন্দা সিরিজ ও রহস্য সিরিজ। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় আড়াইশ। এর মাঝে তার লেখা গোয়েন্দা কাহিনি, যার প্রধান চরিত্র দস্যু বনহুর, যার ভয়ে দেশবাসী প্রকম্পমান সেই অমর চরিত্রকে ঘিরেই লেখেন তার পাঠকপ্রিয় রহস্য উপন্যাসের সিরিজ। এই সিরিজের জনপ্রিয়তায় পাঠকের হৃদয়ে তিনি স্থান করে নেন অন্য উচ্চতায়। দস্যু বনহুর হয়ে ওঠে লাখো পাঠকের স্বপ্ন নায়ক। 

সিরিজের এই প্রথম বই ‘দস্যু বনহুর’ প্রকাশ পায় ১৯৬৫ সালে। তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন দস্যু বনহুরের স্রষ্টা হিসেবে। এই চরিত্র বা এ ধরনের কাহিনি লেখার বীজ রোমেনা আফাজের মনের ভেতরে উঁকি দিয়েছিল কৈশোরেই। পুলিশে চাকরি করার সুবাদে বাবাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে নানারকম অভিজ্ঞতা। তদন্ত করতে হয়েছে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলা। সে সব মামলা বা ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের কথা বাড়িতে ফিরে বাবা গল্প করতেন মেয়ের সঙ্গে। বাবার কাছে শোনা সত্য ঘটনার অনেকগুলোই পরবর্তীকালে রোমেনা আফাজের নানা পর্যায়ের স্মৃতিচারণের সূত্র ধরে উঠে এসেছে। তার পরিবারের সদস্যদেরও স্মৃতিচারণায় বারবার ঘুরে-ফিরে আসে দুটি কাহিনি। বাবা কাজেম উদ্দিন আহম্মদ সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফিরে ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে বসতেন। মেয়েকে সারাদিনের কথা না শোনানো পর্যন্ত যেমন নিজের স্বস্তি ছিল না, তেমনি মেয়ে রোমেনাও অপেক্ষা করত বাবার বাড়ি ফিরে আসার। বাবার মুখে রোমাঞ্চকর কাহিনিগুলো শোনার অপেক্ষাতেই যেন তার সময় কাটত। বাড়ি ফিরে বাবা মেয়েকে কাছে টেনে বলতে শুরু করতেন, ‘জানো খুকি, আজ কী হয়েছে? দুই কিশোর, যারা পরস্পরের বন্ধু। তারা নদীর ঘাটে বন্দুক নিয়ে গিয়েছে পাখি শিকারের জন্য। শিকার শেষে একসময় এক বন্ধু ফিরে আসে, কিন্তু অন্য বন্ধু ফিরে আসে না। বন্ধু ফিরে না আসায় তার মা-বাবা অন্য বন্ধুর কাছে যায় ছেলের খোঁজে। ছেলেটি 

একথা-সেকথা বলে। তার বাড়ি ফিরে আসার কথাও বলে। শিকার শেষে কোথায় গেছে, তা জানে না বলেও জানায়। তখন নিখোঁজ ছেলেটির মা-বাবা থানায় আসে। অভিযোগ দেয়। যার তদন্ত করেন কাজেম উদ্দিন আহম্মদ। তদন্তে নেমে তিনি ছেলেটিকে নিয়ে যান নদীর ঘাটে, তাদের শিকারের সেই জায়গায়। একপর্যায়ে তিনি নদীর ধারে বালুতে ভারী কিছু টেনে নেওয়ার ছাপ দেখেন। সেই ছাপের চিহ্ন ধরে এগিয়ে যান, যেখানে ছাপের শেষ সেখানের বালু খুঁড়লে বের হয়ে আসে নিখোঁজ বন্ধুর মৃতদেহ। তবে বন্ধুটিকে অন্য বন্ধু খুন করেনি। সে নিজেই বন্দুকের গুলিতেই মারা যায়। শিকারের এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে বন্দুকে ঠেস দিয়ে বসে ছিল তারা। যে বন্ধুটি মারা যায়, সে নিজের থুতনিতে বন্দুুকের নল রেখে ঠেস দিয়ে বসে ছিল। হঠাৎই এ সময় গুলি বেরিয়ে সে মারা যায়। তখন বেঁচে থাকা বন্ধু ভয় পেয়ে তার লাশ বালিতে চাপা দেয়। যা উঠে আসে কাজেম উদ্দিন আহম্মদের তদন্তে। বাবার মুখে শোনা এরকম রোমহর্ষ করা গল্পগুলোই তার কিশোরী মনে জায়গা করে নেয়। আর বাবার কর্মসূত্রে রোমেনার শৈশব-কৈশোরের অনেক সময় কেটেছে ভারতের কলকাতা, বীরভূম, ধানবাদ, মেদিনীপুর, চন্দনপুর, লক্ষ্ণৌ, দিল্লি, আগ্রা ও আজমীর শরীফে। বাবার মুখে শোনা গল্প এবং ভারতবর্ষের নানা স্থানে থাকার অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে লেখার জগতে স্থায়ী আসন করার পথে কাহিনির যোগসূত্র হয়ে ওঠে। 

রোমেনা আফাজের প্রথম বই হচ্ছে ‘রক্তে আঁকা ম্যাপ’। এই বইটিও একটি সিরিজ বইয়ের প্রথম বই। ‘দস্যুরানী’ শিরোনাম সিরিজ উপন্যাসের প্রথম এই বইটি প্রকাশ পায় ১৯৫৯ সালে বগুড়ার ‘সাহিত্য কুটির’ নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এই সিরিজের বই প্রকাশ পেয়েছিল ১২টি। অন্যদিকে দস্যু বনহুর সিরিজের বইয়ের সংখ্যা ১৩৮টি। 

এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯২৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার শেরপুরে তার জন্ম। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। যখন তার বয়স ১০ বা ১১ বছর, তখন কলকাতা থেকে বাবা বদলি হয়ে এলেন বগুড়া শেরপুরে। এখানে থাকার সময়েই, মাত্র ১৩ বছর বয়সে রোমেনা আফাজের বিয়ে হয়। পাত্র জেলা সদরের ফুলকোট গ্রামের চিকিৎসক মো. আফাজ উল্লাহ সরকার। বিয়ের অনেক পরে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে রোমেনা আফাজ স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন বগুড়া শহরের জলেশ^রীতলায়। স্বামীর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা আর পাঠকের ভালোবাসায় তিনি লিখতে থাকেন। আমৃত্যু লেখালেখির মধ্যে থাকা রোমেনা আফাজের লেখালেখিতে অবশ্য দুবার ভাটা পড়েছে। তিনি থমকে গিয়েছিলেন, বন্ধ হয়েছিল লেখালেখি। রোমেনা আফাজ-আফাজ উদ্দিন দম্পতির সাত ছেলে ও দুই মেয়ে। এর মাঝে মেয়ে হেলেনা বেগম মারা যায় ১৯৭৬ সালে। এই মেয়ের মৃত্যুর পর রোমেনা ভেঙে পড়েন। মেয়ের মৃত্যুশোকে প্রথমবারের মতো তার লেখালেখিতে ভাটা পড়ে। শোক কাটিয়ে একসময় আবার ফিরে আসেন লেখার জগতে। তবে পরবর্তীকালে আরও একবার তার লেখালেখি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে স্বামীর মৃত্যু, দীর্ঘদিনের 

সঙ্গী-সহচরের মৃত্যু শোকে দ্বিতীয়বারের মতো স্তব্ধ হয়েছিল রোমেনা আফাজের কলম। 

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রোমেনা আফাজ

রোমেনা আফাজের ছয়টি উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এই উপন্যাসগুলো হচ্ছে- কাগজের নৌকা, মোমের আলো, মায়ার সংসার, মধুমিতা, মাটির মানুষ ও দস্যু বনহুর। প্রথম চলচ্চিত্রটি নির্মাণ হয় ১৯৬৬ সালে। সে বছর ‘কাগজের নৌকা’ উপন্যাস অবলম্বন করে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বিখ্যাত পরিচালক সুভাষ দত্ত চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন। ৩৫ মিলিমিটারের এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালের ৫ আগস্ট। প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন সুচন্দা, শওকত আকবর, সৈয়দ হাসান ইমাম, আনোয়ারা। এরপর ১৯৭০ সালে তার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ হয় ‘মোমের আলো’, ১৯৭৪ সালে ‘মায়ার সংসার’ চলচ্চিত্র। ১৯৭৫ সালে তার উপন্যাস ‘প্রিয়ার কণ্ঠস্বর’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র ‘মধুমিতা’ এবং ১৯৯৪ সালে নির্মিত হয় ‘মাটির মানুষ’। সুভাষ দত্তের পরে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক মোস্তফা মেহমুদ। তার লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সর্বশেষ ছবি দস্যু বনহুর। যে চরিত্রকে কেন্দ্র করে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় সাহিত্যের ধারা। সেই চরিত্রটিকেই সামনে এনে দস্যু বনহুর ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নেন মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। তিনি নব্বই দশকে এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। 

রোমেনা আফাজের লেখালেখির জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না। মায়ের লেখালেখি নিয়ে ছেলে মন্তেজুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘রোমেনা আফাজের লেখার কোনো সময় ছিল না। কাজের অবসরে নয়, তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখতেন। কখনো লিখতে বসে উঠে গিয়ে ভাত চড়াতেন। কত দিন শিশু আমি খাওয়ার বায়না ধরায় মা লেখা ছেড়ে উঠে খেতে দিয়েছেন। কখনো কোনো কিছুতে বিরক্ত হতেন না।’ 

রোমেনা আফাজ শুধু লেখালেখির মাঝেই নিজের কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি অংশ নিয়েছিলেন নানান সমাজসেবামূলক কাজেও। জড়িত ছিলেন অসংখ্য সামাজিক ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও। লেখালেখির জীবনে তার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি পাঠকের ভালোবাসা। বগুড়ার জলেশ্বরীতলার নিজ বাড়িতে ৭৭ বছর বয়সে ২০০৩ সালের ১২ জুন তিনি মারা যান। মৃত্যুর সাত বছর পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তার সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১০ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

রোমেনা আফাজের অমর চরিত্র দস্যু বনহুর, তার প্রিয় ঘোড়া তাজ, বনহুরের জন্য রাত জেগে থাকা নূরী, তার প্রেম ও অপেক্ষার মাঝে যে মানবিক গল্প তিনি রচনা করেছিলেন, তাই তাকে পৌঁছে দিয়েছে বাংলার শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামে অসংখ্য পাঠকের কাছে। তার আঁকা চরিত্রের মধ্য দিয়ে চিরকালের বঞ্চিতরা স্বাদ পেয়েছে জেগে ওঠার, অতৃপ্তি কাটিয়ে ওঠার। সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক দস্যু বনহুর হয়ে উঠেছিল অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের নায়ক। রোমেনা আফাজ অসংখ্য কবিতাও লিখেছেন। সেসব কবিতা অনেক সময় দস্যু বনহুরের মুখ দিয়েও বেরিয়ে এসেছে। তার একটি কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘প্রদীপ যদি নিভে যায়- কী হবে তাতে তৈল ভরি হায়’। মৃত্যুর পরে কৃতী মানুষকে স্মরণ, তাকে পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে সম্মান জানানোর আমাদের যে রীতি, এই পঙ্ক্তি কি তারই প্রতিবাদ?  

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫