Logo
×

Follow Us

গল্প

পার্সেল

Icon

সঙ্গীতা ইয়াসমিন

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:২৮

পার্সেল

পার্সেল। ছবি: সংগৃহীত

কাউন্টার ক্লোজড সাইন ঝুলিয়ে পাল্লাটা টানতে যাবে ফারিহা ঠিক তখনই মেইল উম্যান এলো। অনেকগুলো অফিস মেইলের সাথে তার নামে একটা রেজিস্ট্রি পার্সেল। বেশ ভারী বাক্স, ভেতরে কী আছে কে জানে! ভাগ্যিস আজই এলো, নইলে আরও দু’দিন অপেক্ষা করতে হতো। আগামী দুদিন তার ডে অফ। একটু খটকা লাগল, তাকে কে পার্সেল পাঠাবে! বাক্সটি হাতে নিয়ে দেখল অচেনা ব্যক্তির নাম ঠিকানা। প্রেরকের ঠিকানায় তার চেনাজানা এমন কেউ থাকে বলেও মনে করতে পারছে না। মনের ভেতরে অজানা কৌতূহল দানা বেঁধে উঠছে, বাক্সটি না খোলা অব্দি তার শান্তি হবে না। 

ডা. আসিফা রহমানের জরুরি মেইলগুলো তাঁকে দিয়ে চেম্বারের পেছনের ঘরে স্টাফদের ছোট্ট ডাইনিং রুমের দিকে গেল। লাঞ্চবক্স না খুলে চাকু দিয়ে পার্সেল বাক্সটি আগে খুলল। ফারিহার জানা ছিল না এত অদ্ভুত বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তার জন্য সেই অজানা পার্সেলের ভেতরে। সময়টা থমকে গেল, নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। এখনো আধাবেলা অফিস কী করে করবে সেটাই ভাবছে। খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে সে।

খেতে গিয়েও আর খাওয়া হলো না। স্মৃতির আয়নায় পুরোনো দিনের সব কথা সেলুলয়েডের পর্দার মতো ভেসে উঠল। ভাবনার সাগরে ডুব দিয়ে তলিয়ে গেল অতল অবগাহনে। সেদিনও ঠিক বারোটায়, লাঞ্চে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ভদ্রলোক এসেছিলেন। অন্যদিন হলে অপেক্ষা না করে কাউন্টারে ক্লোজ করেই ভেতরে চলে যায় হাতব্যাগ নিয়ে। আজ কেন জানি ভদ্রলোককে দেখে লাঞ্চ ব্রেকের কথা ভুলেই গেল। তাকে বসতে বলে ভেতরে উঁকি দিয়ে ডাক্তারনীকে জানিয়ে এলো, ম্যাম, এই মাত্র একজন পেশেন্ট এল, তাকে সাইন অফ করিয়ে দিচ্ছি। 

ডাক্তারনী কথাটা মাথায় এলেই ফারিহার খানিক বিরক্তির উদ্রেক ঘটে। বাংলা ভাষায় এমন সব বিদঘুটে নিয়ম। কারও পেশার সাথে লিঙ্গের কী সম্পর্ক! মহিলা কবি, মহিলা ডাক্তার, মহিলা শিল্পী, শিক্ষয়িত্রী এ জাতীয় শব্দাবলি ব্যবহারের আলাদা কোনো মাহাত্ম্য খুঁজে পায় না সে। আদতেই পেশার লিঙ্গান্তর দরকার কেন সে এক বিশাল বৈয়াকরণিক যুদ্ধ। আপাতত তাই নিজ কাজে মনোনিবেশ করল সে। 

মাস দুয়েক আগে প্রথমবার এসেছিল এই রোগী। সেদিন ছিল সে ভয়ানক বিধ্বস্ত। উসকো খুসকো চুল, ময়লা ছেঁড়া পোশাক, রুক্ষ্ম চেহারা, এলোমেলো কথাবার্তা, নেশাগ্রস্ত মানুষের মত এলোমেলো কথাবার্তা। না ঘুমানোর ছাপও স্পষ্ট দু’চোখের নিচে। মন ভেঙে যাওয়ার নিঃশব্দ বেদনাও যেন ফুটেছিল সমস্ত মুখাবয়বে। এমন বিষণ্ণ, একাকি মানুষটিকে দেখে যে কারো মায়া হতে পারে, ফারিহারও মন কেমন করে উঠেছিল সেদিন। জানাল তার মানসিক পরিষেবা দরকার, কাউকে সে বলতে চায় নিজের কথা। পেশাতগত দায় থেকেই সেদিন ফারিহা তার একনিষ্ঠ শ্রোতা হয়েছিল। গল্প শুনতে শুনতে মনে মনে প্রার্থনা করেছিল, ভালবেসে কেউ যেন এভাবে প্রতারিত না হয় কখনও। এমন অসহায় পরিণতি যেন কারো জীবনে না হয়! কারো জীবনে দুপুর বেলায়ই হঠাৎ সন্ধ্যা ঘনায়।

হুমায়ুন কবির, বাদশাহনামদারের  নামেই নাম। একদিন তেমনি রাজার হালেই ছিল জীবন যার। রাজ-রাজাদের মত এ দেশে তার বিলাসবহুল আলিশান বাড়ি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ব্রান্ড নিউ বিএম ডাব্লিউ গাড়ি। হ্যান্ডসাম বেতনের চাকরি আর দু’দুটো ফুটফুটে কন্যা। দেশ ছেড়েছিল বছর ২৬ আগে, ছাত্রত্ব নিয়ে। অতঃপর, জায়ান্ট কর্পোরেট কোম্পানি ‘অ্যাপেল ক্যানাডায়’ চাকরি। দীর্ঘ আঠারো বছর কাজ করার পরে গোল্ডেন হ্যান্ডসেক নিয়ে নিজেই একটা সফটওয়্যারের ব্যবসা শুরু করেছিল। ততদিনে মেয়ে দুটোও ইউনিভার্সিটি পড়া শেষ, বাড়ির ব্যাংক লোন শোধ হয়ে গেছে। জীবন তখন শুধু উড়ে বেড়ানোর, প্রজাপতির পাখায় চাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু বিধি বাম, সেই সুখ সইল না কপালে! 

একদিন রাতে ঘুমুতে যাবার আগে হঠাৎ মেলিসা বলল, 

Hamlet, I want to tell you something important. 

হুমায়ূন আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে স্ত্রীর সাথে কিছুটা ঘণিষ্ঠ হয়ে বসে বলল, কী কথা? রুদ্ধদ্বার বৈঠক? অফিস প্রজ্ঞাপন দিয়ে হবে সে বৈঠক? 

মেলিসা খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে সরে গিয়ে বলল, Well, it is better to tell you directly, I want divorce. হুমায়ূন যেন কিছুই শুনতে পেল না মেলিসার কথা। তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল! হুমায়ূনকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই মেলিসা আবারও বলল, 

If you ask me the reason behind, the answer is very simple, I do not feel any love or attachment with you anymore. Nor mentally neither physically. So, it does not make any sense to be together. 

সে রাতে হুমায়ুন মেলিসাকে আর কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করেনি, কেননা তাতে কোনো লাভ নেই সে জানত। বেলকুনিতে বসেই হীম নীরবতায় গোটা রাত কাটিয়ে দিল আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরাতন স্মৃতির পাতায় আগুন জ্বেলে। 

গ্রাজুয়েশনটা শেষ করে কয়েক বন্ধু মিলে দরখাস্ত করেছিল কানাডায় স্টুডেন্ট ভিসার জন্য। কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়, অটোয়ায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ হয়ে গেল। কার্লটনে ডেভেলপিং কান্ট্রির জন্য কিছু স্পেশ্যাল প্রোগ্রাম আছে, সেই কোঠায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত। একজন বাংলাদেশী ছাত্র হিসেবে তার ফুল স্কলারশীপ নিশ্চিত হয়ে গেল সহজেই! সেই যাত্রা শুরু,  এর পরে আর কখনও ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে হয়নি। জানা গন্তব্য, কেবল দম নিয়েই গাড়ি চলতে থাকল। 

পড়ার সময়ে সখ্য হয়েছিল মেলিসার সাথে, ওর বছর তিনেকের জুনিয়র। প্রেমে পড়লেও ওকে নিয়ে ঘর বাঁধার কথা ভাবেনি হুমায়ুন। হুমায়ূনের বিশ্বাস বাঙালি মেয়েদের মত এত মায়াবতী পৃথিবীর আর কোনো মেয়েরাই হয় না। তাঁরা যখন কাজল টানে চোখের কোণায় সে গভীর মায়ায় এক জীবন আটকে থাকা যায় অনায়াসে। তাই জীবনসঙ্গী নির্বাচনে সে কিছুটা সংস্কারপন্থীই ছিল। 

সেপ্টেম্বরে শেষরাতের ঠান্ডায় হাত পা কুঁকড়ে  যাচ্ছে বেলকুনিতে বসে। এক নাগাড়ে বসে থেকে পা ব্যথা করছে, মনটাও কফির বিষ ঢালতে চাইছে প্রাণের কেতলিতে। উঠে গিয়ে এক কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি, আর একটা পাতলা গায়ের চাদর নিয়ে আবার ফিরে এলো বেলকুনির ইজিচেয়ারে। 

সতেরো নম্বর সিগারেট ধরাল হুমায়ুন। সিগারেটের আগুন তখন মনের অলি গলিতে। ধোঁয়াগুলো ধোঁয়াশার মতো সময়কে ধরে নিয়ে গেল ছাব্বিশ বছর পেছনে। একে একে বায়োস্কোপের মতো সব রঙিন ছবি রংহীন হয়ে ভেসে আসতে লাগল অতীতের ধূলি উড়িয়ে। স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভের আবেদনপত্রটি কোনো অজানা কারণে দু’বছর ধরে বন্দি ছিল ইমিগ্রেশন অব কানাডায়। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। সেদিন মেলিসার আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারেনি কেবল একটি সবুজ (কানাডিয়ান) পাসপোর্টের জন্য। 

হুমায়ূনের মনে তখন অজানা আশঙ্কা, ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে বেশিদিন থাকা যাবে না। যে কোনো মুহূর্তে জব লস করলে বিপদে পড়তে হবে। এদেশের বহুল প্রচলিত জোকস, “ডোন্ট ট্রাস্ট  অন থ্রি ডব্লিউজ” এই থ্রি ডব্লিউর এক ডব্লিউ হল ওয়ার্ক! আরেক ডব্লিউ উইমেন। ভাগ্যের ফেরে এত বছর পরে সেই ‘ডব্লিউ চক্করেই’ পড়তে হল তাকে। 

বেশ ঘটা করেই হুমায়ূন-মেলিসার বিয়ে হয়েছিল খ্রিষ্টীয় রীতিতে। বিয়ের আগেই হুমায়ূনকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তে হুমায়ূনের কোনো ভূমিকাই ছিল না। কেবল বলির পাঠার মতো সব মেনে নিয়েছিল সে। যে মানুষটা জীবনে কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করেনি তার আবার ধর্মান্তকরণ? ব্যপারটা হাস্যকর এবং অবমাননারও! তবুও সেই অতি হাস্যকর ঘটনাটি বিয়ের চেয়েও মহা ধুমধামে করা হয়েছিল মেলিসাদের সমাজে। ১৯৯০ সালের ২৫ জুলাই হুমায়ূন তার সকল অতীত ভুমুছে দিয়ে নবজন্ম লাভ করল, হ্যামলেট ব্রাউন হিসেবে। মেলিসার লাস্ট নেম ব্রাউন, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সেও সেই পদবিভুক্ত হয়ে গেল।

তার দুদিন পরেই বিয়ে হল, বিয়ের আসরে ধবধবে দুধ সাদা গাউন পরে হীরার গহনায় হেয়ার পিনসহ কানের দুলে, সাদা দোপাট্টায় মাথা ঢেকে বাবার হাত ধরে চার্চে এসেছিলো মেলিসা, স্বপ্নের পরির মতো লাগছিল ওকে দেখতে। হ্যামলেট ব্রাউনের প্রণয়িনী মেলিসা ব্রাউন। অথচ, সেই আনন্দঘন মুহূর্তে হ্যামলেট তাকিয়ে ছিল ভাবলেশহীন সুদূর অতীতে। চোখের সামনে তখন নোলক পরা লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে মায়ের পান খাওয়া লাল ঠোঁটের ছবি! মূহুর্মূহু করতালির শব্দ ভেদ করে ভেসে যাচ্ছিল হৃদয় পারাবার। চোখের কোণ অজান্তেই ঝাপসা হয়ে উঠছিল।  

আঠারো বছর পার করেও হ্যামলেট-মেলিসার রূপকথার সেই বিয়েটা টেকেনি। ডিভোর্সের মামলায় এ সমাজে মেয়েরাই সব দিক থেকে জেতে। সম্পত্তির অর্ধেক সমানভাবে ভাগ হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী ব্যক্তিটি সর্বস্ব হারায়। কেবল অর্থ-প্রতিপত্তি-সম্মান খোয়ানো নয়, একা হয়ে যায়। একটি ভালোবাসার সংসার হারিয়ে, পরিবার পরিজনবিহীন হয়ে পড়াটা একজন পুরুষের পক্ষে খুব সহজ বিষয় নয়।  

দ্বিতীয়বার দেখা হবার আগ পর্যন্ত সবই ভুলে গিয়েছিল ফারিহা। প্রতিদিন এমন অসংখ্য ঘটনার মাঝে ক’জনের গল্প আর মনে থাকে! তবে, দ্বিতীয় দিনে তাকে অনেক সজীব-সতেজ আর ফুরফুরে মনে হল দেখতে। হাসি হাসি মুখ করে বলল, 

-আপা কেমন আছেন? ডাক্তার আপা আছেন? ফারিহা বলল, জি ভাল আছি। আজ আপনাকে বেশ ফ্রেশ লাগছে, আপনি নিশ্চয়ই আগের চেয়ে ভাল আছেন। 

ফারিহার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে হ্যামলেট সেদিন এক আজব কাণ্ড ঘটাল। সে কথা মনে হলে এখনও ভেতরে তিরতিরে কাঁপন ধরে ফারিহার। ভেতর থেকে এক ষোল বছরের কিশোরী এসে সলাজ আব্রুতে ঢেকে দিয়ে যায় চারপাশ। মনে হয় হীমঘরে রাখা হিমায়িত লাশ পড়ে আছে..চারিদিকে গোলাপজল আর আতর মেশা মিহি বাতাস! মনটা হু হু করে ওঠে লাশকাটা ঘরের ব্যবচ্ছেদ টেবিলে!

ফারিহা হ্যামলেটকে বলল, একটু অপেক্ষা করুন। হাতের কাজটা সেরেই আপনার কাজ করছি। এই রিমোট কন্ট্রোল নিন, নিউজ দেখুন, বলে টিভির রিমোট কন্ট্রোলটা এগিয়ে দিল। হ্যামলেট সেদিকে না তাকিয়ে কাউন্টারের সামনে ফারিহার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। ফারিহার খুব অস্বস্তি  হচ্ছিল, সে আবার জিজ্ঞেস করল, 

আপনার কী খুব বেশি তাড়া? তবে, দিন আপনার হেলথ কার্ড। আগে আপনার কাজ সেরে পরে আমার কাজ করব। 

হ্যামলেট এবার স্মিত হেসে বলল, 

-কে বলেছে আমার তাড়া আছে, কই, আপনাকে তাড়া দিচ্ছি না তো! ফারিহা এবার বলল, 

কেউ এভাবে ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলে কাজ করা যায়?  

অপরাধীর মত মুখ করে একটু সলাজ হাসি হেসে হ্যামলেট বলল, 

-এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমি যদি একটু ভাল বোধ করি তাও কেড়ে নিতে চান? খুব বেশি আপত্তিকর কিছু করছি কি? প্রিন্সেসের সামনে থেকে সরে যেতে আমার পা আটকে আসলে আমি কী করব বলুন? তবুও যদি...। 

হ্যামলেটের চোখের দিকে তাকাতে গিয়েও চোখ নামিয়ে নিয়েছিল ফারিহা। পাছে নিজের কাছেই লজ্জা পায় ভেবে নিজের কাজে মনোনিবেশ করেছিল। হ্যামলেট প্রায় আধাঘণ্টা সেই একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়েছিল।

এর মাস সাতেক পরে আবার হঠাৎ দেখা ভিড়ের বাসে। হ্যামলেট কফি খাওয়ার অফার দিয়েছিল। সময় হয়নি। ভিড়ের মধ্যেও সিট ছেড়ে এসে ফারিহার পাশে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, অ্যালবার্টায় একটা চাকরি পেয়েছে। সেখানে চলে যাবে আগামী মাসেই। বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার রায় হয়েছে। মেয়েদের সাথেও আজকাল আর দেখা করা যায় না। তাই এ শহর থেকে দ্রুতই পালাতে চায়। খুব অনুনয়ের চোখে ফোন নম্বরটা একটা চিরকুটে লিখে ফারিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল -মাঝেসাঝে জ্বালানোর অনুমতি পেতে পারি প্রিন্সেস? 

ফারিহা মৌন চোখে তাকিয়ে চিরকুটটি পার্সের ভেতরে চালান করে দিয়েছিল। দু’একবার কথাও হয়েছে অ্যালবার্টা যাওয়ার পরে। হ্যামলেটই কল দিতো। ফারিহা ছিল তাঁর নির্বিকার নীরব শ্রোতা। কখনই প্রশ্ন, মন্তব্য করত না। শুধু হু, হ্যাঁ ছাড়া। হ্যামলেট এক নাগাড়ে বলে যেত নিজের কথা।

আজ পুরো লাঞ্চ ব্রেকের সময়টা হুমায়ুননামায় মগ্ন হয়ে রইল ফারিহা। কী আশ্চর্য! একটা মানুষ, যার সাথে কোনো সম্বন্ধই তৈরি হয়নি কখনওই আজ তার চলে যাওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না ফারিহা। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ গড়িয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল পার্সেলের খোলা বাক্সের ওপরে। চিঠির পাতাটা ভিজে উঠল। লেখাগুলো ফাউন্টেনের কালিতে ছিল, যা জলরঙ ছবির মত ছড়িয়ে গেল সবখানে।

 বেলা একটা বেজে গেলেও ফারিহা কাউন্টারে নেই, ডা. আসিফা কিচেনে উঁকি দিতেই দেখলেন ফারিহার বিহ্বল দশা। ফারিহা নিজেকে সামলে নিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। চোখেমুখে পানি দিয়ে এসে বসল কাউন্টারে। ডা. আসিফা জিজ্ঞেস করলেন, 

-ফারিহা, ইজ এভ্রিথিং ওকে? তুমি ঠিক আছ? 

ফারিহা মুখে মিথ্যে হাসি এনে বলল- আই অ্যাম ফাইন, নো ওয়ারি।

কাউন্টার ওপেন করে যথারীতি নিজের কাজে মনোনিবেশ করল। 

হ্যামলেটকে প্রতিশ্রুতি দিলেও ফারিহার খোঁজ নেওয়া হয়নি আর। হঠাৎ হঠাৎ বেদনাবিধুর মুখটা চোখে ভাসত, ছলছলে চোখের পাতা! সব হারানো একটা মানুষের মুখ! মায়াভরা, কাঠিন্য নেই, প্রেমহীন রুক্ষ্ম মরুভূমির ছাপটা স্পষ্ট। একটুখানি মনের আশ্রয় খোঁজে। তাই জন্য কত্ত হাহাকার পোষে অন্তরের গভীরে। আহা! জগতে এমন পুরুষও আছে? 

গত সপ্তাহে অ্যালবার্টা থেকে একটা ফোন কল এসেছিল। অচেনা নম্বর দেখে কলটা ইগনোর করেছিল সে। আজ হঠাৎ কী মনে হতে ফোন নম্বরটা চেক করতে গিয়ে ভয়েস মেসেজে জানল সেটা সাইফের কল ছিল। পার্সেলটা সে ই পাঠিয়েছে। মনের ভেতরে হাজারও কথার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ফারিহার, তবু অফিস বলে কথা। নিজের সাথে যুদ্ধ করেই নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। ঘণ্টা দুয়েক পরে টি ব্রেকে গিয়ে সাইফকে কল দিলো, পত্রপ্রাপ্তি স্বীকার করতে। কল রিসিভ করেই সাইফ বলল আপনি ফারিহা ম্যাম? জি, আপনার পার্সেলটা আজই পেয়েছি। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। 

দিন পনেরো আগেই হ্যামলেট চলে গেছে না ফেরার দেশে। কোলন ক্যান্সারে ভুগছিল গেল আট বছর। যাওয়ার আগে সাইফের কাছে ফারিহাকে লেখা চিঠি, আর কিছু গিফট রেখে গেছে। হাসপাতালের শেষ দিনে প্যাকেটটি হাতে দিয়ে বলেছিল, 

-আমার মৃত্যুর পরে এটা মেইল করিস দোস্ত। গেল পাঁচ বছর ধরে সাইফ ছিল হ্যামলেটের সর্বক্ষণের সঙ্গী তথা রুমমেট।  

টি ব্রেক শেষ করে কাউন্টারে ফিরে সিটে বসতে বসতেই ডা. আসিফার তলব, 

-ফারিহা বেশ ক’জন রোগী এসে বসে আছেন। আমি একজনকে দেখতে শুরু করেছি তোমার দেরি দেখে। তুমি বরং ওর এন্ট্রিটা দিয়ে দাও। এই বলে ডা. আসিফা হাত বাড়িয়ে একটি হেলথ কার্ড এগিয়ে দিলেন ফারিহার দিকে। 

ফারিহার চোখে বিস্ফারিত বিস্ময়! এ কী করে সম্ভব? সে ঠিকঠাক পড়ছে তো, এবারে সে একটা একটা অক্ষর বানান করে পড়ে নিল, ‘হ্যা-ম-লে-ট ব্রা-উ-ন’, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কার্ড স্কান করতে গিয়ে এবার নিশ্চিত হল, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, সবই হুবহু এক। কম্পিউটার স্ক্রিনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর নিজেই ভাবল, এ নেহায়েত হ্যালুসিনেশন। তাই গা ঝারা দিয়ে উঠে পরের রোগীকে এন্ট্রি দিতে ডাক দিল ফারিহা, নেক্সট প্লিজ। এরই ফাঁকে ডা. আসিফার রুম থেকে প্রথম রোগী বেরিয়ে এলেন। দীঘল শ্যামবর্ণের মাথাভর্তি ঘন কালো চুল, ব্যাকব্রাশ করা, জিন্স টি শার্ট পরনে হাস্যোজ্জ্বল যুবক। ফারিহার দিকে ব্লাড টেস্টের অর্ডার পেপার ধরিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, 

-কেমন আছেন প্রিন্সেস?

ভদ্রলোকের দিকে তাকাতে গিয়েই সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল ফারিহার, সেই একই পারফিউমের চেনা গন্ধ ভেসে এলো বাতাসে। মুখ থেকে কথা সরল না। হাতে ধরা কাগজটি পড়ে গেল। মুহূর্তেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেঝেতে। ৯১১ নম্বরে কল করলে অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে গেল এমার্জেন্সিতে।  

পুরো সাতদিন হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে জমে মানুষে টানাটানি। আজই প্রথম চোখ খুলেছে। বিছানা ছাড়তে চাচ্ছে না শরীরকে, ভীষণ দুর্বল। শুয়ে শুয়ে অর্ধনিমীলিত চোখের পাতায় কম্পিউটার স্ক্রিনের মতো ভেসে যাচ্ছে দুই শব্দের একটি বাক্য...‘আ-মা-র প্রিন্সেস’! গত পাঁচ বছরে পাঁচশ চিঠি লিখেছে বাদশাহ হুমায়ূন তাঁর প্রিন্সেসকে, যার বেশিরভাগই শুধু এই একটি বাক্য। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫