Logo
×

Follow Us

গল্প

সোনালি পা

Icon

নূরে জান্নাত

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৬

সোনালি পা

প্রতীকী ছবি

কুয়াশা আদরে রেখেছে সর্ষের ফুল, দূর্বার ডগা, গাছের পাতা, পাখি ও পথেদের। ওদের মতোই আদরে রেখেছে এক জোড়া সোনালি পা-কে এই শীতেও! বিদেশি কম্বলে ঢেকে দিয়েছে দারুণ ওমে। জানালার ওপারে বাসা বেঁধেছে হিমেল হাওয়া। এমন শীতেও স্বচ্ছ বালুর সঙ্গে জলের ধারা ছুঁয়ে ইছামতিতে জীবন যাপন করছে মাছের দল। মাসুদের মাথাভর্তি এসব দৃশ্য।

নদী, জল, নীলাকাশ ও সর্ষের মাঠ চিন্তার  তুলিতেই। নেই শুধু রং, আঁকবার কাগজ। তবুও মাসুদ আঁকাআঁকি শেষে কাঠের পুলে এসে দাঁড়ায়। সিরাজগঞ্জের প্রাচীন ঐতিহ্য, এই ব্রিজটা পুরোটাই কাঠ দিয়ে তৈরি ছিল একসময়। এখন সিমেন্টের ব্রিজ, নামটা কাঠের পুলই রয়ে গেছে। এই ব্রিজের নিচেই বহমান নদীটি যেন মাসুদের মতো স্থবির হয়ে আছে! এই স্থবিরতা কাটাতে মাসুদ হেঁটে হেঁটে বাহির গোলা গুড়ের বাজারে এসে থেমে যায়। এ দৃশ্য নিত্যদিনের। মোজায় ঢাকা  তার পা থেকে  যেন সোনালি আলো ছুটছে, যা শুধু মাসুদই দেখে। শীতের পোশাকে সোনালি পা নিয়ে গুড় তৈরির কারিগরদের ঝাকার কাছে যেতে চায়, কিন্তু মাসুদকে সহ্য করতে পারে না কেউ। তবুও গুড়ের ঝাকা থেকে পাটের চট সরানোর সঙ্গে সঙ্গে আসা মিষ্টি গন্ধটুকুর জন্যে দাঁড়িয়ে একটু দূরে মাসুদ। গুড়ের গন্ধ  ভালো লাগায় নিয়ম করেই এখানে আসে। মা দাদিদের মুখে  সে শুনেছে বাহির গোলা গুড়ের বাজার বিশ্বের মধ্যে একমাত্র এবং বড়ো গুড়ের বাজার ছিল। গুড়ের বাজার পার করে একটু পূর্ব দিকে গ্রেট ব্রিটেনের তৈরি ১০০ বছরের পুরোনো রেল সেতুর উপরে এসে পা ঝুলিয়ে বসে। এখন এই নদীতে জল নেই, স্রোত নেই, রেল সেতুটাও যাদব চন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ির মতোই বিলুপ্তির পথে!

ভাবনার দখল কেড়ে নেয় মাসুদের ঝুলানো সোনালি পা। ব্রিজের নিচে থাকা জল ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকলে মাসুদ বুঝে যায় অস্পষ্ট জলজ দানবের তার পা দুটো পছন্দ হয়েছে। পা গুটিয়ে নেওয়ার আগেই থাবা মেরে ছিঁড়ে নিয়ে যায় শখের পা জোড়া! ছেড়া পা থেকে  রক্তের বদলে সোনালি রং ঝড়তে থাকে। মাসুদ চিৎকার করে আকাশ-পাতাল ফাটিয়ে কাঁদতে থাকে। পাশের রুম থেকে কাজের মহিলা আসে। মাসুদ স্বপ্ন দেখছিল! প্রায়ই স্বপ্ন দেখে, কান্নার শব্দে বা চিৎকারেই মানুষ মাসুদকে সাড়া দেয়। এই দুই কারণ ছাড়া পৃথিবীর কেউই মাসুদকে বোঝে না, তার দিকে তাকায় না, কথা বলে না। রোদ এসে হুমড়ি খায় মাসুদের বিছানায়। ফুলকপির সালুন থেকে শীতের ঘ্রাণ ছড়িয়ে যায়। গরম গরম রুটি আর তরকারিতে পেট ভরে যায়।

রিকশার বেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ, চা স্টলের চামুচ ও কাপের টুং টুং তাল, নাপিতের চুল কাটানোর কেচি ফাঁকা ফায়ারে ম্যাগাজিন ক্লিয়ার করার  মতো দু-তিনবার কেচিটা চুল কাটার মতো করে এমনি শব্দ করার শব্দ ভালো লাগে। নিয়ম করে এসব শোনে, দেখে। মসজিদের পাশেই প্রতিদিন বসে থাকে। সকালে আসে, একদম সন্ধ্যার সময় ঘরে ফেরে। মুচিটা কত সুন্দর করে মানুষের পায়ের সেবায় নিয়োজিত। পা-কে সুরক্ষিত রাখতেই জুতোকে ভালো না বাসলেও জুতোকে ব্যবহার করে মানুষ! অথচ জুতোরও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে! মাসুদ উঠে দাঁড়ায়, হাঁটতে থাকে। হাঁটতে পারাটা তার কাছে কবিতার মতো লাগে।
কথা বলতে পারাটা গল্পের শরীর
আর মানুষকে বোঝাতে পারাটা উপন্যাসের মতো।
মাসুদ নিজে নিজেই বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টায়। পড়া শেষ হলে বইগুলো হাওয়ায় মিশে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করে মিষ্টি বাতাস পাশ দিয়ে বয়ে চলে গেল! চোখে পড়ে একটি অদ্ভুত নারী। যার মাথায় চুলের বদলে বইয়ের লেখা যুক্ত অসংখ্য কাগজ, শরীরজুড়ে বইয়ের পাতায় আবৃত লজ্জা, হাত দুটো কাগজের তৈরি। মুহূর্তেই মাসুদ সুদর্শন হয়ে ওঠে... রাস্তায় ফুটে থাকা গোলাপি কাঞ্চন ছিঁড়ে ছুটতে থাকে অদ্ভুত নারীর পেছনে। ছুটতে ছুটতে নির্জন ঘরের  মধ্যে ঢুকে যায়। নারীটি টুকরো টুকরো কাগজের পৃষ্ঠা হয়ে মিশে যায় ঘরের দেওয়ালের ভেতরে। নিমিষেই  দেওয়ালগুলো যেন আয়না হয়ে যায়। যেখানে মাসুদ নিজেকে দেখতে পায় একেক রূপে, একেক দৃশ্যে! আয়নায় তাকে এক রকম দেখাচ্ছে না, দৃষ্টি বদল হচ্ছে। কোথাও সে হিরোর মতো আবার কাথাও বুড়ো  উশকোখুশকো। 

কোথাও বিছানায় শুয়ে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে, কোথাও মাথা কাত করে হুইলচেয়ারে অথর্ব মাসুদ বসে আছে। যে আয়নায় মাসুদ অথর্ব...সেই আয়নার কাছে গিয়ে আয়না স্পর্শ করতেই মাসুদের ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। বাঁকা ঘাড় নিয়ে চোখ তুলে দেখে তার বাড়ির কাজের খালা তাকে প্রতিদিনের মতোই সন্ধ্যাবেলায় ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিয়ম করে বাহিরগোলা জামে মসজিদের কাছে মাসুদকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে যান এবং সন্ধ্যা হলেই ঘরে নিয়ে যান। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘরে বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পর বুকের ওপর স্থির হয়ে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ ভিজে যায় মাসুদের। আজ ৩৬ বসন্ত হারিয়ে গেল জীবন থেকে, সবই স্থবির হয়ে কেটে গেল!
না পেরেছে কোনো দিন হাঁটতে, না পেরেছে বাঁকা ঘাড় সোজা করে তুলে কথা বলতে, না পেরেছে কাউকে কিছু বোঝাতে। মাসুদেরা প্রতিদিন এভাবেই বলি হয় বাস্তবতার জং ধরা ছুড়িতে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫