Logo
×

Follow Us

গল্প

হাতিম, বাবা ও হালিমা

Icon

শুভ আহমেদ

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২০, ১৫:৩৫

হাতিম, বাবা ও হালিমা

প্রতীকী ছবি।

হালিমা থেকে থেকে আঁতকে উঠছিল। চারপাশে কী সব বলাবলি করছে মানুষ। তার সবটা বোধগম্য না হলেও কিছুটা তো টের পাচ্ছিল সে। আরও বেশি চমকে উঠছিল যখন বড় মসজিদের মাইকে বারংবার বলছে, ‘সবাই লক্ষ্য করে শুনুন!, এক মহামারির আগমন ঘটেছে দুনিয়ায়, সবাই খোদার কাছে মাপ চান!, তওবা করুন!, লক্ষ্য করে শুনুন!, লক্ষ্য করে শুনুন!’

তখন হাতিমের কথা মনে করে হালিমা স্বামীর কাছে ছুটে আসে। বলে, ‘হাতিমের বাপ! ও হাতিমের বাপ! একটু উইঠা শোনেন না, কী কয়? আমার তো ভাল্লাগে না।’

হাতিমের বাপ একটু ঘাড় জাগিয়ে বলে, ‘অই সব শুইনা আমাগো কী কাম! অইগুলি বড় লোকের অসুখ-বিসুখ, গরিবের অয় না। গরিব অইলো আল্লার পেয়ারের বান্দা- আমাগো দেখবো আল্লায়। চুপ মাইরা বইসা থাকো! চিন্তার কিছু নাই। খাওনের ব্যবস্থা হইছে?’

হালিমা কিঞ্চিত বিরক্তি মুখে বলল, ‘নাহ’।

হাতিমের বাবা বলে, ‘সারাদিন কি করো আমার বুঝে আসে না, কত বেলা বাড়ছে অহনও কিছুই জোগাড় করতে পার নাই? এই বেরাম তো দেখতাছি ত্যক্ত কইরা ছাড়বো। আমার সামন থেইকা সরো অ্যাহন।’ চড়া গলায় বলে হাতিমের বাবা।

হালিমার দুই চার বাড়িতে কাজ ছিল, সে সুযোগও এখন বন্ধ। কারও ঘর মোছা, কারও কাপড় ধোয়া, কারও কারও বাজার করে দেওয়াও চলতো। কিন্তু লকডাউন বিষয়টি শুরু হওয়ায় কেউ আর তাকে দেখতে চায় না তাদের ত্রিসীমানায়। বলে, ‘এখন আর প্রয়োজন নেই। সব কিছু ভালো হোক তারপর এসো। এদিকে বাদাম নিয়ে হাতিম আর লঞ্চঘাটে যায় না। পুলিশ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। এলোপাতাড়ি বাড়ি হাঁকায়। লঞ্চগুলো সব অচল পড়ে থাকতে দেখে হাতিম কালো মুখে বাড়ি এলে বাবা বলে, ‘মুখ বেজার কইরা লাভ নাইরে বাপ, এই দ্যাশে হইলো আজিব কামকাইজ, চোরের ডরে দরজা খুইলা জানলা বন্ধ কইরা রাখে। মরণ অইছে আমাগো। ব্যারামে আর কী মারবো, মারবো তো পেটে!’

হাতিম তখন বাবার পাশে বসে বাবার বাঁ’হাতটা নিজের কোলে তুলে আঙুলগুলো টিপতে থাকে। বলে, ‘আব্বা খিদা পায় খালি না?’

আধশোয়া বাবা মাথা নেড়ে ‘না’ বলে। তারপর পরমুহূর্তেই আবার বলে ওঠে, ‘হাতিম, আমারে হাঁসের ডিম ভাজা আর আলুভর্তা দিয়া গরম দুইডা ভাত খাইতে ইচ্ছা অয় বাপ। কাইল আমারে খাওয়াইতে পারবি?’

এই বলেই হাতিমের বাবা হাউমাউ করে কাঁদে। বলে, ‘খিদা বড় কঠিন জিনিস রে বাপ। এই রোগের চাইতে বড় রোগ দুনিয়াতে নাই।’

হাতিম বাবার হাত চেপে নিচু মাথায় চুপচাপ বসে থাকে। একটু দূরে বসে হালিমা কুপির আলোয় বাদামের ঠোঙা বানায় আর আস্তে আস্তে চোখ মোছে। খিদে তারও পেয়েছে। সেই দুপুরে অল্প কিছু ভাত জুটেছিল শাক সিদ্ধ দিয়ে, রাতে আর কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এমনিতেও এমন অভ্যাস তার আছে। রাতের খাবার তার মাঝে-মধ্যেই জোটে না। স্বামী ছেলেকে খাইয়ে হাঁড়িতে পানি দিয়ে বলে, ‘আমার খিদা নাই। আপনেরা ঘুমান!’

আজ সেই উপায়ও নেই। অচল স্বামী আর ছেলের মুখের দিকে বারবার তাকায় সে।

হাতিম খুব ভোরে বাদাম নিয়ে বেরোয়। আজ সে লঞ্চঘাটে যায় না। যায় হাটে, বাজারে, আর খেলার মাঠে-মাঠে। মাঠের এক কোণায় মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাইনের প্রায় মানুষই গ্রামের স্বচ্ছল জন। তাদের হাতে সাদা মতোন কাগজ আর ব্যাগ অথবা ওমনি কিছু একটা করে। হাতিম বুঝতে পারে এখানে কি হচ্ছে। মায়ের মুখে শুনেছিল কাল। সরকার সকলের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। তখন হাতিম ভীষণ আনন্দ আর আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছিল হালিমার কাছে, ‘মা, ও মা, তাইলে আমরাও ত চাল পামু, তাই না?

হালিমা আস্তে করে বলেছিল, ‘না বাপ আমাগো দিব না।’

 ‘কেন দিব না মা?’ কৌতূহলে বলে হাতিম।

হালিমা বলে, ‘এত কিছু বুঝি না রে বাপ। তয় দিব না এটা সত্য।’

হালিমাও সেদিন জানতে পেরে ছেলের মতোন আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিল স্থানীয় গণ্যমান্যের কাছে। তার মুখ তো আর এখানকার কারোর অচেনা নয়। সতেরোটি বছর ধরে আছে এই গাঁয়ে, তাই আশ্বাসের আর কমতি ছিল না সবার প্রতি। সেই সবাই যখন বলল, মেম্বারের কাছে যাও এবার! ভাতের চিন্তা তো আগে যাক, বাকিটা আমরা দেখছি।

তখন শেষমেশ মেম্বার বলল ভিন্ন সুর, ‘তুমি ত আর হেনে ভোটার না! তুমি কিছুই পাইবা না। তুমার অঞ্চলে যাও! রিলিফ ওহানে আছে। যাও! যাও আর ত্যক্ত কইরো না তো বেটি।’

হালিমা নিশ্চুপ চলে এসেছিল। এরপর আর কারও কাছে যেয়ে লাভ হয়নি।

হাতিম মুখের মাস্কটা সরিয়ে পথের মাঝে থেমে বড় বড় করে শ্বাস টানল বেশ কয়েক বার। শরীরের তাপটা আজ আবার বাড়তি ঠেকছে। পা চলছে না। একটু বসে জিরোয় হাতিম। তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার সময়ে হাতে দুটি ডিম আর সের খানেক চাল নিয়ে ঘরে ফেরে। হাতিমকে দেখে হালিমা খুশিতে ছুটে এসে স্বামীকে উদ্দেশ করে বলে, ‘দেখেন! দেখেন! আমার বাপজান কত কী নিয়ে আইছে। আর চিন্তা নাই, কি কও বাপ?’

হাতিম ঝুমাঝুমা চোখে মৃদু করে হাসে। বলে, ‘মা আমার জ্বর মনে হয় আবার আহে। বিছানাডা পাইতা দেও দেহি! আমি একটু জিরাইয়া লই। খানা হইলে আমায় ডাইকা দিও! আমি আইজ তোমার হাতে খামু মা।’

তারপরে সেই রাতে আর হাতিম ওঠে না। ভোর ভোর হয়ে এলে সে, নাকে বাঁঝিয়ে বাঁঝিয়ে বলে, ‘আব্বা! ও আব্বা! আব্বা! মায়রে কও না পায়ের কাছের জানলাডা খুইলা দিতে! আমার যে বেজায় ফাঁপর ঠ্যাকতাছে। আব্বা! ও আব্বা!’

এরপর শুধু তার বুকের খাঁচাটা ভেঙে ভেঙে আসে। হালিমা চিৎকার দিয়ে বলে, ‘হাতিম রে, ও বাপ কথা ক! কথা ক!’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫