Logo
×

Follow Us

গল্প

অপলাপ

Icon

সুমন্ত আসলাম

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২০, ১৯:৩৪

অপলাপ

ঝড়ের বেগে বাবা দৌড়ে এলো। তারপর ধপাস করে বসে পড়ল বেঞ্চের ওপর। মুখটা হা করে, হা-হা করে নিঃশ্বাস ছেড়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘সব্বোনাশ হয়ে গেছে খোকা, ভয়ংকর সর্বনাশ।’

ঘুমজড়িত চোখে আমি বাবার দিকে তাকালাম। পরক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মাঝেই টের পেলাম, বাবা আমাকে ডাকছে; কিন্তু ঘুম ভাঙছে না আমার। শেষে বেশ রেগে গিয়ে বাবা আমার দু’চোখের পাতা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল এবং সঙ্গে সঙ্গে লাল টকটকে গরম লোহার একটা দন্ড ঢুকিয়ে দিল আমার কলজে বরাবর।

ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। তারপর দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখি, মাত্র পাঁচ বছর ঘুমিয়েছি। সুস্থ একজন মানুষের অন্তত ছয় থেকে সাত বছর ঘুমানো উচিত। মাত্র নয়টি বিষয়ে পিএইচডি করা আমাদের এ অল্প শিক্ষিত বাবা এ কথাটা জানে। তবুও আমাকে কেনমাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এ অসময়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিল, তা বুঝতে পারলাম না। যদিও বাবাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা ভীষণ ভয়ংকর। কারণ, ভয়ংকর কোনো ঘটনা হলেই বুকের ভিতর গরম লোহার দণ্ড ঢুকিয়ে ঘুম ভাঙানো হয় আমাদের।

মাথাটা নিচু করে বসে আছে বাবা। আস্তে আস্তে আমি বাবার দিকে এগিয়ে গেলাম। সহানুভূতির ভঙ্গিতে তার মাথায় কুড়াল দিয়ে জোরসে একটা কোপ মেরে বললাম, ‘কি হয়েছে বাবা?’

গভীর ভাবে বাবা আমার দিকে তাকাল, ‘ব্যাপারটা অতি ভয়ংকর, বলতে ভীষণ ভয় করছে।’

‘খুবই ভয়ংকর?’

বাবা মাথাটা উঁচু-নিচু করল।

‘ঠিক আছে, তাহলে এখন বলতে হবে না, রাতে বললেই হবে।’

বাবা চলে গেল। আমি ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে এলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, চারকোণে চারটা সূর্য বেশ জ্বলজ্বল  করে জ্বলছে। চারদিকে প্রচুর আলো, তবুও কেমন যেন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। ব্যায়াম করা দরকার। দৌড়ে চলে গেলাম হিমালয়ের কাছে। তারপর সব পাহাড় একসঙ্গে বেঁধে একটা ভারোত্তোলন বানিয়ে ফেললাম। দুই কোটি নব্বই লাখ বার ভারোত্তোলনটা ওঠানামা করে ভাবলাম এবার কয়েক কোটিবার স্কিপিং করা প্রয়োজন।

আশপাশে কোনো দড়ি না পেয়ে খুঁজে খুঁজে বেশ কয়েকটা অজগর ও কয়েকটা সাপ জোগার করলাম। একটার সঙ্গে আরেকটা বেঁধে বেশ বড় একটি দড়ির মতো করে ফেললাম সেগুলোকে। তারপর প্রায় পনেরো কোটিবার দড়ি লাফানো শেষ করলাম এটি দিয়ে।

ক’দিন হলো দাঁতগুলো বেশ ব্যথা করছে। সেদিন কে যেন বলল, পুরাতন এবং বড় কাটাওয়ালা শিমুল গাছের মেছওয়াক দিয়ে দাঁত ঘসলে নাকি ব্যথা কমে যায়। তাই সোজা হেঁটে গেলাম সুন্দরবনে। বনের এক কোণে বুড়ো কাটাওয়ালা একটা শিমুল গাছ পেয়ে সেটা একটানে তুলে ফেললাম শেকড়শুদ্ধো। ওটা দিয়ে বেশ সুন্দর একটা মেছওয়াক বানালাম। দাঁত ঘষতে ঘষতে এগিয়ে গেলাম বঙ্গোপসাগরের দিকে। গোসল করতে হবে। গায়ে বেশ ময়লা জমেছে; কিন্তু বঙ্গোপসাগরে এসে চক্ষু তো চড়ক গাছ। পানি শুকে মরুভূমি। আটলান্টিকের মাঝখানে এসে কোমর পানিতে কোনো রকম গোসল সেরেই বুঝতে পারলাম, প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। বাড়ি এসে বাবাকে বললাম, ‘খাবার দাও।’

মাত্র আশি ড্রাম ভুনা খিচুড়ি, উনিশ ড্রাম মাংস আর নয় ড্রাম সালাদ দেখে মেজাজ হয়ে গেল ভীষণ গরম। এত অল্প খাবারে পেট ভরে। বাবা আমার মুখ দেখেই বলল, ‘রাগ করিস না বাবা, তুই এগুলো খেতে থাক, আমি এর মধ্যে রুটি বানিয়ে দিচ্ছি।’

‘মা কোথায়, বাবা?’

বাবা যেন কেমন চমকে উঠল। তারপর কিছুটা আমতা আমতা করে বলল, ‘বাইরে গেছে।’

‘ফিরবে কখন?’

‘তা তো জানি না। তবে শুনলাম, সৌদি আরব নারী সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে যাবে ইরানে। সেখানে পুরুষ দমন সংঘটা উদ্বোধন করে সরাসরি লাস ভেগাসে। ত্রিশ হাজার কোটি টাকার কি যেন একটি খেলা আছে তা খেলে যাবে আফ্রিকায়। ‘হোয়াইট স্কিন’ নামে একটা বিউটি পার্লার উদ্বোধন করার কথা আছে আজ সেখানে।’

‘তুমি কি আজ বাজারে যাবে?’

‘হ্যাঁ, যাব। ঘরে একদম তরকারি নেই।’

‘কোন বাজার, কাওরান বাজারে?’

‘দুর, ওখানে আবার কিছু পাওয়া যায় নাকি। আজ অস্ট্রেলিয়া থেকে বাজার করে আনব। ওখানে বেশ তাজা শাকসবজি পাওয়া যায়।’

‘সে তো বেশ দূর। সাইকেল নিয়ে যাবে নাকি?’

‘না, হেঁটেই যাব। যেভাবে ভুড়ি বাড়ছে। নব্বই ফুট উঁচু ঘর আমাদের, তবুও চিৎ হয়ে শুলে ভুড়ি ঠেকে চালে। ভাবছি, ঘরটা আরও ত্রিশ ফুট উঁচু করব।’

খাওয়া হতে না হতেই বাবা বলল, ‘তাহলে রাতেই তোকে কথাটা বলব। আর শোন, কথাটা শোনার পরপরই কিন্তু তোকে কাজটি করতে হবে।’ 

কলজেটা ধক করে উঠল আমার। বাবার গাল ফেটে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। রাগলে বাবার এরকম হয়। একবার মাকে কি যেন করতে বলল বাবা। মা সে কাজ না করে বসে রইল মুখ ঝামটে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা প্রচণ্ড রেগে নিজেই নিজের ভুড়িতে মাটি কাটা কোদাল দিয়ে কোপাতে লাগল। কোপাতে কোপাতে বাবার ভুড়ি প্রায় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। শেষে বাবার কী চিৎকার! ডাক্তার এসে গরু বাধার দড়ি দিয়ে বাবার ভুড়িটা সেলাই করার পরই রক্ষা।

‘যা এখন স্কুলে যা।’

মাথায় আধ মণ সরিষার তেল মাখিয়ে বাবা আমাকে মাথা আঁচড়ে দিল।

স্কুল আমার মোটেই ভালো লাগে না। স্যারদের অযথা ধমক ধামক, কান ধরে টেনে তুলে আছার মারা, মাঝে মাঝে পেটে লাথি দিয়ে ভুড়ি ফাটিয়ে দেওয়া, কখনো চোখের মধ্যে পেনসিল ঢুকিয়ে চোখের মনি গেলে ফেলা কিংবা ড্রিল মেশিন দিয়ে শরীরের সমস্ত হাড় ফুটো করে দেওয়া, আরও কত কি। এদিকে সব কয়টি বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে শেষে বর্ণ পরিচিতি বিষয়ে এসে ভীষণ বিপদে পরেছি। কোনো কিছুতেই অক্ষর চিনে উঠতে পারছি না। ব কে বলি চ, চ কে চালিয়ে দেই ক বলে। যার জন্য প্রতিদিনই আমাকে শাস্তি পেতে হয়। বড় একটি গর্ত খুঁড়ে, ওপর করে মাথাটা সেখানে ঢুকিয়ে দিয়ে, পা দুটো সামান্য বাইরে রেখে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয় প্রায় আট ঘণ্টা।

বইয়ের ছালাটা মাথায় নিয়ে আমরা স্কুলের পথে রওনা হলাম। স্কুলে যাওয়ার সময় কুড়ালদের বাড়ি পরে। ও আমাদের চিরশত্রু। আমাদের খুব ইচ্ছে, ওকে একদিন জবাই করে রোস্ট করে খাব। কুড়ালদের আমগাছের সব আম পেকে লাল হয়ে গেছে। রিভলবার আমাকে চোখ টিপে বলল, গাছে উঠতে। সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল বলল, গাছে উঠে লাভ কি; কিন্তু তার আগেই একটানে আমগাছটা তুলে ড্যাগার ওর জামার মধ্যে লুকিয়ে পা বাড়াল স্কুলের দিকে।

স্কুলে এসে দেখি, ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। পদ্ম পুকুরের পানির ওপর বসে সবাই মনোযোগ দিয়ে চিৎকার করছে। আর পড়া শিখছে। স্যার অক্ষর ভেঙে ভেঙে বুঝাচ্ছেন। বুঝাতে বুঝাতে স্যার হঠাৎ খেয়াল করলেন, আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভদ্র ছাত্র বোম বারবার মাঠের দিকে তাকাচ্ছে। মাঠের মধ্যে একটা কুমির সাইকেল চালাচ্ছে, সে তাই দেখছে। স্যার ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ বোমের দু’চোখে দু’আঙুল ঢুকিয়ে চোখ দুটো বের করে ফেললেন এবং সেগুলো রেখে দিলেন পাশে। স্কুল ছুটি হওয়ার আগ পর্যন্ত চোখ দুটো ওখানেই থাকবে। ক্লাস শেষে চোখ দুটো আবার যথাস্থানে বসিয়ে দেওয়া হবে।

হঠাৎ ভীষণ শব্দ হলো। কামানের শব্দ। মারামারি শুরু হয়ে গেছে। বেশ কয়েক দিন হলো কথা কাটাকাটি চলছিল দু’দল ছাত্রদের মধ্যে। হয়তো তারাই এটা শুরু করেছে। কোথায় যেন একটা মিসাইল পরল। সঙ্গে সঙ্গে সকল ছাত্র তাদের কলমগুলো পকেট থেকে হাতে নিল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কলমগুলো এক একটা মেশিনগানে রূপান্তরিত হলো। ডান দিক থেকে এক ঝাঁকগুলি এসে একজনের মাথার খুলিটা উড়িয়ে নিয়ে গেল; কিন্তু তার আগেই সে ওই উড়ন্ত খুলিটা গপ করে ধরে যথাস্থানে অর্থাৎ নিজের মাথায় বসিয়ে দিল।

তারপরই আমরা সকলে মিলে এক সঙ্গে গুলি ছুড়তে লাগলাম। পাশে চিৎকার করে উঠল কে যেন। চেয়ে দেখি একনজরে পেট থেকে ভুড়িটা বের হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাশ থেকে আর একজন দৌড়ে এসে ভুড়িটা বেশ কায়দা করে তার পেটে ঢুকিয়ে টেনে ধরে সেলাই করে দিল চামড়াটা। চৌদ্দ ঘণ্টার এই যুদ্ধে মারা গেল প্রায় তিন কোটি ছাত্র। ফলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো স্কুল।

স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বাবা বলল, ‘কাজের কথাটা মনে আছে তো?’

‘হ্যাঁ’, মাথাটা একদিকে কাত করে বললাম, ‘খাবার দাও। বিকেলে আবার ক্রিকেট খেলা আছে।’

বাবা আর আমি এক সঙ্গে খেতে বসলাম। বাবা তার প্লেটে পনেরোটি হাতি ভাজা আর নয়টি গ-ারের রোস্ট নিল। দুপুরে আমি একটু বেশি খাই। ছয়শ’ মহিষ ভুনা, বাইশটি হাতি ভাজা, তেরোটি গণ্ডারের রোস্ট, সঙ্গে উনিশ মণ চালের ভাত খেতে খেতে প্রায় তিন সেকেন্ড সময় চলে গেল। 

দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই আমার। তবুও বিছানায় একটু পিঠ ঠেকালাম। গড়াগড়ি করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। দ্রুত ড্রেস আপ হয়ে মাঠে গিয়ে দেখি, বিশ্ব দলের বিশ্বসেরা খেলোয়াড়গুলো এসে গেছে। আমাদের খেলোয়াড়রাও এসে গেছে। খেলা শুরু হয়ে গেল ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। প্রথমে ব্যাটিং করে আমরা মাত্র এক উইকেট হারিয়ে তিন লক্ষ ঊনত্রিশ হাজার রান করে ফেললাম। এরপর ওরা ব্যাটিং শুরু করল। আমাদের খেলোয়াড়দের মারমুখী বোলিংয়ে ওরা সব কয়টি উইকেট হারিয়ে বিদায় নিল মাত্র তের রান করে।

এ খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সকল খেলোয়াড়ের জন্য পৃথিবীর সমস্ত দেশের রাজধানীতে জনপ্রতি একটা করে বাড়ি করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমাদের প্রত্যেককে তিন হাজার কোটি টাকা করে প্রদান করার কথা ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী। যোগাযোগমন্ত্রী প্রত্যেককে একটি করে প্লেন আর একটি করে রেলগাড়ী দেবার জন্য হুকুম দিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে। বিরোধী দলের প্রধান নেত্রী আজীবন প্রতিদিন প্রত্যেককে আশি মণ করে গরুর দুধ সরবরাহ করা কথা সমস্ত সাংবাদিককে জানিয়ে দিলেন।

এদিকে বিজয় মিছিলের জন্য শতশত কোটি মানুষ আমাদের ঘিরে ধরেছে আর রঙ ছিটাচ্ছে। যে যাকে যেভাবে পারছে রঙ দিচ্ছে। কে যেন আমার দু’চোখের মধ্যে এক বালতি রঙ ঢেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের সব কিছু লাল হয়ে গেল আমার। গাছের পাতা লাল, আকাশ লাল, মাটি লাল, মাথার চুল লাল, সব লাল। শেষে খবর পাওয়া গেল, আনন্দে প্রায় দেড় কোটি লোক মারা গেছে। এই শোক সংবাদের মাঝেও দেশের সমস্ত মানুষ আমাদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করল। সবাই আনন্দে এত মশগুল, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীও আনন্দ করছেন। এরই মাঝে উভয়ে ঘোষণা করলেন, দেশের স্বার্থে উভয় উভয়কে পারস্পরিক সাহায্য করবেন।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত। বাবা চুলার পাশে বসে আছে। রাঁধছে। আকাশে মাত্র একটা চাঁদ উঠেছে। তাও মেঘের আড়ালে ঢেকে আছে। তাই অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। বাবা পাতিলের ভেতর কি যেন দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পেল না মনে হয়। আশপাশে তাকিয়ে কোনো কিছু খুঁজে না পেয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটাকে খুলে এনে পাতিলের সামনে ধরে তার আলোতে পাতিলের ভেতর দেখে নিল। সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে আমিও দেখে নিলাম। বাবা বাঘের দো পেঁয়াজা রাঁধছে।

 চার সেকেন্ডের মধ্যে খাওয়া শেষ করে ঘরের বাইরে এলাম। রাতে খাওয়ার পর আমি একটু হাঁটি। সমস্ত পৃথিবীর চারপাশটা একবার ঘুরে আসি। তাতে খাওয়াটা বেশ হজম হয়।

আকাশে সাতটি চাঁদের সবগুলো উঠে পরেছে। বেশ আলো হয়েছে চারদিকে। নৈশ ভ্রমণটা সেরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাবা প্রায় দৌড়ে এলো।

‘সর্বনাশ, তাড়াতাড়ি ওপরের ঘরে চল।’

বাবা আমাকে টানতে টানতে ওপরের ঘরে নিয়ে গেল। সারা ঘর দুর্গন্ধে ভরে গেছে। কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া চারদিকে। অল্প অল্প অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাবা হঠাৎ ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। সঙ্গে বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠলাম। সাদা কাফনের মতো কাপড় পড়ে এক মহিলা মাকে জাপটে ধরে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। মা অসাড় হয়ে পড়ে রয়েছে। মহিলার সারা গায়ে দগদগে ঘা, শরীরের বেশ কিছু মাংস খসে গেছে। 

বাবাকে আমি চিৎকার করে বললাম, ‘একি বাবা!’

‘তোর মা।’

‘মা? মাতো মারা গেছে।’

হি হি করে হাসতে হাসতে মহিলা বলল, ‘খোকা, ক্যামন আছিস?’

ভয়ে ভয়ে আমি মহিলার দিকে সরাসরি তাকালাম, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম আবার। আমার আসল মা বসে আছে, হাসছে।

আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, ‘মা তুমি!’

‘হ্যাঁ, খোকা।’

‘তুমি তো মরে গেছ এবং তোমাকে তো কবর দেওয়া হয়েছে।’

‘ঠিক বলেছিস খোকা; কিন্তু কবর থেকে আমি দেখতে পেলাম, তোর বাবা এই মহিলাটিকে বিয়ে করল, যাকে তুই সৎমা ডাকতিস। ভালো কথা, একজন পুরুষ মানুষ প্রয়োজন পরলে বিয়ে করতেই পারে; কিন্তু এই মহিলাকে দেখতাম, সে তোর বাবার কোনো সেবা করতই না। শুধু বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াত, অন্য পুরুষের সঙ্গে মিশত। আমার সহ্য হলো না খোকা। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কবর থেকে উঠে এলাম।’

‘তুমি কবে এসেছ?’

‘গতকাল রাত্রে।

‘ও, তাই বুঝি বাবা ভয় পেয়ে আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু এখন আর কোনো ভয় নাই। একজন মৃত মানুষ যদি কোনো জীবিত মানুষের মাংস কামড়ে খাওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে সে পুনরায় জীবিত হতে পারে। আমি সে সুযোগ পেয়েছি এবং জীবন ফিরে পেয়েছি। এবার আমার বুকে আয় খোকা। কতদিন তোকে আদর করি না।’

আস্তে আস্তে আমি মার কাছে এগিয়ে গেলাম। মা আমাকে জাপটে ধরে দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে আদর করতে লাগল। আদর করতে করতে মা হঠাৎ প্রচণ্ড হাসি দিয়ে বলল, ‘খোকা, আর একজন জীবিত মানুষ কামড়ে খেতে পারলে অমরত্ব লাভ করা যাবে। বলত খোকা, এবার কাকে খাই?’

ঝট করে আমি মার দিকে তাকালাম। মার দু’ঠোটের মাঝ দিয়ে দুটো লম্বা দাঁত বের হয়ে এসেছে। আস্তে আস্তে সেটা এগিয়ে আসছে আমার গলার দিকে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫