Logo
×

Follow Us

গল্প

হারিয়ে যাওয়ার আগে

Icon

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২১, ১৫:৪১

হারিয়ে যাওয়ার আগে

প্রতীকী ছবি

আম-আদার ঝোপ পেরিয়ে নারিকেল গাছের গা থেকে উঁকি দেওয়া কাঠঠোকরার ডেরাটার সামনে গিয়েও থমকে দাঁড়াই আমি। হাত ঢুকাব? কাঠঠোকরার বদলে যদি সাপ শুয়ে থাকে গা গুটিয়ে! আমার দোমনা ভাবের পাশে ঝোপ থেকে ভেসে আসা কী সুন্দর মিহি সুঘ্রাণ দুলতে থাকে। মনে হয় এখানেই শুয়ে পড়ি টান হয়ে; কিন্তু দিনকাল ভালো না, এই তো গেল পরশু সকাল-সকাল হাকিম ফকিরকে গান গাইতে শুনলাম, ‘আইসা গেল কলিকাল/ভেড়ায় চাটে বাঘের ছাল/আইসা গেল পঙ্গপাল/পশ্চিম আকাশ টালমাটাল’,- তারপর ঘণ্টাখানেকও যায় নাই, দীপা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে খবর দিলো, রাজাকাররা নাকি সেই ফকিরকে পেটাতে পেটাতে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। বাবাজীদের নাকি মনে হয়েছে, হাকিম ফকির তাদের নিয়েই ওই গান ফেঁদেছে। 

এই চার লাইনের গানের মধ্যে বাবাজীরা এলো কোত্থেকে, বুঝতে পারি না। হাকিম ফকিরের কথাবার্তা অবশ্য খুবই জটিল। নয়ন চাচা বলে, কখন যে সে মারফতি লাইনে চলে, কখনই বা আবার শরীয়তি পথ ধরে, বোঝা মুশকিল। মারফতি আর শরীয়তির ব্যাপার-স্যাপার আমিও বুঝি না অবশ্য। তবে বুঝিয়ে দিলে হয়তো বুঝতে পারি; কিন্তু কার অত ঠেকা পড়েছে আমাকে এইসব বোঝানোর। এই তো বেশি দিন হয় নাই, আমাকে একটা খনার বচন শিখিয়েছে ফকির দাদা- ‘ চৈতে কুয়া, ভাদ্রে বান, নরের মুণ্ডু গড়াগড়ি যান’। বেশিক্ষণ লাগে নাই, তিন-চার মিনিটেই ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে আমার, ‘চৈতে কুয়া ভাদ্রে বান, নরের মুণ্ডু গড়াগড়ি যান’। বেশ মজাই লাগে বার বার বলতে; কিন্তু এটা কেমন কথা, এর মানেই বা কী, বুঝতে পারি না ভালো করে! ১১টা গেঞ্জি, সোয়েটার, পাঞ্জাবি, শার্ট গায়ে চাপানো ফকির দাদা হো হো করে হাসে, ‘অ্যার মানে বোঝো না? টাউনে থাকো, না?’ বলে ধপ করে বসে পড়ে কাছারি ঘরের বারান্দার বেঞ্চের ওপরে- ‘কুয়া’ চেনো না? চে-এ-নো না? কয়টা পর্যন্ত ঘুমাও নবাবের বেটা, সকালে ওঠো না তুমি?’

‘উঠি তো!’

‘তাহলি? মনে নাই, এই চৈতমাসে সকালবেলা আকাশ-বাতাস কেব্যা হয়্যা থাইকছে? কেব্যা কুয়া পড়া, নেওরে ভরা?’

‘ও-ও-ও...কুয়াশার কথা বলছেন?’

‘হ হ, কুয়াশা, কুয়াশা... শালার ভদ্দরলোকের বাচ্চা, কুয়া চেনে না, কুয়াশা চেনে! দেখছিস, তো এইবার চৈত মাসে কেমন নেওর পড়িছে? সামনের ভাদ্দর মাসে যদি দেখিস বান আইছে, তাইলে বুঝবি সারাদ্যাশে নরমুণ্ডু গড়াগড়ি খাইব। যেহানে যাবি, সেহানেই নরমুণ্ডু... নরমুণ্ডু চিনিস তো?...’ - ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে গলাকাটার ভঙ্গি করার পর চুল ধরে কাটামাথা ধরে রাখার ভঙ্গিসমেত আমার দিকে তাকিয়েছিল হাকিম ফকির। শিউরে উঠে চলে এসেছিলাম বাড়ির ভেতর। বাবাজিরা যা শুরু করেছে, তাতে তো এখনই সবখানে নরমুণ্ডু গড়াগড়ি দিচ্ছে, নতুন করে কি সামনের ভাদ্রে বান হওয়ার দরকার আছে আর!

রাজাকারদের ‘বাবাজি’ বলে আমাদের নয়ন চাচা। বড় চাচা অবশ্য বলে, ‘বেশি বাড়িস না। এখন পর্যন্ত তো গাঁয়ের মধ্যে ঢোকে নাই, তাই টের পাচ্ছিস না,- আসলে পরে বুঝবি কয়দিন যায়।’ তা গাঁয়ের মধ্যে না আসুক, আমাদের বাড়ি থেকে সিকি মাইল দূরের লম্বা সড়ক দিয়ে একদিন যেতে দেখা গেছে খানসেনাদের। ওই সড়ক দিয়ে টাউনেও যাওয়া যায়। যদিও পোষায় না। আড়াই ঘণ্টা খরচ করে ওই রাস্তা দিয়ে টাউনে যাওয়ার কোনো মানে আছে? যেখানে ক্ষেতের মধ্যে নেমে আইলপথ দিয়ে হাঁটা ধরলেই পৌঁছানো যায় বড়জোর এক ঘণ্টায়! কিন্তু খানসেনারা কি আর চড়া বরাবর হাঁটতে পারে? তাই লম্বা সড়কটাতেই দেখা গেছে তাদের। একটা জিপগাড়িতে করে আসছিল খানসেনারা, বসেছিল চোয়াল শক্ত করে। আর তাদের ঘিরে কয়েকজন রাজাকার হাঁটতে হাঁটতে মিছিল করে এগোচ্ছিল হাটের দিকে। খানসেনাগুলোকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে পাশের বাড়ির মোতাহার আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ‘দেখ, চোপা কেমন শক্ত কইরা আছে। মনে কয়, খুব হাগা পাইছে, কষ্ট কইরা চাপায়া রাখছে!’ এর খানিক বাদেই অনেক লোকজনের সোরগোল আর চিৎকার শুনতে পাই আমরা। শুনতে পাই বেশ কিছু হাঁস-মুরগির ডাক। তারপর কয়েকটা গুলির শব্দও ভেসে আসে। তখন অনেক দূরে থেকেও আমরা বুঝতে পারি, খানসেনারা হাটে গিয়ে খুনোখুনি আর লুটপাট করছে। বড় চাচা কিংবা আব্বা অবশ্য এসব ব্যাপার আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে; কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না, কোনো না কোনোভাবে এসব ঘটনা ঠিকই পেয়ে যাই আমরা। আসলে বড়রা বোঝে না, তারা যেমন একজন আরেকজনের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে এটা-ওটা বলে, আমরা ছোটরা তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশিই বলি আর এইভাবে মুহূর্তে গাঁয়ের একদিকের কথা আরেকদিকে চালান হয়ে যায়। তো এইভাবে আমি এর-ওর কাছ থেকে যতটা শুনেছি আর নয়ন চাচাও যেরকম বলেছে, তাতে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত, বাবাজিরা বড়ই ভয়ংকর। যখন যে গাঁয়ে যায়, তখন সেই গাঁয়ের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সবই বেছে বেছে ধরে নিয়ে যায় তারা। নয়ন চাচা আমাকে কাল রাতেও হুমকি দিয়েছে, ‘তোর জানে ভয়-ডর নাই? জানিস, বাবাজিদের ভয়ে এখন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিজেরাই সাবধান থাকে? বাবাজিদের পায়ের শব্দ শুনলেই দৌড়ে সব গাছে উঠে লুকায়?’

আমি টের পাই, শহর ছেড়ে গাঁয়ে এসে পালিয়ে আছি বলে নয়ন চাচা আমাকে বাজিয়ে দেখছে। তা বাজাতেই পারে-নয়ন চাচা ঘুঘু দেখেছে, ঘুঘুর ফাঁদও দেখেছে-তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই; কিন্তু আমার বয়সও তো কম হলো না- নয় পেরিয়ে দশে পড়েছে এবার, মায়ের কঠিন ব্যাকরণের ভাষায় যাকে বলে এক দশকে পদার্পণ করে এবার চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেছি আমি। চাচা শুধু ঘুঘু আর ঘুঘুর ফাঁদই দেখেছে, আমার মতো তার এই কথা জানা নাই, শহরের মানুষজন ঘুঘু ধরার জন্য কষ্ট করে আর ফাঁদ পাতে না-সোজা ঝেড়ে ফেলে এয়ারগান চালিয়ে। তাই অলস গলায় টিপ্পনি কাটি আমি, ‘আর গরু-ছাগলগুলো তখন ভয়ের চোটে কোথায় পালায় চাচা?’

নয়ন চাচাকে একটুও ভড়কানো যায় না। অম্লান মুখে বলে সে, ‘গরু-ছাগলগুলো? সেগুলো তো তোদের ওই ঘসিঘরটার মধ্যে গিয়ে ওঠে।’

ঘসিঘরে ওঠা অবশ্য অত সহজ না। মাটি থেকে খানিকটা উঁচুতে বাঁশের মাচার ওপর বানানো ওই ঘরে উঠতে গেলে আমার আত্মা উড়ে যায়। আর সেজন্যই বোধহয় নয়ন চাচা বার বার কথায় কথায় ঘসিঘরের দিকেই এগিয়ে যায়। শুকনো গোবরের গন্ধ ঢেউ তুলেই মিলিয়ে যায়। তবে কথা সেটা না,- কথা হলো হাকিম ফকিরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমি স্পষ্ট শুনেছি, নয়ন চাচা গিয়ে আব্বার কাছে নিচু কিন্তু পরিষ্কার কণ্ঠে বলছে, ‘গান তো হাকিম ভালোই বান্ধিছে... ভেড়ায় চাটে বাঘের ছাল...’। বলেই হো হো করে হাসতে শুরু করেছে নয়ন চাচা; কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে অনেকটা রূঢ়কণ্ঠেই বলেছে বাবা, ‘হাসিস না-সময় ভালো না-’

উত্তরে ‘কী মুশকিল, আপনেও দেখি বড় ভাইয়ের মতোই কথা বলেন’ বলতে বলতে নয়ন চাচা তখন তার ঘাড়টাকে চুলকাতে থাকে। আমি আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করি; কিন্তু তারা আর কিছুই বলে না দেখে চলে আসি সেখান থেকে।

এইটা ঠিক, দিনকাল কেমন পাল্টে গেছে,- গাঁও-গেরামে এসেও যখন-তখন দৌড়াতে দৌড়াতে বিলে গিয়ে ইংলিশ প্যান্টটা খুলেই ন্যাংটা হয়ে ঝাঁপ দেওয়া যায় না! শহর থেকে গাঁয়ে এসে তা হলে লাভ কী হলো বুঝতে পারি না। বুঝি না জন্যই কেন যেন মনে হয়, কাঠঠোকরার এই ডেরায় একটা সাপ ঢুকে ঝিম মেরে শুয়ে থাকতে পারে। আকাশ থেকে দিনকয় হলো যখনতখন বৃষ্টি পড়ে, সাপরা তাই শুকনো ডেরা খুঁজে বেড়াচ্ছে। গেল বছর ইলেকশনের সময় তো এরকম একটা ঘটনাও ঘটেছিল-তালেব চাচা পাখি ধরার জন্য গাছের ডেরায় হাত ঢুকিয়েই বিদ্যুৎগতিতে সরে এসেছিল। সাপে তাকে ঠোকর দিতে পারেনি বটে, কিন্তু তার ঠান্ডা-ঠান্ডা গায়ের ছোঁয়ায় চাচার এত ঘন জ্বর এলো যে, চার দিন চার রাত ধরে বার বার মাথা ধুইয়ে, হাতপা মুছে আর মাথায় জলপট্টি দিয়েও তা আর নামানো গেল না। শেষ পর্যন্ত সেই জ্বর নামল জাফর কম্পাউন্ডারের ইনজেকশনের ঠেলায়। তাও ভালো, তালেব চাচার তখন হুশ-জ্ঞান কিছু ছিল না। হুশ থাকলে ইনজেকশনের সুই দেখে লোকটা নির্ঘাৎ এমন চিৎকার জুড়ত যে, জাফর কম্পাউন্ডার নিশ্চয়ই দৌড়ে পালাত। তবে সাপের স্পর্শে তালেব চাচার মনে হয় বোধসোধ একটু কমেই গিয়েছিল-না হলে জ্বর নামার পরও কয়েক দিন ইনজেকশন দিতে দেয়!

জ্বর হওয়ার পর তালেব চাচা কত কী যে ভুলভাল বলল! আমাদের বাড়ি থেকেও সেসব স্পষ্ট শোনা গেল। আমরা পায়তারা করছিলাম, সুস্থ হয়ে উঠলে তালেব চাচাকে আমরা ওইসব কথা বলে খেপাবো। তার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দৌড় দিয়ে পালাতে পালাতে বলব, ‘লতিফা- লতিফা- তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না লতিফা। ... কামকরুনি হলেও আমি তোকেই বিয়ে করব লতিফা!... আচ্ছা, বিয়ে না বসলি, সন্ধ্যার পর বাড়ির পিছের বাঁশবাগানে আসিস...।’ অথচ মা কেমন করে এসব আন্দাজ করে আমাকে আর মোতাহারকে, এমনকি রূপাকেও কড়া কণ্ঠে বলে দিল, এইসব কথাবার্তা নাকি ভুলে যাওয়াই ভালো। অতএব, আমরা আর মনে রাখি নাই। মানে, মনে আছে-কিন্তু মনে রাখি নাই। চোখের সামনে এরকম অনেক কিছুই ঘটে, যা মনে না রাখলেও মনে থেকে যায়। তাছাড়া আব্বার ছুটি তখন ফুরিয়ে এসেছিল, আমাদের স্কুলও খুলি-খুলি করছিল। ঢাকা থেকে সেবার চাচা-চাচি এলেও দীপাদের কেউই আসে নাই। মা সে কথা তুলতেই বড় চাচা বলেছিল, ‘ভোট দিতে আসছি, একদিনের বেশি তো থাকার সুযোগ নাই বউমা-ওদের আর টানাটানি করে কী লাভ?’ এই কথা বলে চাচা পুরো মামলাই ডিশমিশ করে দিয়েছিল আর ভোট দিয়ে পরদিনই ফের রওনা হয়েছিল ঢাকার দিকে। তখন বাড়িটা আরও ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। বড় চাচাদের কেউ নাই, নয়ন চাচাদের কোনো ছেলেমেয়ে হয় নাই আর আব্বা আবার ভারী ব্যস্ত গাঁয়ের লোকজনদের খবরের কাগজ পড়ে শোনাতে। দাদা-দাদি মরে যাওয়ার পর এরকম নানা কারণে আমাদের এই বাড়িটা আরও বেশি খাঁ খাঁ করে। নয়ন চাচার কাছে নৌকা মার্কার কাজের জন্য এত লোকজন আসে-তারপরও মনে হয় এই বাড়িঘর ফাঁকা পড়ে আছে। নারিকেলের এমন কোনো শক্ত খোলও খুঁজে পাই না যে, ডিঙি বানিয়ে রূপাকে বসিয়ে টেনে বেড়াব সারা বাড়ি। এমন ফাঁকা বাড়িতে আর ভালো লাগে না। 

মাসখানেক আগে, গরম যখন এখানে-ওখানে বুকডন দিচ্ছে আর লোকজনের জিভ তাতে উশখুশ করছে কুকুরের জিভের মতো, বাবা তখন একদিন আমাদের দুম করে গ্রামে নিয়ে আসে। এত আচানক সেই ঘটনাটা ঘটে যে, অবাক হওয়ারও সুযোগ হয় না আমাদের। কারফিউ তুলে নেয়া হয়েছে সেদিন জুমাবারে, জুমার নামাজের পর পাকিস্তানের মঙ্গলকামনায় খোদার কাছে দোয়াদরুদ পড়া হবে বলে। পাড়ার সবাইকে তাই মসজিদে যেতে হবে। আব্বাকে দেখলাম উকিল চাচার সঙ্গে যাচ্ছে হাসতে হাসতে আতর আর সুরমা মেখে বড় মসজিদে; কিন্তু কী আশ্চর্য-মিনিট পাঁচেকও যায় নাই, ফিরে এলো বাবা ঊর্ধ্বশ্বাসে। ‘বোচকাগুলো ভ্যানে তোলো’- বাবার এ কথা শুনে অবাক হয়ে দেখলাম মনিহারিপট্টির ভ্যানওয়ালা ওয়াজেদ বাড়ির সামনে ছোট বাগানটায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগেই তাকে দেখেছিলাম মোড়ের ওপর বসে বসে দুই পয়সা দামের বরফ খাচ্ছে আয়েশ করে। আমরা অবাক হলেও মা কিন্তু অবাক হলো না; দেখলাম কোত্থেকে সব বোচকাবাচকি এনে দ্রুত তুলে দিচ্ছে সে ভ্যানগাড়িতে। আমরাও হাত লাগালাম তাতে। ‘সোজা সড়ক ধরে চলে যাবা, আমরা কিন্তু তোমার আগেই বাড়ি পৌঁছে যাব’- এই বলে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে তাকে বিদায় করে দিলো মা। তারপর আমাদের দু’জনকে দুই হাতে আঁকড়ে রওনা হলো আব্বার পিছে পিছে। শহরের মধ্যে থেকে যখন আমরা বের হচ্ছি, রাস্তায় তখন মানুষজন নেই বললেই চলে। মাইকে শোনা যাচ্ছে মসজিদের ইমামের উচ্চস্বর- মুক্তিযোদ্ধাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে সে বলছে, ‘মুজিব দেশের শত্রু, মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের দুষ্কৃতকারী,- এরা সব দেশের শত্রু, ইসলামের শত্রু, এরা সব দোযখে যাবে। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের সহায় হও, তুমি পাকিস্তানকে রক্ষা কর আল্লা।’ এমন জ্ঞানের কথা, একটু মন দিয়ে শুনব, কিন্তু তেমন কপাল কই,- কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা ঠেলতে ঠেলতে আমাদের নিয়ে আসে শহরের বাইরে। তার পর রাস্তার পাড় থেকে গড়ানের ওপর দিয়ে আমাকে আর রূপাকে ধাক্কা দিয়ে বলতে গেলে ফুটবলের মতো করে নিচের ধানের ক্ষেতে ঠেলে দেয়। চরার মধ্যে দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি আর মা অযথাই বলে বার বার, ‘তাড়াতাড়ি হাঁট বাবা, তাড়াতাড়ি হাঁট।’

‘কেন মা, কী হয়েছে? আমরা চলে যাচ্ছি কেন?’

‘আগে একটু রাস্তা পাড়ি দেই বাপ, তারপর শুনিস। এখন একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে আয় বাপ। দেখ, তোর আব্বা কতদূর চলে গেছে!’ 

তা ঠিক, আব্বা তখন চলে গেছে অনেক-অনেক দূর; কিন্তু আশ্চর্য,- এর চেয়ে আর কত জোরে হাঁটব আমরা? আর হাঁটবই বা কেন? মাকে সকালবেলা গরুর মাংস রান্না করতে দেখেছি অনেক দিন পরে, সঙ্গে খিচুড়িও রেঁধেছে। পাশের বাসা থেকে উকিল চাচি পর্যন্ত বলেছে, ‘আহ্, কী সুন্দর ঘ্রাণ বেরিয়েছে।’ অথচ সেসব খাওয়া বাদ দিয়ে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, তাই জানি না! 

খড়বড়ে আলপথ আর ক্ষেতভর্তি ধানের মুথার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলি আমরা। এরকম ঝামেলার রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করা সহজ না; কিন্তু আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। আর অভ্যাস হয়ে গেলে এসব আর খারাপ লাগে না। আমার আর রূপার গ্রামে যাওয়া-আসা অবশ্য কেবল আম-কাঁঠালের ছুটিতে, রোজা আর শীতের দিনগুলোতে; কিন্তু আব্বা আসে- বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহেই আসে। প্রতি সপ্তাহে না পারুক, ১৫ দিন পর একবার অবশ্যই আসে। জমিজমা আছে, চাষবাস আছে, আবার দীপার বাবা মানে বড় চাচাও নানা রকম ফাইফরমায়েশ দেয়। নয়ন চাচা বাড়িতেই থাকে; কিন্তু তার ওপর বড় চাচা ঠিক অত ভরসা করতে পারে না। প্রতি সপ্তাহেই ঢাকা থেকে একটা না একটা পোস্টকার্ড আসে বড় চাচার কাছ থেকে নানা কাজের ফিরিস্তি দিয়ে। খামে কয়েক আনা বেশি লাগে বলে বড় চাচা পোস্টকার্ডেই চিঠি লেখে; আর পিওন পোস্টকার্ড দিয়ে গেলে অয়ন ভাই সেটাকে জোরে জোরে পড়তে থাকে। তা শুনে মা আস্তে পড়তে বললে অয়ন ভাই উত্তর দেয়, ‘সমস্যা কী মা? পোস্টমাস্টার, পিওন সবাই তো পড়ে ফেলেছে- পাড়াপ্রতিবেশী শুনলে আর সমস্যা কী!’ তবে আব্বার এসব কথা গায়ে লাগে না, গাঁয়ে যেতে তার বোধ হয় ভালোই লাগে- ‘যাই, দেখে আসি, রহমত বড় ভাইয়ের খেতখোলার কাজকর্ম ঠিকমতো করছে কি না’- পোস্টকার্ড দেখাতে দেখাতে একটা না একটা অজুহাত বানিয়ে বাবা প্রায়ই শনিবার বিকেল, না হয় রোববার সকালে রওনা হয় গ্রামের দিকে। আর মা-ও কখনো কখনো যায় তার সঙ্গে,- গরুর গাড়ি কিংবা আমাদের তিন ভাইবোনকে ছাড়াই পায়ে হেঁটে চরা বরাবর মেঠোপথ দিয়ে। বাবার সঙ্গে সকালে গিয়ে সন্ধ্যার আগেই শহরে ফিরে আসে টাটকা তরিতরকারি নিয়ে হাসি ঝলমল মুখে। 

তা হাঁটতেও পারে মা! গ্রামের বাড়িতে দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা কি আর মুখের কথা! তারপরও মুখে থাকে হাসি; কিন্তু এবার সেই যে গ্রামে এলাম, আসার পরও ফের মাস দেড়েক পেরিয়ে গেল, কিন্তু মার মুখে কোনো হাসি নাই। কেন যে নাই, সেটা অবশ্য আমরা ভালো করেই জানি। শহর থেকে চলে আসার সেই দিন দিকশূন্য ক্ষেতখোলার মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে থেমেছিল মা আর বাবা, তারপর প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল, কাউকেই বলব না এইভাবে চলে আসার কথা, বলব না অয়ন ভাই যুদ্ধে গেছে, বলব না উকিল চাচাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছি আমরা সবাই, বলব না বাড়ির কাছের শান্তি কমিটির ওই ধেড়ে শয়তানটা প্রতিদিনই অয়ন ভায়ের খোঁজ নিতে শুরু করেছিল বাবার কাছে। আমরা বরং বলব, শহরে তো সব কিছু বন্ধ, তাই গ্রামেই থাকতে এসেছি; আমরা বরং বলব, অয়ন ভাই আমাদের শহরের বাড়িতেই আছে; আমরা বরং বলব, শহরের পরিস্থিতি কিন্তু তত ভালো না, অয়ন ভাইকে আমরা বলে এসেছি, অবস্থা খারাপ দেখলে বাসা থেকে উধাও হয়ে যেতে। অয়ন ভাইয়ের যুদ্ধে যাওয়ার কথা কাউকে যে বলা যাবে না, সেটা অবশ্য আমরা অনেক আগেই জেনেছি; আর তা ছাড়াও জেনেছি যে, এই গোপন কথাটা খুব বেশিদিন গোপন রাখা যাবে না, কেউ না কেউ হঠাৎ করেই জেনে ফেলবে; কিন্তু গ্রামে আসতে আসতে বুঝতে পারি, অয়ন ভাইয়ের যুদ্ধে যাওয়ার কথা গোপন না থাকার দিন ঘনিয়ে আসছে। অয়ন ভাই যুদ্ধে যাওয়ায় একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, আমার ইংরেজি আর অংক পড়া দেখার কেউই নেই আর; কিন্তু তাতে লাভ কী, গ্রামে এসেও তো ঠিকমতো ঘুরতে পারছি না। গ্রামে এসেও যদি ঘরেই থাকতে হয়, তা হলে এ আসার কোনো মানে হয়!

তবে ঘটনা হলো, একটা পাখি ধরা দরকার। খাঁচায় রাখার জন্য না, খাওয়ার জন্যও না,- দীপাকে খালি একটু দেখানোর জন্য; দেখিয়েই সেটাকে আবার আকাশে উড়িয়ে দেব। পরশু নিশ্চয়ই দীপাকে শনিতে পেয়েছিল। নইলে কি আর হাকিম ফকিরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর আমাকে দিতে আসে! অবশ্য খবরটা দিয়েই হুড়মুড়িয়ে সরে গিয়েছিল আর সরে যেতে যেতে সারা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল রাজ্যের আটুল বাটুল শ্যামলা সাটুল অহংকার। আমি বুঝতে পারি না, এত ভাব দেখানোর কী আছে! শহরে কি খালি দীপারাই থাকে? আমরাও তো শহরেই থাকি। থাকি না? দীপারা না হয় ওই ঢাকায় থাকে-কিন্তু তাতে কী? ঢাকাতেই থাকুক আর করাচিতেই থাকুক, খানসেনাদের ধাওয়া খেয়ে তো আমাদের মতোই চলে আসতে হয়েছে! তাহলে? দেমাগ দেখানোর কথা তো বরং আমার, আমি এখন কত সহজে গাছে চড়তে শিখেছি! মা-ও আর ভয় পায় না গাছে চড়ছি দেখে। কালকে তো একটা কাঁঠালই পেড়ে দিলাম ছোট চাচিকে। জামগাছে চড়তে অবশ্য এখনো একটু ভয়ই লাগে; কিন্তু সমস্যা নাই, দীপার জাম খাওয়ার ইচ্ছা হলে নিশ্চয়ই চড়তে পারব। অথচ দীপাকেই এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। খালি দীপা কেন, রীপা আপা, নীপা আপা-সবাই এবার সারাক্ষণ মরা সাপের মতো ঘরের মধ্যে ছোলং পাল্টাচ্ছে। বড় চাচা-চাচিও যেন কেমন, ওদের একটু খোঁজাখুঁজি করলেই কেমন তেরচা চোখে তাকিয়ে থাকে। আর সুযোগ পেলেই দীপার মা আমার মায়ের কাছে এসে গল্প ফাঁদে, আসার সময় কত কষ্ট হয়েছে! এমন ভাব, আমাদের পালিয়ে আসার সময় কষ্ট হয় নাই, মা আইলপথে ধপাস করে আছাড় খায় নাই! এদিকে দীপার বড় ভাইটা খালি ঘুমায়, খালি ঘুমায়। অয়ন ভাইয়ের চেয়েও তিন বছরের বড় সালাম ভাই-এত বড় একটা মানুষ যুদ্ধে যাওয়া বাদ দিয়ে ঘরের মধ্যে কি না লাশ হয়ে পড়ে থাকে! আচ্ছা, ঠিক আছে, যুদ্ধে না হয় যায় নাই,- গাছে উঠে দু’চারটে আম-কাঁঠালও তো খেতে পারে, ঝাঁকি দিয়ে বোনদের জন্য ফেলতে পারে! তার বদলে টিকটিকি ডাকলেও কেমন করে লাফ মেরে ওঠে! এইসব কথা বলার জন্য ২৪ ঘণ্টাই আমার গলার মধ্যে সুড়বুড়ি খেলে- কিন্তু মা মানা করে দিয়েছে জন্য কিছুই বলতে পারি না। 

যাক গে, যার যা খুশি করুক। আমার কী! হঠাৎ করেই পাখির বাসা খুঁজতে আমার আর ভালো লাগে না। মনে হয়, এত বড় একটা বাড়ি- কেমন একটা কবরস্থান হয়ে গেছে এখন! এমন না যে, বাড়িতে কেউ নাই। অয়ন ভাই আর দীপার বিয়ে হয়ে যাওয়া দুই বোন ছাড়া তো সবাই-ই আছে এখন; তারপরও বাড়িটায় কবরস্থানের ভয় আর নির্জনতা। আব্বা-চাচারা সবাই মিলে তিন ভাই, চার বোন। ফুফুরা এখন এ বাড়িতে খুব কমই আসে-সারা বছর থাকার মতো কেবল ওই নয়ন চাচা; কিন্তু সেও তো প্রতি বছর শীতের সময় যাত্রার দলে চলে যায়। খালি কি শীত,- যাত্রার ঋতু শেষে নয়ন চাচা বাড়ি ফিরে আসতে না আসতেই কালবোশেখির ঝড় এসে বর্ষার গান গাইতে থাকে, চাচা তখন বিলের মধ্যে থেকে পানসী তুলে সেটার সেবাযত্নে লেগে যায়। এই যে ইলেকশন হলো, ‘তোমার আমার মার্কা, নৌকা মার্কা’, ‘মুজিব ভাইয়ের মার্কা, নৌকা মার্কা’, ‘জয় বাংলা’ এইসব বলতে বলতে চাচা যে কোন গাঁয়ে চলে গেল, কেউ-ই আর বলতে পারল না। শহরে থাকলেও বড় চাচা আর আব্বা তো গাঁয়েরই ভোটার, ভোট দিতে এসে তারা দেখে ঘরদোর আর চাষবাস সব সামলাতে গিয়ে চাচির এক কাহিল অবস্থা। 

এই যে বলা নেই, কওয়া নেই, নয়ন চাচা দুম করে উধাও হয়ে যায়, তা নিয়ে আব্বা আর বড় চাচা যত চিন্তাই করুক, আমার কিন্তু মনে হয় চাচির খুব গর্বই হয়। আব্বা তো ভোট দিতে এসে নয়ন চাচাকে বাড়িতে না দেখেই টের পেয়েছিল, নিশ্চয়ই নৌকা নৌকা করতে করতেই লাপাত্তা হয়ে গেছে; বড় চাচার কিন্তু কপালে লম্বা ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল, থমথমে গলায় বলেছিল, ‘নয়নকে দেখছি না বৌমা?’

‘আপনার ভায়ের কথা বলছেন ভাইজান? সে তো নৌকার কাজে গেছে।’ - উত্তর দিতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল ছোট চাচি; কিন্তু বড় চাচা আরও গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল, ‘নৌকার কাজে গেছে মানে? হাটে কোনো মিটিং আছে আজ?’

‘সে তো আজ ১৯ দিন হয় বাড়ি নাই ভাইজান। নৌকার কাজে- ’

বড় চাচা কিছু না বলে চলে গিয়েছিল। আমিও কি করি-কি করি ভেবে না পেয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াবো, ঠিক তখনই মা বলেছিল, ‘কই যাস রে?’

এমন লাগসই সুযোগ আমি হাতছাড়া করি নাই। সঙ্গে সঙ্গে ছোট চাচির মতো খুশি-খুশি গলায় জবাব দিয়েছিলাম, ‘নৌকার কাজে-’

সেই তো শুরু, সেই থেকে কাজে-অকাজে ‘নৌকার কাজে’ কথাটা বলার সুযোগ পারতপক্ষে আমি হাতছাড়া করি না। মা কিংবা রুপারাও না; কিন্তু দীপার সামনে একেবারে যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুলের মাপে এই কথাটা বলাই যাচ্ছে না। একদিন পাখি খুঁজে বেড়াই তো আরেক দিন আমগাছে উঠে বসে থাকি, একদিন মাছধরার ছিপ বানাই তো আরেক দিন বেহুদাই বসে থাকি। কোনো কোনো দিন অয়ন ভায়ের কথা খুব খুব মনে পড়ে, দারুণ ইংলিশ জানে অয়ন ভাই; কিন্তু অত ইংলিশ জেনে কী হবে, আশপাশের কেউই যখন ওসব কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না! এই যুদ্ধ ব্যাপারটাও ঠিক বুঝতে পারছি না; কিন্তু অয়ন ভাই যখন গেছে, তখন তা নিশ্চয়ই ভালো। ভালো... আর ইংলিশের মতোই কঠিন। সেজন্যই কি ঠিক বুঝতে পারছি না? শুধু একটু-একটু বুঝতে পারছি যে, যুদ্ধ না থামা পর্যন্ত এইভাবে পালিয়ে বেড়াতে হবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে। শহর থেকে যেমন এসেছি গ্রামে, গ্রাম থেকেও তেমনি হয়তো যেতে হবে অন্য কোনো গ্রামে। হয়তো আরও অনেক-অনেক পথ হাঁটতে হবে সেদিন। হাঁটতে হাঁটতে আবারও ভাবব সেদিনের হাঁটার কথা। শহর থেকে চরা বরাবর হাতড়ে-পাতড়ে গাঁয়ে আসতে আর কতক্ষণ লাগে! তবে মা সেদিন খুবই টেনশনে ছিল, তা ছাড়া গ্রীষ্মের রোদ বড় ছ্যাঁচড়া, খেতের মধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে সেই যে ভিটামিন ডি খাওয়াতে শুরু করল, তারপর আর কিছুতেই থামে না। বাধ্য হয়ে তাই বার বার আমাদেরই থামতে হচ্ছিল, তারপরও আমরা তো দুপুরে রওনা হয়ে বিকেলেই পৌঁছেছিলাম সেদিন; কিন্তু বড় চাচারা এসেছিল একেবারেই নেতানো অবস্থায়, তাও প্রায় মধ্যরাতে। একবার ভ্যানে, আরেকবার গরুর গাড়িতে, আরেকবার নৌকায়, তারপর ফের হেঁটে, এরকম কত রকম কায়দা করে বোচকাবাচকি নিয়ে বাড়ি আসতে তাদের চার দিন লেগে গেছে। এদিকে আমাদের ঘরদোর তো বলতে গেলে সারাবছরই পড়ে থাকে, নয়ন চাচারা যতটুকু সম্ভব দেখভাল করে, সপ্তাহান্তে বাড়িতে এলে বাবাও একটু-আধটু দেখাশুনা করে। প্রায় মধ্যরাতে এসে ঘরদোর ঝেড়ে নিজেদের থাকার মতো বিছানা পাততে গিয়ে বড় চাচির সর্দি লেগে গেল। সর্দি লাগার আগে আবার ঘরের মধ্যে একটা চামচিকা দেখে ধপাস করে আছাড়ও খেলো। মানুষজন আছাড় খেলে আমি আবার না হেসে পারি না। এত দুঃখের মধ্যেও তাই একটু চাপা হাসি দিয়ে ফেলি; কিন্তু মা কটমটে চোখে তাকিয়ে আছে দেখে সেই হাসিটাও অর্ধেক রাস্তায় থামিয়ে দিতে হয়; কিন্তু আমার না হয় থেমে গেল, দীপার হাসি আর কিছুতেই থামে না। পরের মেয়ে, মা তাকে তেমন কিছু বলতেও পারে না, খালি বলে, ‘এই থামো তো, এতে হাসির কী হলো? থামো তো দেখি...’ মা যত বলে দীপার হাসি তত বাড়ে। আর দীপা হাসলে কী হবে রীপা আপা আর নীপা আপা আবার আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যে, আমিই দীপাকে কাতুকুতু দিচ্ছি! আমার আর হাসি পায় না বটে, কিন্তু খুবই ইচ্ছে করে, আরও অনেক-অনেকক্ষণ ওকে হাসতে দেখি! 

কাজকর্ম নাই, আরেকদিন মায়ের গল্পগুচ্ছের মধ্যে ফাঁকতালে একটা গল্প পড়ে ফেলি আমি। একটু কষ্টই হয় অবশ্য, অক্ষরগুলো এত এত ছোট ছোট, মনে হয় কতদিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না! আর বাক্যগুলো আবার বড় বড়- পড়তে হয় ধৈর্য ধরে; কিন্তু আমার বয়সটা তো বোধহয় ওই গল্পের ফটিকেরই মতো। তাই একটু ভালোও লাগে। ধীরে ধীরে পড়ে ফেলি আর ভালো লাগে চিন্তা করতে যে, এই জন্যই কি মা-বাবা আমাকে আজকাল ঠিকমতো বুঝতে পারে না? বুঝতে পারে না, মা দেশের নামে আমাকে কোরবানি দিক বা না দিক আমারও এখন ভালোই ইচ্ছে করে, ভাইয়ের মতো যুদ্ধে চলে যেতে? এর মধ্যে অবশ্য একদিন দীপা আমার কথায় অনেক হেসেছে, কিন্তু হাসলে কী হবে, কথা তো বলে নাই একটাও! বড় চাচা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোথায় যাচ্ছিস রে?’ শুনে আমিও কায়দা করে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘নৌকার কাজে-’। তা দীপা নিশ্চয়ই এরমধ্যে রূপার কাছ থেকে ঘটনাটা শুনেছে। নইলে ওরকমভাবে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে কেন! কিন্তু যতই হাসুক, কথা তো বলে নাই! অতএব আমি খানিকক্ষণের মধ্যেই আবার ফটিক-ফটিক হয়ে গিয়েছিলাম। তবে দীপার বয়সও তো আমার মতোই, এক ক্লাস নিচে পড়ে মাত্র, আমার চেয়ে কতইবা ছোট হবে আর! মেয়েদের নাকি এই বয়সে আরও বোঝা যায় না, মা আর ছোট চাচি সেদিন গল্প করছিল, গাছে উঠে আম পাড়তে পাড়তে আমি শুনে ফেলেছি। সেইজন্যই কি আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, দীপা কেন এবার আগের মতো কথাবার্তা বলছে না আর! কিন্তু তা যাই হোক, একটা পাখিকে উড়ে যাওয়া দেখলে কি দীপা খুশি হবে না? কিংবা ধরা যাক, পাখির বাচ্চাই সেগুলো, দীপা কি খুশি হবে না, বাচ্চাগুলোর নরম তুলো-তুলো গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে, ‘ওদের ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এসো ভাইয়া’?

আমি দিনের পর দিন বাড়ির পিছের নারিকেল গাছ থেকে ছাতিম, পিতরাজ, আতা, কড়ুই থেকে শুরু করে কত পদের লতা, গুল্ম আর বেতের ঝাড়ের ফাঁকফোকড়েও ভালো করে উঁকি দিয়ে পাখির বাসা খুঁজে ফিরি। তা বাসা দু’চারটে আছে বটে, কিন্তু মনে হয় সবই শূন্য এখন। বর্ষা আসি-আসি করছে বলে বোধহয় আরও নিরাপদ ঘর বুনছে ওরা। একটা বোটকা ভয়ানক গন্ধ কানে এসে লাগলে মনে হয় কাছেই কোনো দুশ্চরিত্র বনবিড়াল আছে। এইসব জীবজন্তু কোথায় যে কী করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, ভাবতেই দম আটকে আসে; কিন্তু এখন আমার সেজন্য নয়-পাখি খুঁজে না পেয়েও নয়-এখন আমার বোধহয় খারাপ লাগছে বড় ভাইয়ের কথা ভেবে। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, এই যে দীপা ভালো করে কথা বলছে না, রূপা কিংবা মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বললেও কেমন আলগা-আলগা ভাব আর আব্বা ও নয়ন চাচার সঙ্গেও বড় চাচার কেমন গম্ভীর খিটিমিটি কথাবার্তা-এসবের সঙ্গে অয়ন ভাইয়ের যুদ্ধে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে। সেইদিন যে বড় চাচারা এলো অত রাতে, এসেই কিন্তু বড় চাচা প্রথমে খোঁজ করেছিল নয়ন চাচাকে। বড়-চাচার জেরার মুখে চুলার পাড়ে বসা ছোট চাচি ভীষণ বেজাড় মুখে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল, ‘কোনখানে আর যাবে-আছে, বাড়িতেই আছে।’

বোঝাই যাচ্ছিল, ছোট চাচির মনটা কোনো কারণে ভীষণ বেজাড়; কিন্তু বড় চাচার চোখে-মুখে, এমনকি কণ্ঠেও খুব নির্ভার এক স্বস্তি ফুটে উঠেছিল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্ বৌমা... আমি তো ভাবছিলাম...ওর তো আর আক্কেল নাই... তা যাক, বাড়িতে আছে। সেটাই ভালো...’

কিন্তু ছোট চাচির চোখে-মুখে এমনকি কথাতেও তীব্র অসন্তোষ ফুটে উঠেছিল, ‘কী বলেন ভাইজান! জুয়ান মানুষ, শালকাঠের মতো শরীর, ৫-৬ দিন না খেয়ে থাকলেও টসকায় না, এমন একটা লোক লাশের মতো ঘরে পড়ে থাকে! আমার মানসম্মান সে আর কিছুই রাখল না। আপনি নিজেই হিসাব করে দেখেন, অয়নের বয়স মাত্র ১৯, আর এর বয়স ২৮,- সেই ১৯ বছরের অয়নের খোঁজখবর নাই, আর এই জোয়ান মানুষ যুদ্ধে না যেয়ে ঘরে বসে আছে! এইটা কোনো পুরুষ? পারে তো খালি নৌকাবাইচে যেতে আর যাত্রা করতে! আসল কাজে ঠনঠনা! মানসম্মান আমার সবই গেল। এই গাঁয়ে এখন আমার বাস করাই জুলুম।’ 

বড়চাচা রাগবে কি, ছোট চাচির এইসব কথাবার্তা শুনে মুখটা হা করে দাঁড়িয়েছিল। কুপিবাতিটার চারপাশে অনেক পোকা উড়ছিল, তারই একটা বড়চাচার নাকে নাকি মুখের মধ্যে তার শিকড়বাকড় ছুঁইয়ে গেলে ‘হ-হ-ক্ক’ করে খানিকটা থুথু ফেলার পর সে সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল, ‘অয়নের খোঁজখবর নাই মানে?’

আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ছোট চাচি আসলে অয়ন ভাইয়ের যুদ্ধে যাওয়ার কথা জেনে ফেলেছে। মা বোধহয় তাকে চুপি চুপি বলে রেখেছে। অবশ্য না বলারই বা কী আছে! মানুষ কি আর কথা গোপন রাখতে পারে। মানুষ আসলে কথা ততক্ষণই গোপন রাখে, যতক্ষণ সে বলার মতো মানুষ খুঁজে পায় না। তবে বড় চাচার প্রশ্ন শুনে ছোট চাচি বোধহয় হুঁশ ফিরে পায় আর ব্যাপারটা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে, ‘ওইরকম গণ্ডা গণ্ডা পাকিস্তানি জানোয়ারের মধ্যে বাড়িঘর পাহারা দেওয়া আর খোঁজখবর থাকা না-থাকা তো একই কথা।’

বড় চাচা মনে হয় একটু আহত হয়েছিল। ভোটটা সে নৌকায়ই দিয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নাই-আমাদের গ্রামের স্কুলের ভোটকেন্দ্রে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মার্কায় ভোটই পড়ে নাই। তাছাড়া চারপাশের গোলাগুলি আর খুন-আগুনের খবরে বড় চাচার চোখে-মুখে বেদিশা একটা ভাব সব সময় গড়াগড়িও খায়; কিন্তু তারপরও পাকিস্তানিদের ওপর থেকে তার মন এখনো পুরোপুরি উঠে যায় নাই। কালকেও দেখেছি, তিন ভাই মিলে কাচারি ঘরের বারান্দায় বসে নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি করছে, বড় চাচা আব্বা আর নয়ন চাচাকে বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, ‘যত যাই কও, মানুষজনকে খ্যাপায়ে তোলা মুজিবুরের ঠিক হয় নাই।’

নয়ন চাচা মনে হয় বাড়িতে বসেই যুদ্ধ শুরু করে, ‘মানুষজনেক এত বোকা মনে করেন ক্যান? মানুষজন কি না বুইঝা ভোট দিছে?’

‘ভোট দিছে, ঠিক আছে। ভোট কি আর পাকিস্তান ভাঙার জন্য দিছে? ভোট দিছে, ভোটের রেজাল্ট হইছে। এরপর পার্লামেন্ট বসবে। কোনো না কোনোভাবে সমস্যার সমাধান হবে; কিন্তু মানুষজনকে এইভাবে খ্যাপায়ে তোলা- এটা মোটেও ঠিক হয় নাই।’

‘আপনে মানুষজনকে এত বোকা ভাবেন কেন ভাই?’-অসহিষ্ণু গলায় নয়ন চাচা বলেছিল-‘খ্যাপায়ে তুলছে মানে? মানুষজন খেপে গেছে। নিজেরাই খেপে গেছে। শোনেন, মানুষজন যে খেপে গেছে সেটা মুজিবও বুঝতে পারছে। আপনি বরং বলেন, মুজিব তাদের শান্ত কইরা রাখছিল-’

‘তুই বেশি বুঝিস!’ - বড় চাচা গড়গড়িয়ে উঠেছিলেন - ‘তোর মতো মানুষজনের জন্যই ওই ইন্দিরা গান্ধী এখন আর্মি নিয়ে দৈনিক আসি-আসি করছে! শোন, ভায়ে ভায়ে একসঙ্গে থাকতে গেলে ঠোকাঠুকি লাগেই; এখন সেই জন্য তুমি যদি বাজার থেকে লোকজন ডেকে আনো, তা হলে দেখবে সারা জীবন তোমাকে ওই বাজারের লোকজনের পিছনেই ছুটাছুটি করতে হবে। তা যাকগে, এতদিন যা খুশি তাই করেছিস, ভালো কথা। বাইচ খেলছিস, যাত্রা করছিস-সব ঠিক আছে। এখন বউমা পোয়াতি- যুদ্ধে যাওয়ার কথা, খবরদার, চিন্তাও করবি না।’

‘কী বলেন বড় ভাই? সে তো কয়, তার মানসম্মান নাকি সবই গেছে। আমি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে বেড়াতাম, এখন আমারই নাকি কোনো খবর নাই। সে তো পারলে এখনই আমাকে যুদ্ধে পাঠায়ে দেয়।’

‘হু-হ... যুদ্ধে যায়! ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার...’

বলেই হয়তো বড় চাচার মনে পড়ে যায়, ছোট চাচি কী বলেছিল। তাই আব্বার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, ‘তুই যে বলিস, অয়ন টাউনে বাড়ি পাহারা দিতেছে, কথা ঠিক তো?’

‘ঠিক না মানে? কী বলেন বড় ভাই?’ - স্পষ্টই বোঝা যায় আব্বা গায়ের জোরে কথা বলছে; কিন্তু বড় চাচার জেরার মুখে কণ্ঠস্বর কেমন মিইয়ে পড়ছে।

‘মা-বাপে নিজের বুক আগায়ে দিয়ে ছেলেকে আগলে রাখে। তুই দেশের এমন অবস্থায় ছেলেকে শহরের বাড়ির পাহারায় রেখে গ্রামে চলে এসেছিস-এইটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস?’ 

আব্বা তো-তো- করতে থাকে, ‘রূপার মা আর রূপা ছিল, রাস্তায় কী না কী হয়- ও কি আর সামলাতে পারবে? এই জন্য অয়নকেই রেখে আসলাম। খারাপ কিছু হবে না ভাইজান, পাশের বাসায় উকিল শামসুদ্দীন ভাই আছে, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এখন-’

‘রাখ তোর উকিল শামসুদ্দীন ভাই। তার ওপরেই যদি তোর ভরসা থাকে, তাহলে তুই ফ্যামিলি নিয়ে গ্রামে আসিস? শহরেই থাকতি। শান্তি কমিটির লোকজন আমিও চিনি-চাকরিবাকরি বাদ দিয়া বউ মেয়ে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছি কম দুঃখে?’ মনের খেদ উজাড় করে দিয়ে ফের প্রশ্ন করে বড় চাচা, ‘ঠিক করে বল তো, অয়ন যুদ্ধে গেছে নাকি?’ 

আব্বার মাথা এবার একটু নত হয়ে আসে, ‘জানি না বড় ভাই। ঢাকায় মানুষ মারার খবর আসার পরদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আর ফেরে নাই।’

আমি জানি, এই কথাটা বাবা পুরোপুরি ঠিক বলে নাই। অয়ন ভাই যাওয়ার সময় বাবা অবশ্য বাড়িতে ছিল না, কিন্তু সে আমাদের সঙ্গে কথা বলেই গেছে, আমাকে আর রূপাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে গেছে আর মা তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলেছে, ‘যা, তোকে আল্লার নামে কোরবানি দিয়ে দিলাম।’

তো আমার অবশ্য একটু ঈর্ষাই হয়েছিল। বড় সন্তান মা-বাবার খুব প্রিয় হয়, প্রথম তো! আমার না হয় বয়স মাত্র ১০, যতই নৌকার মিছিল করি আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেই, আমাকে কি কেউ আর যুদ্ধ করতে নেবে! কিন্তু যুদ্ধ করা ছাড়াও তো কত উপলক্ষ আছে-কোরবানিটা মা আমাকে দিলে আমি কি না করতাম! আমি তো খুশিই হতাম, বুঝতে পারতাম আমিই তার সবচেয়ে প্রিয় ছেলে; কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার আগে অয়ন ভাই কীরকম একটা বড়সড় দান মেরে নিলো। বেশিক্ষণ না, ২-৩ মিনিটের মধ্যেই-আব্বা ফিরে আসার আগেই- এইভাবে অয়ন ভাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। সেই হিসেবে ধরতে গেলে আব্বা অবশ্য অয়ন ভাইয়ের যুদ্ধে যাওয়ার চাক্ষুস সাক্ষী না-ত্যানা প্যাঁচাতে চাইলে তো কতভাবেই প্যাঁচানো যায়; কিন্তু সত্যি হলো, অয়ন ভাই যুদ্ধে গেছে বলেই আব্বা তাড়াতাড়ি শহর ছেড়েছে। একদিন, দুইদিন, তিনদিন- তিনদিন না হয় পাঁচদিন- পাঁচদিন না হয় দশদিন- উকিল চাচাদের চোখে তো একদিন ঠিকই ধরা পড়ত, অয়ন ভাইকে বহুদিন দেখা যায় না, বহুদিন তার গলার স্বরও শোনা যায় না। তাছাড়া উকিল চাচা একদিন তো খোঁজও করেছিল অয়ন ভাইয়ের। 

কিন্তু এখন! মানুষ কখনো কখনো অনুপস্থিত থাকলে বরং তার উপস্থিতি আরও বেশি করে বাজে। বড় চাচা অয়ন ভাইয়ের তেমন উপস্থিতি মেনে নিতে পারে না বোধহয়, বড় বেশি অস্থির হয়ে ওঠে সে, ‘কিছু লুকাবি না আমার কাছে। তোরা চাইলি, নৌকায়ই ভোট দিলাম- এখন? দেখছিস তো! জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। গ্রামে এসেও নিস্তার নাই। তিন মাইল দূরে শহর, কয়দিন এই গাঁয়ে থাকবি? নিজেরা তো মরবিই, আমাদেরও মারবি।’

বড় চাচার কণ্ঠস্বর বোধহয় উঁচু হয়ে উঠেছিল। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কে যেন বোধহয় তাই থমকে দাঁড়ায়। দীপা আর বড় চাচিকেও দেখা যায় বাড়ির মধ্যে থেকে বাইরের দিকে উঁকি দিতে। আমাদের প্রতিবেশি কান্দু চাচার মা প্রতিদিন এইসময় হামানদিস্তায় সুপারি ছেঁচে; কিন্তু আজকে তার কোনো শব্দই শোনা যায় না। তখনই বড় চাচার চোখে চোখ পড়ে যায় আমার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে ওঠে সে, ‘তুমি কেন বড়দের আলাপের মধ্যে? যাও, যাও এখান থেকে।’

আমি তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে চলে আসি। আকাশের কোণে মেঘ-বৃষ্টির আভাস দেখি। মা-চাচিরা রান্না-বান্না শেষ করে চুলা নিভিয়ে দিলেও বসে আছে সেখানেই। কুপি বাতিটার শিখা কাঁপছে বাতাস লেগে আর দীপার মুখে হলদে-লালচে আলোর ছায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। এবার আসার পর এই প্রথম বোধহয় তার মুখে সামান্য হাসির আভা দুলে ওঠে, ‘নৌকার কাজে গিয়েছিলে ভাইয়া?’

আমি থতমত খেয়ে সরে পড়তে থাকি সেখান থেকে। দীপা আরও জোরে জোরে হাসতে থাকে।

তারপর মেজাজ আমার থতমত খাওয়াই থাকে, না কি বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়, তা আর বুঝতেই পারি না। এই বর্ষায় ঘরের মধ্যেই থাকতে হয় দিনের বেশির ভাগ সময়। আচানক মনে হয়, আচ্ছা, হাকিম ফকিরের অবস্থা কী! কিন্তু সঠিক খবর কারও কাছেই পাওয়া যায় না। আচানক মনে হয়, এই যে মাঝে-মধ্যেই ঠা ঠা গুলির আওয়াজ শুনি, এই গুলি কে চালালো; কিন্তু তারও কোনো সঠিক খবর পাওয়া যায় না। একটু নড়াচড়া করলেই বড় চাচা ধমকায়। রীপা আপা আর নীপা আপারা দেখি ভয়ানক পেরেশানিতে আছে-কোনো কথা বলতে দেয় না, তাদের কারও কাপড়চোপড় ঘরের বাইরে মেলতে দেয় না, রান্নাঘরেও বেশিক্ষণ বসতে দেয় না। গ্রামের কোনো মেয়ে এসেও বাড়ির মধ্যে ঢুকতে পারে না। বাড়ির এদিকওদিক সব সময় চড়কির মতো ঘুরে ফেরে বড় চাচা; কিন্তু তারপরও ঝামেলা লেগে যায় একদিন সকালে। কেবল ঘুম থেকে উঠে নিমের ডাল দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করে ফিরেছি গাঁয়ের মসজিদের ইঁদারার কাছ থেকে-বাড়ির সামনে দেখি চাচারা আর গাঁয়ের কয়েকজন জটলা পাকাচ্ছে। তাদের একজন বলছে, ‘গোলবার নিজে দেইখা আসছে চাচা।’

কী দেখে এসেছে, সেটা ঠিক স্পষ্ট করে বুঝতে পারি না, তবে বড় চাচা তাদের বক্তব্য এক কথায় নাকচ করে দেন, ‘এইটা হতেই পারে না। শোন, অয়ন হলো আলাভোলা মানুষ। ভালো মানুষ। সাত চড়েও সে রা করে না। আরে, সে তো চুপচাপ শহরের বাড়ি পাহারা দিতেছে-শহরের মোড়ে তাকে তুমি কোনখান থেকে পাও! ফয়সাল কাকে দেখতে কাকে দেখছে, তার কোনো ঠিক আছে নাকি?’ 

তা কুকথা নাকি বাতাসের আগে আগে ছোটে। বড় চাচার ঝাড়ি খেয়ে লোকগুলো চলে যাওয়ার পর চাচারা, সেই সঙ্গে আমিও বাড়ির মধ্যে ঢুকতে না ঢুকতেই মা আব্বার দিকে চেয়ে বলে ওঠে, ‘আপনি যদি না যান তো বলেন, আমি যাই-দেখে আসি। যদি সত্যিই হয়, লাশটা তো দাফন করতে হবে। নাকি বলেন?’ 

আব্বা কিছু বলার আগেই কথা বলে বড় চাচা, ‘আরে, এইসব কথায় তুমি কান দিও না তো বউমা। কাকে দেখতে কাকে দেখেছে! আরে, অয়ন যদি যুদ্ধে যেয়েও থাকে, এইভাবে বেঘোরে মরবে নাকি? এতই সোজা ওকে মারা?’

তাই তো, এতই সহজ অয়ন ভাইকে মারা! আকাশে মেঘ জমছে। এমন দিনে আমার শুয়ে থাকতে বেহুদাই ভালো লাগে; কিন্তু এখন আমার সারা শরীর উত্তেজনায় ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। মা অবশ্য চাচার কথাটাকে পাত্তাই দেয় না, স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে আবারও বলে, ‘যদি সত্যিই হয়, লাশটা তো দাফন করতে হবে। নাকি বলেন?’

বড় চাচা কেমন চুপ হয়ে যায়। শুধু বড় চাচা কেন, সারা পৃথিবীটাই কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়। রোদে কাপড় মেলে দেওয়ার দড়িটাও কী ভীষণ নিঃসঙ্গ এখন; কিন্তু তা আর কতক্ষণ, আব্বা উত্তর দেয় মার কথার, ‘আমি তাহলে বরং যাই, ঘুরে আসি শহর থেকে, কতক্ষণ আর লাগবে!’

‘না- না- এই বর্ষাবাদলার মধ্যে তুই কেন যাবি? তুই গেলে আর লাশটাও সত্যি সত্যি অয়নের হলে তো ঝামেলা লেগে যাবে। তোকেও আটকে রাখবে। তারচেয়ে আমি গিয়ে ঘুরে আসি।’

‘আপনি গেলেও তো একই ঘটনাই হবে।’

‘তা কেন হবে! শোন, আমার মনে হয় কি জানিস, বেওয়ারিশ লাশ দেখলে মানুষজন নানা খোয়াব দেখে। গোলবার কাকে না কাকে দেখে এসেছে, তাই নিয়ে খালি খালি টানাটানি করছে! কেন, খালি গাঁয়ের লোকজনই অয়নকে চেনে, টাউনের কেউ চেনে না? ও সেরা ফুটবল খেলোয়াড়, সে অভিনেতা- ওকে তো রাস্তার ফকির আর গোরস্থানের দরবেশ থেকে ওই লাল কোয়ার্টারে থাকা ডিসি পর্যন্ত চেনে। তার লাশ রাস্তায় পড়ে থাকবে-কেউ চিনবে না, এইটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস?’

বড় চাচার এমন স্থির অথচ চড়ানো গলায় মাও কেমন দোমনা যায়। সত্যিই তো, অয়নের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকবে, কেউ-ই চিনবে না! পাবলিক যদি ভয়ের চোটে নাও চেনে, রাজাকারদের তো চেনার কথা, উকিল চাচার তো চেনার কথা! এমন দোমনা মুহূর্তে বড় চাচা আরেকটা বল ছোড়ে, ‘তারপরও আল্লা না করুক, যদি হয়েই থাকে- লোকজন আমার চেনাজানা আছে না? শান্তি কমিটির উকিল শামসুদ্দিনের কথা বললি, সে তো আমার সাথেই পড়াশুনা করেছে। আমিই যেয়ে দেখে আসি।’

‘কী বলেন আপনি? শামসুদ্দিন আপনার সঙ্গে পড়ছে তো কী? আপনার যে পাঁচটা মেয়ে, আর তিনটার এখনও বিয়ে হয় নাই, উকিল শামসুদ্দিন সে খবর রাখে না মনে করেন?’ - এই কথা বলে নয়ন চাচা পুরো পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। নয়ন চাচা যে এমন একটা কথা সরাসরি বলে ফেলবে, তা বোধহয় কেউই চিন্তা করে নাই। ছোট চাচিকেও দেখি আধহাত জিভ বের করে আবার সুরুৎ করে মুখের ভেতরে ফিরিয়ে নিলো। আর বড় চাচার ঠোঁট কেমন করে শুধু কাঁপতে লাগল, কাঁপতেই লাগল। বিব্রতকর চোখেমুখে সে পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফেলে ঠোঁটটা কেমন করে যেন বার বার কোঁচকাতে লাগল।

সত্যি কথা বলতে গেলে, বড় চাচার ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার আশা আব্বা আর আম্মা ছেড়েই দিয়েছিল; নয়ন চাচা তো বেশ বিরক্তি নিয়ে একবার বাঁকা সুরে বলেও ছিল, ‘তিনি কি আর ফিরবেন? খোঁজ নিয়ে দেখেন, একটা শান্তি কমিটি খুলে দিনরাত ওইগুলোর সঙ্গে নড়াচড়া করছেন।’ সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি না, জানতে পারি নাই। তবে আমার বন্ধু মোতাহারের ঘোরতর সন্দেহ, বড় চাচার এরকমভাবে বাড়িতে আসার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। ক’দিন আগে দীপা যেভাবে কথা বলল, সেভাবে যদি আরও কয়েকদিন আগে থেকে বলত, তাহলে বোধহয় এর মধ্যে সেটা জেনে ফেলতাম; কিন্তু এখন তা জানি কোত্থেকে। বড় চাচা কিংবা বড় চাচি কেউই কোনো কিছু স্পষ্ট করে বলে নাই, কিন্তু তাদের মুখ থেকে মাঝে-মধ্যে হঠাৎ করে এমন দু’চারটা কথা বেরিয়ে এসেছে যে, নয়ন চাচা আড়ালে আবডালে এরকমই সন্দেহ করে। এই তো কয়েকদিন আগেই মার সঙ্গে পেছনবাড়িতে ওই আম-আদা তোলার সময় হাসাহাসি করেছে নয়ন চাচা, ‘শোনেন ভাবী, খুব সাবধানে থাকবেন-আমাদের এই ভাই কিন্তু মনে মনে একেবারে রাজাকার; কিন্তু রাজাকার হলে কী হবে, কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছে, ঘরের মধ্যে তিন-চারটা মেয়ে নিয়ে রাজাকার হওয়াও আসলে মুক্তিযুদ্ধ করা।’ বলেই হো হো করে হাসতে শুরু করেছিল। আর মাও হাসতে হাসতে মুখে আঁচল চাপা দিতে দিতে বলেছিল, ‘নয়ন, তুই কিন্তু খুব ফাউল কথা বলিস।’

‘ফাউল কথা না ভাবী। আল্লাহ আমারে মাফ করুক, আপনি নিজেই চিন্তা করে দেখেন,- এই যে রীপা, নীপা, আল্লায় কেমন ঘর আলো করা মেয়ে দিছে বড় ভাইয়ের ঘরে! কিন্তু ওরা তো আর আরব্য রজনীর উজিরকন্যা শাহরাজাদ না। আপনে বলেন, ওদের পক্ষে কি সম্ভব কিচ্ছা বলে বাদশাহ শাহরিয়ারের মাথা ঘুরায়ে দেয়া! ভাই সেটা হয়তো আগে বোঝে নাই; কিন্তু যুদ্ধ যাওয়ার মাসখানেক পর ঠিকই বুঝেছে। তাই সুযোগ পেয়েই ঢাকা ছেড়েছে।’ 

মা তারপর নয়ন চাচাকে সত্যিই ঠাস করে একটা চড় মেরে ধাক্কা দিয়ে বলেছিল, ‘যা- ভাগ তুই এখান থেকে-।’ তাতে নয়ন চাচা অবশ্য রাগ করে নাই। হাসতে হাসতে চলে এসেছিল সেখান থেকে। আর আমার হঠাৎ করেই মনে পড়ে গিয়েছিল, বড় চাচারা আসায় আমার ছোটখাটো হলেও একটা লোকসান হয়ে গেছে। বাড়িতে লোকজন বেড়ে যাওয়ায় ছোট চাচি দৈনিক সন্ধ্যায় আর আরব্য রজনীর গল্প শোনায় না আমাকে আর রূপাকে! 

তো বড় চাচাকে এমন একটা বেকায়দা বেদিশা অবস্থায় ফেলে আব্বার দিকে তাকিয়ে বেশ খুশি-খুশি মনে নয়ন চাচা বলে, ‘চয়ন ভাই, তারচেয়ে বরং আমি যেয়ে ঘুরে আসি।’

বড় চাচা আবারও না- না- করে ওঠে, ‘তুই যাবি মানে? তোর মতো শক্তিসামর্থ্য মানুষ দেখলে ওরা তো ভাববে, তুইও ওদের সঙ্গে ছিলি। তা ছাড়া বউমা পাঁচ মাসের পোয়াতি- এখন এই অবস্থায়- না- না- খবরদার, তোর যাওয়া ঠিক হবে না।’

‘আপনারা কি এই সব তত্ত্বতালাশেই ব্যস্ত থাকবেন?’ - অস্থির হয়ে বলে ওঠে মা। আর বড় চাচা তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে, ‘আহ্, বউমা- তুমি এত অস্থির হয়ো না। হুজুগের বশে একটা কাজ করলে তো হবে না। এটা তো খালি একজনের বাঁচা-মরার ব্যাপার না। এটা আমাদের সবার বাঁচা-মরার ব্যাপার। মুখে মুখে শোনা একটা ব্যাপার- সিদ্ধান্তটা এক মিনিটের মধ্যে না দিয়ে পাঁচ-দশ মিনিট পরে নিলে তো সমস্যা নাই। এমনও তো হতে পারে, অয়নের পরিচয় ওরা জেনে ফেলেছে-আর উকিল শামসুদ্দিনকে নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। এখন তো আমার মনে হচ্ছে, আমাদেরই পালানো উচিত। তোমাদের ঘরে তেমন কেউ না থাকুক, আমার ঘরে তো দুই-দুইটা সাবালক মেয়ে-’

তখন মাকে বিভ্রান্ত লাগে, উদভ্রান্ত লাগে; বিভ্রান্ত-উদভ্রান্ত লাগে আব্বা কিংবা ছোট চাচাকেও। সকালের রোদ এখন দুপুরের দিকে রওনা হয়েছে, কিন্তু আকাশের মেঘ মাঝে-মধ্যেই খাবলা দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করছে তাকে; উঠোন থেকে সরে কাঁঠাল গাছের নিচে নখ দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে কয়েকটি মোরগ আর মুরগি, গাছের শিকড়বাকরের মধ্যে শুয়ে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে একটা বেড়াল। বড় চাচি মাকে শক্ত করে ধরে আছে আর ছোট চাচি কেমন যেন বোকা বনে গেছে। বড় চাচা নিশ্চয়ই অনেক আগেই তাদের মেয়েদের ছবক দিয়ে রেখেছেন, বড়দের কথাবার্তার মধ্যে না আসতে- ঘরের উঠোন দূরে থাক, বারান্দা কিংবা জানালা কোনখানেই দেখা যাচ্ছে না তাদের। কেন যেন আমার মনে হয়, আব্বা কিংবা চাচারা কেউই অয়ন ভাইকে খুঁজতে শহরে যাবে না-বরং পালিয়ে যাবে, বাড়ি থেকেই পালিয়ে আবার অন্য কোনওখানে চলে যাবে। খালি খালি সময় নষ্ট! 

আস্তে আস্তে বাড়ির পেছনে চলে আসি আমি। জঙ্গলের জন্য উত্তরের ক্ষেতখোলা কোনো কিছু চোখে পড়ে না-পশ্চিমের দিগন্ত বিস্তৃত ভূমির দিকে তাকিয়ে থাকি। বর্ষার পানি খলবল করছে- জলাভূমির ওপর ডানা মেলে উড়ছে বক আর চখাচখিরা। জঙ্গলের মধ্যে একটা তিলা ঘুঘু ডেকে উঠল, খানিকক্ষণ বিরতি দিয়ে ডাকল বোধহয় টিয়া; কিন্তু না, কোনো পাখির বাসা খুঁজতে আমার আর ভালো লাগছে না। আর খুঁজে পেলেই বা কী, দীপার সামনে উড়িয়ে দিতে পারলেই বা কী!

আমি বাড়ির গড়ান বেয়ে নিচের দিকে নামতে থাকি। এই বর্ষার পানি হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই কমে যাবে, হয়তো আবারও ভাদ্র এলেই ফিরে আসবে বান হয়ে, কিন্তু বান আসুক বা না আসুক, নরমু- ভাসতে শুরু করেছে, নরমু- আরও ভাসবে। কয়দিন আগে নয়ন চাচার সঙ্গে মিলে বানানো কলার ভেলাটা একটু নেড়েচেড়ে দেখি আমি, নাহ্- এখনো খুব পোক্ত, লগিটা দিয়ে বেয়ে নিয়ে যেতে আমার হয়তো একটু কষ্ট হবে, হয়তো মাঝেমধ্যে পানিতে নেমে ঠেলতে হবে, হয়তো কোথাও কোথাও আবার লুঙ্গিও তুলতে হবে-কিন্তু শহরে শেষ পর্যন্ত যাওয়াই যাবে। আর মা মুখে মুখে যতই বলুক, যা-ই বলুক, মনে মনে নিশ্চয়ই চায় অয়ন ভাইয়ের বদলে একটা দুম্বা কোরবানি হয়ে যাক, বেঁচে থাকুক বড় ভাই! তা হলে আমিই না হয় জেনে আসি, লোকজনের মুখে মুখে শোনা কথাটা কতটুকু সত্যি। দেখে আসি, পাওয়ার স্টেশনের মোড়ের কাছে পড়ে থাকা মানুষটা অয়ন ভাই কি না। তখন রাজাকার কিংবা খানসেনারা যদি ধরেই ফেলে, তাহলে মা না দিক, আমিই না হয় আমাকে কোরবানি দিয়ে দেব, না হয় সেই দুম্বাই হয়ে যাব। ক্ষতি কি তাতে, যদি অয়ন ভাই বেঁচেই থাকে শেষ পর্যন্ত? 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫