
প্রতীকী ছবি
-হাসান ভাইয়ের কাছে শুনলাম, আপনি নাকি হাতদেখতে পারেন?
-না, ঠিক সেরকম কিছু না, টুকটাক পারি।
-আমার হাতটা একটু দেখে দিন তো।
-না, মানে... আপনার হাতদেখে আমি কী বলবো?
-আরে, এতো বিনয় দেখাতে হবে না। এই নিন আমার হাত, ভালোভাবে দেখে বলুন কী লেখা আছে।
এই কথা বলেই রিনি তার ডান হাত আমার মুখের সামনে বাড়িয়ে দিল। খুব নরম আর ধবধবে ফর্সা সেই হাত। আঙুলে খয়েরী কালারের নেইল পলিস লাগানো। আমি দ্বিধা নিয়ে কিছুক্ষণ তার হাতটা ধরে নেড়েচেড়ে দেখলাম। বললাম, বাম হাতটা দিন। সে আমার কথা মতো বাঁ হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে রিনির হাতদেখছি আর ভেতরে ভেতরে কিছু কথা বানাচ্ছি। সে আমার খুব কাছাকাছি হয়ে গা ঘেঁষে বসেছে। শরীর থেকে মন অবশ করে দেয়া পারফিউমের মাতাল ঘ্রাণ ভেসে আসছে আমার নাকে। কী নাম হতে পারে পারফিউমের? ব্লুলেডি? হবে হয়তো। সুন্দরী আর স্মার্ট মেয়েরা আজকাল এইটা বেশি ব্যবহার করে।
উপলের সাথে রিনির সম্পর্কটা দুই বছর হলো ভেঙে গেছে। উপল হিন্দু পরিবারের ছেলে, তাই রিনির পরিবার সেটা মানতে পারেনি। আর রিনির সেই সাহস ছিলো না যে, তার মা-বাবার কথার বাইরে গিয়ে কিছু করবে কিংবা উপলকে ভালোবেসে যাবে। সম্পর্কটা অনেক গভীর হয়েছিলো দুজনের। কিন্তু নেত্রকোনার মতো একটা ছোট্ট মফঃস্বল শহরে এই কথা চাউড় হতে বেশি সময় লাগেনি। রিনির বাবা কোথাও মুখ দেখাতে পারছিলেন না। চারদিকে নানা আ-কথা, কু-কথা ভেসে বেড়ায়। বিরহকাতর উপল কিছুদিন আউলা-ঝাউলা হয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। এখন ওর ছেলের বয়স দেড় বছর। এদিকে রিনি নতুন করে আর কারো প্রেমে পড়েনি। এখন পর্যন্ত সে একাই আছে।
এইসব কথা আমি আগেই হাসানের কাছে শুনেছি। হাসান রিনির দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়। সে আবার আমার খুব কাছের বন্ধুও। এই হাসানের বাসায় আমরা মাঝে মাঝে আড্ডা দেই। এরকম একটা আড্ডার দিনেই ওর বাসায় রিনির সাথে আমার পরিচয় এবং কথাবার্তা হয়।
রিনির হাতটা আমার চোখের খুব কাছে নিয়ে বললাম, আপনার একটা সম্পর্ক ছিলো একজনের সাথে। কিন্তু এখন আপনি পুরোপুরি একা, খুব নিঃসঙ্গ। মাঝে মাঝে আপনাকে অতীত স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়। তখন আপনি ভয়াবহ কষ্ট পান। আমার এই কথাগুলো শুনে সে খুব সিরিয়াস হয়ে যায়। তার চোখেমুখে বিস্ময়ের ছায়া।
আমি আবার শুরু করি কথা বলা- ছেলেটি আপনাকে খুব ভালোবাসতো। আপনাদের ভালোবাসা খুব গভীর ছিলো। রিনি বেশ অবাক হয়ে যায়। সে খুব অস্থির হয়ে বলে, আপনি কীভাবে জানলেন? আমি সাধু-সন্ন্যাসীর মতো নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেই, আমি কিছুই জানি না। আপনার হাতেই সব লেখা আছে প্রতিটি রেখার ভাঁজে ভাঁজে! আমি তা দেখেই বলছি। প্লিজ, থামবেন না, আর কী কী লেখা আছে হাতে? এই বলে সে আমার শরীরের আরো কাছে চলে আসে। আমার হার্টবিট দ্রুত বেড়ে যায়। ছেলেটি হিন্দু আর আপনি মুসলিম- ঠিক এই কারণেই আপনার মা-বাবা এই সম্পর্কটা মানতে পারেনি। আপনিও মারাত্মক দ্বিধা নিয়ে ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন! এই বলে আমি রিনির মুখের দিকে তাকাই। দেখি তার দুচোখ ছলছল করছে জলে।
আমি বললাম, সরি, আপনাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আজ থাক। আপনার হাতে যদিও অনেক কথাই লেখা আছে! কিন্তু আমি সব বলতে চাই না। এতে আপনার কষ্ট আরো বাড়বে! বাড়ুক, আমার কষ্ট আরো বাড়ুক। তবু আপনি বলুন। আমি আপনার মুখ থেকে আমার একান্ত নিজের কষ্টের অনুবাদগুলো শুনতে চাই- এইবার রিনির গলায় স্পষ্ট জেদ। আমি মহা ফাঁপরে পড়ে গেলাম তার এরকম কথায়। কী করবো বুঝতে পারছি না। হাসানও আমার সামনে নেই। ড্রইংরুমে কেবল আমি আর রিনি।
কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছে তার নরম হাতটা ধরে রাখতে। আমি বললাম, এখন আপনি একা, ভীষণ একা। এই কথা শুনে রিনি এমন ভাবে আমার দিকে তাকায় যেন আমি কোন দেবদূত। আমার ভেতরে খুব অস্বস্তি লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড পানির তেষ্টা পেয়েছে।
রিনির হাতটা ছেড়ে দিলাম। এরমধ্যে হাসান আমাদের জন্য ঝালমুড়ি বানিয়ে এনেছে। রিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে ঝালমুড়ি খাচ্ছে। আমি কিছুই খাচ্ছি না। ভাবছি, রিনি যদি বুঝতে পারে আমার হাতদেখাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, তখন তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। কিংবা হাসান যদি বলে দেয় সত্যিটা তখন সে আমার বিষয়ে কী ধারণা করবে? আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না।
দুই
মুড়ি খাওয়া শেষ হলে আমরা সবাই উঠে পড়লাম। হাসানের বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে মেইন রোডের উপর এসে থামলাম। রিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আনিস ভাই, আপনি কোথায় যাবেন এখন? আমি ছোট করে উত্তর দিলাম, তেরিবাজার থানার মোড়ে যাবো। আমিও সেদিকেই যাবো। চলেন এক রিকশায় আমার সাথে- এই বলে রিনি একটা খালি রিকশা ডেকে নিলো।
আমি আর রিনি একসাথে, এক রিকশায় যাচ্ছি। ভাবছি, কাল রিনিকে সব খুলে বলবো- আমি হাতদেখতে জানি না। কখনো কোনো মেয়ের হাত ধরিনি আগে। হাতদেখা তো দূরের কথা। হাসানের কাছ থেকে আগে থেকে সব শুনে আপনাকে বলেছি। কেবল আপনার হাত দুটো ধরবো বলে এরকম করেছি। প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝবেন না।
না থাক। যা হয়েছে, তা হয়েছে। আমি কিছুই বলবো না। রিনির মনের ভেতর আমার প্রতি যে একটা অদৃশ্য টান রেখাপাত করেছে সেটা অনেক মূল্যবান। এই অনুভূতিটাকে আমি নষ্ট হতে দেবো না। বাতাসে রিনির খোলা চুল উড়ে এসে আমার চোখ ঢেকে দিচ্ছে। রিকশা খুব দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
থানার মোড়ে এসে রিকশা জ্যামে আটকা পড়ে গেল। আমি অস্বস্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। রিনি বিষয়টা খেয়াল করছে। সে হেসে বললো, কী ব্যাপার আনিস ভাই, এরকম ছটফট করছেন কেন? আমার পাশে বসতে কি সাংবিধানিক জটিলতা বা আইনগত বিধিনিষেধ আছে? আমি তার দিকে তাকিয়ে হেসে উত্তর দিলাম, একদম না। আপনার মত একজন স্মার্ট, সুন্দরী মেয়ের পাশে বসতে পারা খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। ফ্লার্ট করছেন নাকি? এই কাজটা আমি একদম পছন্দ করি না- রিনি ওড়না ঠিক করতে করতে বললো। আমি আর কোনো কথা বললাম না।
তেরিবাজার আসতেই আমি রিকশা থেকে নেমে পড়তে চাইলাম। রিনি রিকশার ড্রাইভারকে একটা সাইডে দাঁড়াতে বললো। আমি ভাড়া দিতে চাইলাম। সে তা দিতে দিলো না। আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বললো, চলেন, আপনাকে নিয়ে কফি খাবো। তাড়া নেই নিশ্চয়ই আপনার? আমি কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম। সে বাতাসে হাত নেড়ে বললো, আরে ভাই, চলেন তো। কফি খেতে খেতে গল্প করবো। আমি চুপচাপ রিনির সাথে শহরের অন্যতম সুন্দর কফি শপ-‘রোমান্স’-এ ঢুকলাম।
গরম কফির মগে মৃদু চুমুক দিয়ে রিনি বললো, আপনি কষ্ট করে আমার হাত দেখেছেন। তাই আপনার সম্মানে আমি কফি খাওয়ালাম। আপনি প্রফেশনাল হলে নিশ্চয়ই হাজার খানেক টাকা দিতে হতো, তাই না? আমি তার কথায় মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিলাম।
আমার নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। ইচ্ছে করছে এখনি রিনিকে বিষয়টা ভেঙে বলি। কিন্তু কেন জানি কথা গলা পর্যন্ত এসে আটকে যাচ্ছে। এরকম একটা রোমান্টিক সন্ধ্যা যদি মলিন হয়ে যায়! তাই একধরনের খচখচানি মনের ভেতরে থাকলেও আমি এই কফিশপে রিনির সঙ্গ খুব এনজয় করছি। বুঝতে পারছি, বুকের ভেতরের কোনো এক জায়গায় এই মেয়েটির জন্য আমার ভালো লাগার কঠিন বরফ জমতে শুরু করেছে!
তিন
রাতেই হাসানের সাথে দেখা করলাম। বললাম, কাজটা খুব অন্যায় করে ফেলেছি বন্ধু।
-কোন কাজটা অন্যায় করেছিস?
-তুই মনে হয় কিছুই বুঝতে পারছিস না? আজকে রিনির হাত দেখার বিষয়টা নিয়ে যা হলো তা তুই এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি!
-ও আচ্ছা, এই কথা। তোরও দোষ আছে, তুই কেন ওর হাত ধরে এত কথা বলতে গেলি? সে তো ভেবেছে তুই গ্রেট জ্যোতিষী!
-তুই আমার সাথে থাকবি। রিনির সাথে দেখা করে আমি আমার অপরাধ স্বীকার করে নেবো।
-এতো সিরিয়াস হওয়ার দরকার নাই। আমি ফোন নম্বর দিচ্ছি। তুই আগামীকাল ফোন করে ওর সাথে কথা বলে নিস।
আমি হাসানের কাছ থেকে রিনির মোবাইল নম্বর নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
খুব টেনশন নিয়ে সকালে রিনিকে ফোন দিলাম। কয়েকবার রিং হবার পর সে ফোন রিসিভ করলো।
-হ্যালো, কে বলছেন?
-আপনি কি রিনি বলছেন? আমি আনিস বলছি।
-ও আচ্ছা, তা আমার নম্বর পেলেন কার কাছ থেকে?
-হাসানের কাছ থেকে নিয়েছি। আপনাকে একটা জরুরি কথা বলতে চাই। আপনার কি সময় হবে?
-বলুন, আমি শুনছি।
-আসলে গতকাল আপনার সাথে আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি। আপনার হাত ধরে আমি মিথ্যা অভিনয় করেছি। আসলে আমি হাতদেখতে জানি না। হাসানের কাছ থেকে আগেই আপনার জীবনের কষ্টের ঘটনাটা জেনেছিলাম। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো আপনার হাতটা ধরতে। তাই এরকম মিথ্যা হাতদেখার অভিনয় করেছি!
-আপনি তো দেখছি চরম খারাপ একজন মানুষ! এরকম প্রতারণা নিশ্চয়ই অনেক মেয়ের সাথেই করেছেন, তাই না?
-প্লিজ, এভাবে বলবেন না! আমি এই প্রথম কোনো মেয়ের হাত ধরেছি। আসলে আপনার সুন্দর, ফর্সা হাত দেখে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কিছুক্ষণের জন্য হলেও হাতটা ধরতে!
-আপনার সাথে কথা বলতে আমার খুব ঘেন্না হচ্ছে! ইউ আর অ্যা ফ্রড! আপনি কোনোদিন আর আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না। আই হেইট ইউ আনিস সাহেব!
রিনি ফোন রেখে দিয়েছে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কী কঠিন, কঠিন কথা সে আমাকে শোনাল! নিজের প্রতি কেমন জানি একধরনের ঘৃণা কাজ করছে! কিছুই ভালো লাগছে না। অফিসে যাওয়ার মত মনের অবস্থা নেই। এনজিওতে চাকরি করি। সাত মাস হল জয়েন করেছি। না গেলে ম্যানেজার খুব রাগারাগি করবে। বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেলে চেপে বসলাম। ভুলে হেলমেট ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছি। আমার অফিস মূল শহর থেকে বাইরে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে খুব জোরে চালাচ্ছি মোটরসাইকেল। আমার মাথায় কেবল রিনির সেই অপমানজনক কথাগুলো হাতুড়ি পেটাচ্ছে। হঠাৎ ব্রেক ফেল করে একটা গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে রাস্তার নিচে পড়ে গেলাম! আমার আর কিছুই মনে নেই।
চার
হাসপাতালে শুয়ে আছি। সারা শরীরে তীব্র ব্যথা। মাথায় চারটা সেলাই লেগেছে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি। হাসান আমার কানের কাছে আস্তে আস্তে বললো, রিনি দেখা করতে এসেছে তোর সাথে। সে কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করছে। তুই অনুমতি দিলে ভেতরে আসবে। তোর এক্সিডেন্টের খবর শুনে বেচারি কেঁদে অস্থির। আমি বললাম, তাকে আসতে বল ভেতরে। তাজা গোলাপের একটা তোড়া আর কিছু ফল নিয়ে রিনি ভেতরে ঢুকলো। হাসান আমাকে ধরে বিছানা থেকে তুলে বসিয়ে দিল। সে বললো, তোরা কথা বল। আমি বাইরে আছি।
রিনি আমার হাত ধরে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। সে কোনো কথাই বলতে পারছে না। তার কান্না দেখে আমারও কান্না পাচ্ছে। সে ধরাগলায় বললো, আনিস, আমিই মনে হয় তোমার এই এক্সিডেন্টের জন্য দায়ী। সকালে ফোনে তোমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করেছি। আমি আর কোনোদিন তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবো না। প্লিজ, তুমি আমার ওপর রাগ করে থেকো না। ধীরগলায় বললাম, তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই রিনি। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি!
আমার কথায় রিনি খুব লজ্জা পেয়েছে, তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি ফিসফিস করে বললাম, তোমার হাতটা একটু ধরতে দিবে আমাকে? রিনি চোখ মুছে দুই হাত আমার দিকে বাড়িয়ে উত্তর দিল, আনিস, আমার এই হাত তুমি সারাজীবন ধরে রেখো। আমি আর কোনোদিন তোমাকে কষ্ট দিবো না। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি, খু-উ-ব!