
পদ্মপুকুর। প্রতীকী ছবি
গাঁয়ের ধারে বহু পুরনো এক পুকুর।
এক প্রজাদরদি জমিদার বহুকাল আগে জনগণের জলসমস্যা দূর করার জন্য এ পুকুর খনন করিয়েছিলেন। অনেক গভীর ছিল সেই খনন। খনন শ্রমিকেরা বলেছিলেন, পুকুরের তল গভীর না হলে জলও ভালো হয় না। ভালো তলপুকুর মানেই ভালো জলপুকুর। সত্যিই তাই। খননের পরে পুকুরের গভীর গর্ভ টলটলে জলে ভরতি হয়ে গেল। জমিদার তার মাঝে পদ্মের বীজ আর মাছের পোনা ছেড়ে দিলেন। ভাবলেন পুকুর মানে তো শুধু জলাধার নয়, তা মানুষ আর প্রকৃতির অংশ। লোকে জল পান করবে, জলে স্নান করবে, বড়শি আর জাল দিয়ে মাছ ধরবে, আবার জলের বুকে প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের শোভাও দেখবে।
একসময় পুকুর জুড়ে পদ্ম ফুটতে লাগল। পুকুরের নাম হলো পদ্মপুকুর। মাছও হলো প্রচুর; কিন্তু মৎস্যপুকুর নাম হলো না। এতে জলটলমল পদ্মপুকুরের খুব আনন্দ হলো আর মৎস্যের জলাধার হিসেবে তলপুকুরের খুব রাগ হলো।
এদিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পুকুর ব্যবহার করলেও তার কোনো সংস্কার করল না। দিনে দিনে পুকুরের তলদেশে স্তরে স্তরে পাঁক জমতে থাকল। তলপুকুর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে, অকৃতজ্ঞ মানুষ, বছরভর খালি মাছ তুলে নিস কিন্তু একদিনও পাঁক তুলিস না! দেখি, পাঁকের মধ্যে কী করে এত স্বাদের মাছ জন্মায়! মাছ আর তোদের খেতে হবে না।
পাঁকের কারণে পুকুরে মাছের বংশ ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগল। লোকে আর তেমন মাছ ধরতে আসে না।
তবে পাঁক জমতে থাকার পরও পুকুরে পদ্ম ফোটায় কোনো বিরাম হলো না। কারণ পদ্ম তো পাঁকেই ফোটে! কাজেই মাছ না পাওয়া গেলেও পদ্মপুকুর নামটি বহাল তবিয়তে টিকে থাকে। লোকে ঐ এলাকাকে পদ্মপুকুরের নামেই চিহ্নিত করে। বলে পদ্মপুকুরের ঘাট, পদ্মপুকুরের জল, পদ্মপুকুরের গাঁ ইত্যাদি। ওদিকে পুকুরের তলদেশ অর্থাৎ তলপুকুরের মেজাজ খুব খারাপ থাকে। পদ্মপুকুরের নামে ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে যায় তলপুকুরের মন। ভাবল, পুকুরের জলটাকে শুকিয়ে দিতে পারলে বেশ হয়। তাহলে ওর পদ্ম ফোটার সুখ বেরিয়ে যেত।
একদিন দুজন প্রবীণ ব্যক্তি পুকুর ঘাটে এলেন। এদের একজন ধর্মগুরু পুরোহিত আর-একজন ধর্মপ্রাণ মুসল্লি। পুরোহিত এসেছেন পুজোর নৈবেদ্যের জন্য পদ্মকলি সংগ্রহ করতে, আর মুসল্লি এসেছেন নামাজের জন্য অজু করতে।
পুরোহিত বললেন, এই পদ্মপুকুরটি ছিল বলে মন্দিরে দেবীর চরণে নিত্য পুষ্প নৈবেদ্য দিতে পারি। আমার পূর্বপুরুষও এ পুকুরের পদ্মফুল দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়েছেন। পুকুরটি দীর্ঘায়ু হোক।
মুসল্লি বললেন, কত পুরনো এই পুকুর। এত পাঁক জমেছে তবু পানির কমতি নেই। পানিটা ছিল বলে গাঁয়ের লোকের অজু গোসলের কোনো সমস্যা হয় না। পুকুরটি আরও বহুকাল বেঁচে থাকুক।
পুরোহিত বললেন, জলের সমস্যা নেই, তা ঠিক; কিন্তু মাছ তো আর আগের মতো হয় না। বিস্তর পাঁক জমে গেছে!
মুসল্লি বললেন, তাতে কী! পাঁকে তো পদ্ম ফুটছে। পদ্মে মধু জমছে। মৌমাছি তা সংগ্রহ করছে। পুকুর তো অকেজো হয়নি। প্রকৃতির সৃষ্টিচক্রের সাথে সম্পৃক্ত আছে!
পুরোহিত বলেন, আপনি ঠিক বলেছেন। তিনি দুটি পদ্মকলি তুলে ঘাটের এক পাশে রেখে নিজের পাদুকাজোড়া পুকুরের জলে ভালো করে ধুয়ে নিলেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চষা খেতের ওপর দিয়ে আসার সময় তাঁর পাদুকা দুটি কাদামাটিতে লেপ্টে গিয়েছিল।
মুসল্লিও ভালো করে হাতমুখ প্রক্ষালন করলেন। পুকুরের মাটি তুলে দাঁত মাজলেন। বারবার গলা খাকারি দিয়ে বুকে জমে থাকা কফ শ্লেষ্মা পুকুরের জলে নিক্ষেপ করে হাত দিয়ে তা সরিয়ে পরিষ্কার জল নিয়ে কুলকুচো করলেন।
এরপর মুসল্লি এক বদনা জল নিলেন আর পুরোহিত অঞ্জলিতে পদ্ম নিয়ে পুকুরটির জন্য শুভকামনা জানিয়ে ঘাট ছেড়ে চলে গেলেন।
এতক্ষণ দুই প্রবীণ ব্যক্তির কথা শুনেছে পুকুর। পুকুরের জল ভাবল ওঁরা তারই প্রশংসা করেছে। বলেছেন পদ্মপুকুর দীর্ঘায়ু হোক। পুকুরের তল ভাবল বাহ, এরা তো আমারই প্রশংসা করে গেল। আমার ভাণ্ডারেই আছে জল ও পাঁক। এই দুইয়ের জন্যই ফুটছে পদ্ম।
জল ঢেউ তুলে কলকল করে খুশিভরা গলায় তলকে বলল, শুনলি তো ওরা কী বলে গেল! তোর তলাভরা পাঁক, তারপরেও আমি আছি বলে লোকে জল পাচ্ছে। আমি আছি বলে পদ্মও আছে!
তল এ কথা শুনে বলে, তুই তো চোখেও কানা, কানেও খাটো আর বুদ্ধিতেও মাঠো! দেখলি না, মুসল্লি তোর গায়ে কফ থুতু ছুড়ে মারল। তোকে কী পেন্নামটাই না করল! হুহ! আর শুনলিও না, ওরা যে বলে গেল আমি তলপুকুর আছি বলেই এখানে পাঁক আছে, তুইও আছিস, তাই পদ্মও আছে। বুঝলিও না ওরা তোকে না আমাকেই মূল্য দিয়েছে!
জলপুকুর বলল, হ্যাঁ, তোকে তো মূল্য দিয়েছেই! আর সে মূল্য হলো পুরোহিতের জুতোর তলার কাদা! হিহিহি। দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে দেখ না আজ কতটা পাঁক তুই বুকে জমিয়ে রাখলি! নাকি, পাঁক না, ওগুলো পুরুত ঠাকুরের চরণামৃত! খিক খিক করে হাসে জলপুকুর।
এরপর জল আর তলের মধ্যে মহা তর্ক লেগে গেল।
জল বলে, ভালো করে শুনে রাখ তল, আমার জন্যই তুই বেঁচে আছিস। আমার জন্যই তুই জলাধার। আমার জন্যই নাম হয়েছে পদ্মপুকুর। কারণ আমার ওপরে পদ্ম ভাসে। ওর পাপড়িতে সূর্যের আলো চিকমিক করে আর ঢেউয়ের কণায় চাঁদের কিরণ ঝলকায়। কলির ওপরে উড়ে আসে প্রজাপতি আর মৌমাছি। বাতাসে ওরা মাথা দুলিয়ে নাচে। কী সুন্দর লাগে দেখতে!
তল বলে, আমি তোর আধার না হলে কোথায় থাকতি তুই, কোথায় দাঁড়াত তোর মৃণাল, পদ্মই বা ফুটত কীভাবে? চাঁদসুরুজই বা দেখতিস কী করে। আর পেরজাপতি ভোমরা? হুহ্! ওদের তো চোখেও দেখতিস না। আরে, আমি ছাড়া তো তোর পায়ের তলায় মাটিই নেই! কিছুই নেই! সব বাষ্প! ধোঁয়া! মায়া!
আর তোর? জল বলে। আমি ছাড়া তুই তো একটা শুকনো খাদ! থকথকে পাঁকভরা এক গর্ত! জল ছাড়া তোকে লোকে পুকুর বলতে যাবে কোন দুঃখে? তিনদিনেই তুই হয়ে উঠবি মস্ত ভাগাড়! মলমূত্র আবর্জনায় ভরা থাকবে তোর সাধের তল!
তল বলে, বটে! এত বড় কথা! দেখা যাক! আমি ছাড়া তোর কী দশা হয়!
তল রেগেমেগে ভুকভুক করতে করতে একটা ধারালো ঝিনুক নিল। এরপর পুকুরের সবচেয়ে বড় পদ্মের ডাঁটার গোড়াটা কুচুৎ করে কেটে দিল। সেই সাথে একপাশে পাঁক সরিয়ে মাটিতে একটা সুড়ঙ্গ কেটে দিল।
এই বড় পদ্মটি ছিল পুকুরের হৃৎপদ্ম। সুড়ঙ্গ পথে পুকুরের জল শোঁ শোঁ করে ঢুকে যেতে লাগল। হৃৎপদ্মও সেই স্রোতের টানে সুড়ঙ্গের দিকে যেতে লাগল।
জল তার ঘূর্ণিপাকের গোল গোল চোখ পাকিয়ে তলকে শাসায়, দেখ তল, তুই কিন্তু নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারলি! এখন থাকবি পদ্মপুকুরের বদলে পাঁকের পুকুর হয়ে!
তল ততক্ষণে কথা বলার জলকণ্ঠ অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে। পাঁকভরা গলায় ভুকভুক করে ব্যঙ্গের স্বরে বলে, হুহ! হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল! তুই তো থাকবি এখন অন্ধকার সুড়ঙ্গের পচা কুয়োয় শুয়ে! দেখব তোর ওপরে চাঁদই বা কীভাবে আলো দেয়, পদ্মই বা কী করে ভাসে!
সুড়ঙ্গপথে ঢুকে যেতে যেতে জল পুকুরের প্রায় তলায় এসে ঠেকল। জল সরে যাওয়াতে পাঁকগুলো তলের চারপাশে ভুস ভুস করতে লাগল। যা কিছু মাছ তখনো অবশিষ্ট ছিল সবই দাপাদাপি করে কাদামাখামাখি হয়ে মরে পড়ে রইল।
ওদিকে সুড়ঙ্গের ভেতরে জলও আর দম নিতে পারছিল না। কারণ জলের টানে পদ্মেরাও ঢুকে যাচ্ছিল সুড়ঙ্গে। ফলে সুড়ঙ্গটি জটাজালে ভরে যাচ্ছিল। স্রোত যাচ্ছিল মন্থর হয়ে। হঠাৎ জলের স্রোতটা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। দেখা গেল সুড়ঙ্গের ভেতরে পুরো মৃণাল ঢুকে গেলেও ঝলমলে বড় হৃৎপদ্মটা সুড়ঙ্গের মুখে এসে আটকে গেছে। ধবধবে সাদা জোছনার আভা ছড়ানো পাপড়িগুলো পাঁকের ছোবলে নেতিয়ে পড়েছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে পদ্ম বলে, মূর্খের মতো ঝগড়া করে তোরা নিজের আত্মাকে খুন করলি!
পদ্মপুকুরের শেষ জলটুকু ছিদ্রপথে বেরিয়ে গেলে হৃৎপদ্মকে আর দেখা গেল না! কারণ ততক্ষণে পাঁক এসে ঢেকে দিয়েছে সুড়ঙ্গের মুখ। আর তাতে চাপা পড়েছে গোটা হৃৎপদ্ম।