এক
হাজার হাজার মাইল পথ উড়ে এসেছে মীরা। কোলাহলমুক্ত পাড়া হতে একেবারে ভরা মজলিসে। বাড়ি তো না গুরুদাসপুরের হাট যেন। মনে মনে খুব বিরক্ত মীরা। মায়ের সব বোনরা দল বেঁধে এসেছেন, সারাক্ষণ আমমাছি হয়ে চারপাশে ভন ভন করছেন তারা।
অথচ মীরা ঘুমাতে চায়, বিলের মরা কলমির ডালগুলোর মতো বিছানায় জাঁক হয়ে শুয়ে থাকতে চায় শুধু। ঢেঁকিতে আজলদীঘা ধান ফেলা হয়েছে। গোটা বাড়ি ধুপ ধুপ শব্দের তালে উঠছে আর নামছে যেন। সেই সকাল থেকে মীরা দোতলায় দাদির ঘরে শুয়ে শুয়ে ফোনের টেক্সটগুলোর উত্তর দিচ্ছে। একবার শামীমকে লিখছে তো আর একবার জোনাসকে। শামীম জরুরি আলাপ সেরেই বিদায় নিলো; কিন্তু জোনাস মীরাকে দোতলাসুদ্ধ তুলে নিয়ে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল! লম্বা বাহু সমান সোনালি চুল জোনাসের। সেই চুল সমুদ্রের জলে ভেজা। তাতে মীরার আঙুল হরপ্পার কাল হতে খেলছে যেন। বাল্টিক সমুদ্রে কায়াকিং করে আসা জোনাসের গোলাপি মুখে মীরা বাবলা ফুলের মতো নরোম চুমু খেতে থাকে অবিরল। সেই প্রথম দিনের কথা আজও ওরা লিখছে অধীর আবেগে। চুমুর ইমোগুলো এত বেশি ওদের হোয়াটসঅ্যাপে, মাঝে মাঝে মীরা ভয় পায় এই বাবলাফুল চুমুগুলো যদি থেমে যায়?
শামীমের সঙ্গে ওর নিরাসক্ত সংসার। বিবর্ণ পরিত্যক্ত খেয়াঘাটের মতোন। শামীমের যেমন সোহেলী আছে, তেমনি ওর আছে জোনাস। বিয়ের চৌদ্দ বছরের মাথায় শামীম কাজ পেলো ডেনমার্কের ইশয় শহরে। মীরা তখন রাজশাহীর একটা কলেজে ইতিহাস পড়ায়। সব ছেড়ে দিয়ে ভিনদেশি ভাষার শহরে এসে পৌঁছেছিল যেদিন, কে ভেবেছিল সেদিন জোনাস নামে কেউ একজন আসবে ওর নিরালা জীবনে। খুব মন খারাপ থাকতো। সকাল, দুপুর, সন্ধে মরা কাঠের মতো বিছানায় শুয়ে কাঁদতো শুধু। কতবার যে স্যুটকেস গুছিয়ে তৈরি হতো আর শামীম ফিরলেই বলতো, ‘আমাকে এক্ষুনি প্লেনে তুলে দাও’। ওর কথায় মোটেও বিচলিত হতো না সে। উল্টো বিছানায় তুলে নিতো। বিবাগী শরীরটাকে ছত্রখান করে ফেলতো নিমিষে। সেই অমানুষিক শরীরি জুয়ো খেলার দিনগুলোর কথা ভাবলে, আজও শিউরে ওঠে মীরা।
পশ্চিমের জানালা দিয়ে বুক খাঁ খাঁ করা হাওয়া ঢুকছে। সঙ্গে তেঁতুলের হলদে মিহি পাতারাও লাল মেঝেতে উদাস উদাস তরঙ্গে দুলতে দুলতে পড়ছে। মীরার অলস দৃষ্টি জানালার ওপাশের মাঠ ছাড়িয়ে গণেশের খোলার জোড়া তাল গাছের মাথায় গিয়ে আটকালো। চৈত্র মাসের পয়লা দিন আজ। কলাইয়ের ক্ষেত এখনো কিছুটা সবুজে মাখো মাখো। মাঠের এ পাশটা রসুনের আবাদে ভরে যায়নি। এ পাড়ার বেশ কিছু বাড়ির লোকরা এখনো মহিষ পালে। তাদের ডাক শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে। মীরা কান খাড়া করে আরও। মহিষের দল নদীতে নামবে, সারা দুপুর সন্ধে ঘোলা জলে কাদায় হুটোপুটি খাবে, চোখ বুজে জাবর কাটবে। দু-একটা শালিক এসে গায়ের পোকা খুঁটে দেবে। মীরার মাঝে মাঝে ওই ঘোলা কাদা জলে মহিষের মতো শরীর এলিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে!
নেতানো শরীরটাকে জোর করে তুলে বারান্দার মোড়াটায় বসাল। ইতিমধ্যে নিচে টালির রান্নাঘর থেকে সুস্বাদু রান্নার চনমনে ঘ্রাণ উঠে আসছে। সজনে ডাল ফোড়নে পড়লো বুঝি। বড় খালা ডালে লেবু পাতা দেবেই দেবে। লম্বা শ্বাস নিলো মীরা। কত দিন, কত দিন পর আহা! উঠোনে মা বটি মান পাতা ফেলে মাছ কুঁটছে। পাশেই কালো হুলোটা ম্যাও ম্যাও করছে একটু পর পর। বাড়ির কলতলায় কার যেনো মাথা ন্যাড়া করা হচ্ছে- একটা মিষ্টি কোরাস শোনা যাচ্ছে ওদিকে।
আসো ভানু গোসল করিতে যাবো কি নারে, মাধব রাজা...
ঠিক এই সুরে এই মাধব রাজা শুনতে শুনতে ওদের মাথাও ন্যাড়া করে দিতো দাদি। পুরনো কুয়ো তলার পাশেই টিউবওয়েল পাতা হয়েছিল যুদ্ধের বছর দুয়েক পর। সাত আটটা সুপারির গাছ এখনো ঋজু হয়ে আছে কলতলায়। দাদি চৈত্র মাসে ব্লাউজ পরতো না। ধবধবে সাদা আর লবঙ্গ রঙের চিকন পাড়ের তাঁতের শাড়ি মাজায় পেঁচিয়ে সারা বাড়ি ছুটে ছুটে কাজ করতো। পরিষ্কার মনে আছে মীরার যেদিন ওর আব্বা মারা গেলেন দাদি রোদে কলতলায় গোসল করছিল। খবরটা দাদিকে কে দিয়েছিল জানে না। মীরার শুধু মনে আছে ভেজা কাপড়ে দাদি বলছিল, ‘বড় গ্যাদারে বুকের ভেতর আনি দ্যাও তোমরা, দুধ জমি পাত্থর হলিপারে কে খাবিনি?’
আব্বার ব্যস্তবাগীস চলাফেরা একটু চোখ বুজলেই দেখতে পায় মীরা। বাইর বাড়ির ঘরটা তখন টালির ছিল। পাকা বনের বেড়া আর মাটির মেঝে। তাতে সারি সারি বাঁশের চার বসানো। সকাল, বিকাল দু’বেলার ছাত্র ছিল তার। অঙ্কের মাথা ছিল ভীষণ ভালো আব্বার। দূর দূর গাঁ গ্রাম থেকে আসতো ওদের বাড়ি অঙ্ক পড়তে ছাত্ররা। স্কুল, ছাত্র ইত্যাদি সামলে গোয়ালে গাই পুষতো, ধানের দিনে চরায় কামলাদের ভাত নিয়ে যেতো, মা’র শিমের মাচার জন্য বাঁশ কাটতো সময়মতো- এত কাজ আব্বা কীভাবে করতেন কে জানে! শুধু মনে পড়ে চশমা মুছতে মুছতে আব্বা সবাইকে বলতেন,
‘অঙ্ক জানাটা খুউব জরুরি বুঝলুরে তোরা! নাইলে কিন্তু ঠকি যাবা জীবনভর!’
সেই বাইর বাড়ির ঘরটায় এখন হ্যারো মেশিন রাখা হয়। কাকা শোরগোল করতে করতে বাড়ি এলো। বেশ বড় বড় কয়েকটা শোল মাছ ধরে এনেছে। খুশির ঝিলিক চোখে মুখে তার। মাকে মাছ কুটতে দেখে রে রে করে উঠলো-
‘তুমি এখনো মাছ কুটতিছ্যাও? মাজা ধরি যাবিনি, উঠো উঠো। বাকিগুলান আমি কুটতিছি, ডুব ম্লান দিয়ে মীরা, বিপুলদের নিয়ে ভাত খাও আগে।’
মীরা দেখলো মা সত্যি সত্যি ছাই আঁশ মাখা হাত ঝাড়া দিয়ে ঠোঁটে মধুর হাসি তুলে কলতলার দিকে গেলো। কাকা শোল মাছগুলো মাটিতে বিছিয়ে ছাই মেখে কুটতে লাগলো পটাপট। এই দৃশ্য ওর জন্য রীতিমতো চমক! এমন সাংসারিক কাজে কাকার সহজ ঢুকে পড়া, মা’র মধ্যবয়সী শরীরটার এত খেয়াল রাখা সবই মনে প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। এই খেয়াল ওরা ভাই বোন তো নিতে পারে নাই, এমনকি আব্বাকেও দেখেনি তেমন নিতে। কলতলায় সুপারি পাতার ছায়া দোল খাচ্ছে। দারুণ হাওয়া চারপাশে। মা’র হাসি সুপারি পাতার মতো দুলছে, এত সুন্দর হাসতে পারে মা? জানতো না তো কোন দিন। নাকি খেয়াল করেনি আগে।
দুই
থই থই জল। যত দূর দৃষ্টি তত দূর। চল্লালী, কচুগাড়ি, ঝাঁকড়া, সবখানে যাওয়ার একটাই পথ, এই রাশি রাশি জলপথ। কাকার বউ দেখতে গেছে দাদি, মা, কাকিরা দল বেঁধে। নাটোর কলেজে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে সারাদিন টই টই করে নাও নিয়ে বিলে পাথারে ঘোরে কাকা। মীরার ক্লাসের মলিনার কাছ থেকে খবরটা শোনার পর থেকে কাটা আলু লতা হয়ে গেছিল। ওদের বাড়িতে পড়তেও আসেনি দু’দিন হলো। দাদির জন্য পাটের শাক তুলে বাড়ি ফিরছিল মীরা। প্রতি মাসে একটা দু’টো করে রোজা রাখেন তিনি। সন্ধেবেলা পাটের শাক আর হাঁসের ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে দাদি বাড়ির সবার চুল বেনি করতে বসবে। মীরার এই ক্লাস সিক্সেই কোমর ছুঁই ছুঁই চুল। শ্রাবণ মাসের পড়ন্ত বেলা। ষষ্ঠীদের রাজহাঁসগুলো রাস্তায়। ওইটুকু তো শরীর; কিন্তু গলার কী তেজ! উল্টোদিক থেকে দিনেশ আসছে সাইকেলে। ডাকবে কি-না ভাবছে মীরা। ডাকতে হলো না, তার আগেই দিনেশ নিজে থেকে সাইকেল থামিয়ে ছাতিম তলায় দাঁড়ানো মীরাকে দেখে বললো-
‘ষষ্ঠীদের রাজহাঁস পাজির পা ঝাড়া, চলো তুমাক বাড়ি দিয়ে আসি গে।’
কয়েকশো কবুতর উড়লো একসঙ্গে মীরার বুকের ভেতরে। জলপাই রঙের ফ্রকটাতে কেউ পাল তুলে দিল যেন। মীরা উড়তে উড়তে এলো পথটুকু। বাড়ির দুরন্ত সাদা বাছুর মীরাকে দেখে কয়েক পাক নেচে লেজ তুলে পালালো ধাঁই করে।
‘তোমার কাকার বিয়ে না-কি?’
এমনই কিছু একটা বলেছিল দিনেশ; কিন্তু বিয়ে শব্দটুকু লাল করেছিল মীরাকে। আর কিছু শোনেনি। দিনেশ আব্বার সেরা ছাত্র। কালে ভদ্রে কথা হয় ওদের। মীরার পেছন ফিরে তাকানোর শক্তি, সাহস কোনোটাই হলো না। বাছুরটাকে জড়িয়ে কতগুলো চুমু খেল শুধু। এই একরত্তি বাছুরটার মতো সারা বাড়ি দৌড়াতে ইচ্ছে হলো। একটা নতুন নাও আলকাতরা মাখিয়ে উপুড় করে রাখা বাইর বাড়িতে। মীরার মুখটা হঠাৎ ওই রকম কালো হয়ে গেলো একটা কথা মনে হতে। দিনেশকে নিয়ে ওর বুক তোলপাড় ভালোলাগা যেভাবেই হোক লুকিয়ে রাখতে হবে। মলিনার সঙ্গে একদিনই গিয়েছিল দিনেশদের পাড়ায়। মুড়ি ভাজার ঝাঁঝরা পাতিল আনতে। দিনেশের মা সেদিন ওদের মোয়া খেতে দিয়েছিল। আর বলেছিল- চলে যাবে দিনেশের পিসির কাছে, মালদাতে। সেখানে না-কি ভালো থাকবে ওরা। সেই রাতেই মীরা রক্ত স্রোতে প্রথম ভাসে। দাদি সকালে ধোয়া শাড়ি কেটে দেখিয়ে দিয়েছিল সব। ঘি মাখা ভাত খেলো তিন বেলা। মা খালি একটু পর পর জিজ্ঞেস করতো, ও মীরা পেটব্যথা কমিছে!
কাকার বিয়ে করা হয়নি সেবার। কত যুগ যুগান্তর আগের কথা যেন। সব মনে আছে মীরার। পুরো গুরুদাসপুরের মানুষে বাড়ি ভরে গেছিল সেদিন। আর আসবেই বা না কেন? যে সে পতন তো ছিল না, আসগর মাস্টার, অঙ্কের জাহাজ একটা বটবৃক্ষের মতো মানুষ মরে গেলে যা হয়- উঠোনে আউশ ধানের আঁটিতে তখনো ধানের শীষগুলো নতজানু। কেউ একজন কবুতর তাড়ালো, বস্তা খুঁজে আঁটিগুলো ঢেকে দিল যত্ন করে। আর আব্বার বরফ শীতল শরীরটা ধানের বোঝার পাশেই নামালো ওরা। বারান্দায় আমসত্ত্ব খাচ্ছিল ওরা দু’ভাই-বোন। মা রান্না করছিল সেদিন। অষ্টমনিষার হাট বার। কাকা পাট কিনতে গেছিল। ষষ্ঠীদের পুকুরের হিজল গাছে চড়ক পাখিটা ডেকেই যাচ্ছিল একনাগাড়ে।
চড়ক! চড়ক! চড়ক!
আব্বা যে এত তাড়াতাড়ি মরে যাবে কেউ বোঝেনি। আব্বাদের মৃত্যু হবে একশো বছর পরে। মীরা তাই জানতো সে সময়। মানুষের আব্বাদের ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতো ওরা দু’ভাই-বোন তখন। কত সন্ধ্যা মনে হতো আব্বা বুঝি মির্জাপুর গেছে। আব্বা বুঝি নাটোর গেছে, রাজশাহী গেছে। হয়তো আরও দূরে গেছে। ওরা ঘুমিয়ে গেলেই সাইকেলের ঘন্টাটা বাজিয়ে আব্বা বাড়ি ফিরবে হয়তো। ধীরে ধীরে সব কিছু শান্ত হয়ে আসে। জীবনের শোকগুলো ওদের কুয়োর মতো মুখবন্ধ, জলবদ্ধ। ব্যবহার নেই; কিন্তু গর্তটা আছে, থাকে।
মীরার বড় ভাই আব্বার পাঞ্জাবি, শার্ট পরা শুরু করলো, যখন দাদির ঘরে ঢুকে কাঁদতো লুকিয়ে লুকিয়ে ও। দাদি দিন-রাত তসবি জপতে ন্যস্ত হলো। পীরের বাড়ি যেত ঘন ঘন। কাঁদতে দেখলেই ছুটে আসত এঁড়ে ষাড়ের মতো শিং বাগিয়ে-
‘আমার মরা ছাওয়ালটারে কষ্ট দিচ্ছু, মুছি ফেল চোখ।’
পীরের চুল, পীরের সাবান জায়নামাজের কোণে রাখা থাকতো তার, দোয়া পড়ে তাতে চুমু খেতো। মীরার বমি পেতো তাই দেখে। জলজ্যান্ত ছেলে মরা মা তাই চুপচাপ কথা শুনতো সবাই। তাছাড়া দাদির বাপের বাড়ির লোকরা একসময় জমিদার ছিল। সেই তেজ আর ঠমক চোখে-মুখে লেগে থাকতো সারাক্ষণ। কাকার বিয়ে হয়নি সে বছর; কিন্তু পরের বছর মায়ের বিয়ে হলো। মানে বিয়ে দেওয়া হলো কাকার সঙ্গে। দাদির সিদ্ধান্তে কে বাগড়া দেবে? সেই সাহস কারো ছিল না। কাকা পাশও করতে পারেনি ডিগ্রি আর সংসারটা এমনিতেই ঘাড়ে এসে পড়েছিল। মা কি বলবে। দাদির চক্ষু হেলনে মা’র চোখ হেলে। দাদির ঠোঁটে মা’র ঠোঁট নড়ে। সংসারটা দাদিই আগাপাশতলা চালাতো। আর সবাই ছিল কল দেয়া পুতুল মাত্র।
বড় ভাই বিয়ের পর দিনই চলে গেলো রাজশাহী, মেঝ খালার বাড়ি। আর কাকা সেই নতুন নৌকাটা নিয়ে সারা দিন কই কই ঘুরতো। সন্ধ্যেবেলা নিচু মাথায় বাড়ি ফিরলেই দাদি কাকাকে ভাত খাওয়াতো মাকে পাশে বসিয়ে। মীরা দেখতো কাকার মাথাটা দিন দিন থালার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রায়। মা কেমন অন্য মানুষ হয়ে ঘুরতো বাড়ির ভেতর। মীরা স্কুলে গেলে মলিনা বলতো,
‘কাকারে এখন কী বলে ডাকিস ?’
ক্লাস নাইনে ওঠার পর ওদের ছোট ভাই জন্ম নিল। মাকে কী খুশি খুশি লাগতো তখন। মীরার বুকটা ফেটে যেতো অভিমানে, অজানা ব্যথায়। মনে হতো ও যদি দিনেশের সঙ্গে চলে যেতে পারতো মালদায়! মায়ের জীবনে কাকার অনুপ্রবেশটা পাল্টে দিয়েছিল প্রত্যেককে। শুধু দাদি বাদে। তার ছোট ব্যাটার ব্যাটা জন্ম নিয়েছে, সেই নিয়ে ঘুম নেই চোখে তার। বড় ভাইয়ের নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখা হলো বিপ্লবের ভাই বিপুল। দাদিকে মনে মনে প্রচুর গালি দিতো মীরা পুকুর ঘাটে গিয়ে। জলের তলায় ডুব দিয়ে বলতো, বুড়ি শয়তান।
লোকে বলাবলি করতো, পীরের ইশায়ার চলে না-কি দাদি। আর ওদের বাড়ি চলে দাদির ইশারায়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মীরা দাদির প্রতি প্রসন্ন হতে থাকে। বড় ভাই বাড়িমুখো না হলেও মীরার বিয়ের সময় অন্তর দিয়ে খেটেছিল সে। মার সঙ্গে বা কাকার সঙ্গে ওরা এমনভাবে কথা বলতো, যেন দূর্বাঘাস কথা বলছে তালগাছের সঙ্গে। সে কথা আবার নিত্য দরকারের কথা। প্রাণের ভেতরকার কোনো কথাই ছিল না আর। কাছে থেকেও মা হয়ে গেল ছানা ছাড়া কুঁচে মুরগি।
মীরা এই এত বছর পর প্রথম নতুন করে মা’কে আবিষ্কার করতে পারলো। তাও পারতো কি-না কে জানে? যদি না জোনাসের সঙ্গে নির্জন সমুদ্রে কায়াকিং করতে যেত। জীবনটা আসলে অনেক পর্দায় ঢাকা থাকে। যখন পর্দাগুলো সরে যায় কী এক অলৌকিক আলোতে ভরে যায় জীবন। মীরা এক সময় বিদেশ চলে যাওয়াকে অভিশপ্ত মনে করেছিল। সেই রাহুকাল একটা নতুন পৃথিবীতে নতুন চাঁদ, তারা সূর্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ওকে। প্রতি মুহূর্তে পর্দা সরে যাওয়া, প্রতি মুহূতে আলোর নিক্বণে বেজে ওঠা।
তিন
পুকুর ঘাটে মা আজ বেশ কিছু পিতলের ঘটি, কলস মাজতে বসেছে। সামনে বিপুলের বিয়ে দেবে। তারই বন্দোবস্ত এসব। মীরা হালকা সাঁতার দিলো। অন্য পাড়ে একটা ছোট নৌকা ডোবানো দেখল। কাল এটাকে তোলাবে ও। হাত দুটি নিশপিশ করছে চালানোর জন্য। এই পুকুর ঘাটেই ওর বিয়ের পর দিন দাদির অন্য একটা দিক প্রকাশ পেয়েছিল। শামীম অভুক্ত কুকুরের মতো খাবলা খাবলি করেছিল সে রাতে। মীরার এত বুদ্ধি তখন ছিল না। বড় ভাইয়ের বন্ধু তার ওপর ভীষণ পড়াশোনা করা ছেলে। এমন সুপাত্র ক’জনের জোটে! ভেবে ভেবে আহ্লাদে আটখানা ছিল ওদের বাড়ির লোকজন। এমনকি পাড়া প্রতিবেশীরাও। তারই ষোলআনা পুষিয়ে নিয়েছিল সুপাত্র। বুকের তাজা জমাট রক্ত দেখে দাদির সে কি চিৎকার!
‘এ কী জালিমের জালিম! গ্যাদিরে দেখি কামড়ায় মারি ফেলিছে!’
মীরার সামনে পুকুর ভরা জল ছিল সেদিন। লজ্জায়, অভিমানে, যন্ত্রনায় ডুবে যেতে চেয়েছিল। দাদির সেই দিনের তাণ্ডবে শামীম বিব্রত হয়েছিল। মীরাকে সে কথা এখনো শোনায়। বিষমাখা শব্দের তীরে বিদ্ধ করে যখন তখন। পীরের ব্যবহৃত সাবানে চুমু খাওয়া দাদির কথা খুব মনে হতো ডেনমার্কে ওর। বাড়ির পাশেই ছিল সিমেট্রি। গোছানো, পরিপাটি ফুলে ফুলে ছাওয়া বিরাট ছিল সে জায়গা। মীরা দাদির কথা, আব্বার কথা মনে করে অজানা অচেনা কবরের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে কাঁদত। একদিন ওই অবস্থারত মীরাকে দেখে যে এসে ওর পাশে বসেছিল, তাকেই দেবদূত মনে হয়। আকাশ থেকে কোনো ফেরেশতা আসেনি দাদির গল্পের মতোন। সোনালি চুলের সবুজ চোখের একটা মানুষ এসেছে কংকর ফেলা জীবনে ওর। জোনাস সে দিন আট মাসের মেয়েকে আর পাঁচ বছরের কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বেড়িয়েছিল। সোনালি চুলগুলো খোপা করা ছিল সেদিন তার। হাতে মোজা পরা ছিল। স্পর্শটা সেদিন পায়নি তবে মনের ভেতর দৈব যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল ওদের ওই দিনই। যতবার মনে করে জোনাসের কথা, তত বার পুলকে ভেসে যায় মীরা। ধরাধামের বাইরে তখন ওর বাস। মায়ের চিৎকারে পুকুর ঘাটের দুনিয়ায় ফিরে এলো ও।
‘ঘটিটা ধর ধর, ডুবে গেলো তো; ও মীরা। ও গ্যাদি!’
মীরা সাত নম্বর সিঁড়িতে গড়াতে থাকা সদ্য মাজা ঝকঝকে দুষ্ট ঘটিটা তুলে নিয়ে মা’কে দিল।
‘তোর আব্বার এটা, নিবি?’
‘তাই, একটা কথা বলি, রাগ করো না কিন্তু; আব্বা না কাকা কারে বেশি ভালোবাসো তুমি?
মা কেমন একটু তাকালো প্রশ্ন শুনে; কিন্তু জবাব যখন দিল টান টান ভরাট গলাতেই দিল-
‘আমি সবারেই ভালোবাসি। তবে তোমার কাকা কিন্তু তোমাগের খুব ভালোবাসে, তারে দূরে ঠেলে রাখলা তুমরা দুই ভাই-বুনে। সে কিন্তু দুধের মতো ধলা মনের মানুষ!’
এই প্রথম মীরা মাকে জড়ায়ে ধরে কাঁদলো। মায়ের গন্ধ নিল নতুন করে। পুরো পুকুর পাড়টাতে চৈত্রের মধ্য দুপুর তখন। কোকিল তার সাথিকে ডাকছে, অন্য পাশ থেকেও সাড়া আসছে।
‘কুউউ, কুউউ, কুউউ!’
বিকেলের দিকে জোনাস লম্বা টেক্সট পাঠালো। তাতে পরিষ্কার বিরহের যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। জোনাসের বোট বাড়িটার কিচেনে মীরার রেখে আসা অর্কিডে ফুল এসেছে। সে সবের ছবি পাঠাচ্ছে মনে করে। জোনাস আজ মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাবে। তবু না-কি মীরার জন্য খারাপ লাগছে তার। জোনাসের এক্স ওয়াইফ একটা মেয়ের সঙ্গে থাকে এখন। প্রথম প্রথম বুঝে উঠতে পারেনি সম্পর্কটা। মীরা বিস্ময় নিয়ে দেখেছে, যা কিছু অসম্ভব ভেবেছিল এদেশে তার সব কিছু সম্ভব ও সুন্দর। কোকিল নেই, শিমুল নেই, পলাশ নেই; কিন্তু প্রেম আছে ওদেশে। সম্পর্কের ভেতর শ্রদ্ধা আছে, পরস্পরকে বুঝতে পাবার মানসিকতা আছে ওই ঠান্ডার দেশে। যা কোনো দিন বুঝতে পারেনি আগে মীরা। এই যে কাকা সারাজীবন দিয়ে দিলো ওদের জন্য, ওর মায়ের জন্য অথচ কী বিপুল অবহেলা করে এসেছে তাকে।
শামীম জগৎ সংসারে বুদ্ধিমান, খ্যাতি যশে চূড়ান্ত মানুষ; কিন্তু মীরা জানে কতটা অপর্যাপ্ত সে, কতটা ভঙ্গুর সে। কী পোকায় ঠাঁসা মস্তিষ্ক তার। মীরা মনে মনে ভাবে মা’র হয়তো বীণা অর্গাজমের বাচ্চা ওরা দু’ভাই বোন। বিপুল জন্মেছে হয়তোবা প্রেমে, তীব্র সুখের কোনো মৈথুন কালে। কাকা আর মায়ের ভেতর এত তফাত, তবু তাদের সুখী ঘরকন্নার এই যে চেহারাখানা, তার রেশ যে কাউকে মুগ্ধ করবে মীরা জানে। সন্ধেটা ম্যাড় ম্যাড়ে কেমন। পাড়ার মাইকে আযান পড়ে গেছে খানিক আগে। তাবড় গরম পড়েছে আজ। তারই ভেতর জোনাসের মেসেজটা বেশ হর্নি করে তুলেছে ওকে। এই নিদারুণ চৈত্রকালে দুই কোকিল দুই প্রান্তে। তবু সাড়া ফেলে দিচ্ছে শরীরে, ইচ্ছায়, পিপাসায়।
চার
পরের দিনের সকাল। নাটোর হয়ে ওদের গাড়ি ছুটছে রাজশাহীর দিকে। পথে পথে কৃষ্ণচূড়ার রঙমাতাল পাপড়ি মেলা আকাশ। মীরার ইচ্ছায় প্রধান সড়ক ছেড়ে একটু শহরতলি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভার। আমের মুকুলগুলোতে বৃষ্টিজল পড়লেই কুঁড়ি আসবে। তবু কি সুগন্ধ বাতাসে! এসবের জন্য ওর প্রাণ উতলা ডেনমার্কে। রসুন, গম, আরও সব রবি শস্য মাঠে মাঠে। মা, কাকাকেও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির পেছনটাতে নানা জিনিসে ঠাঁসা। একটা খাঁচায় দুটি কবুতরও আছে। বড় ভাইয়ের বাড়িতে দেবে সে সব। বিপ্লব এখনো যোগাযোগের অনভ্যাসে বাস করে। তবু মা, কাকা ভালোবাসার কমতি রাখে না। মা, কাকাকে ভাইয়ের বাসায় নামিয়ে ও যাবে সপুরা সিল্কের ব্রাঞ্চে। মা মুখে পান চাবাতে চাবাতে কাকার সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে। কাকার যে অর্ধেক চুল পেকে গেছে আজ দেখলো মীরা। আব্বার মতো মুখের আদল বটে; কিন্তু গায়ের রঙটা পেয়েছে দাদির। স্বল্পভাষী কাকার চোখ দুটোতে সারাক্ষণ শান্ত একটা ভাব। মীরার মনে পড়ে, স্কুলে যাবার পথে ওর সেই না হওয়া কাকীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মলিনাই চুল টেনে বলেছিল-
‘এই দ্যাখ সেই...’
ক্ষেতের আলের পাশে লাগানো অড়হর গাছ থেকে ফল ছিঁড়ছিল সে। সদ্য বিয়ে হয়েছিল বোধহয়। নাকে বড় একটা নথ পরা ছিল। হাতের চুড়িগুলো ঝুন ঝুন শব্দে মায়ার মতন একটা ছায়ায় জড়িয়ে রেখেছিল তাকে। নতুন বউ হয়তো হয়েছে কারও বাড়ির। মলিনা বয়সে মীরার থেকে বড় ছিল বলেই কিসব জটিল চিন্তা করতো আর খালি বলতো এই বিলের পরে আরেকটা বিলের দেশে চলে যাবে ও। মলিনা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে জানে না মীরা? কলেজে পড়াতো যখন অনেক মেয়ের ভেতর মলিনার মুখ খুঁজে পেতো। মা একটা হালকা ঘুমে ঝুমতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে নাকও ডাকছে তার লঘু তালে। কাকা এরই ফাঁকে কথাটা পাড়লো-
‘তোমার মারে বিদেশ দ্যাখানোর কি কোনো ব্যবস্থা আছে? চক্ষুর দ্যাখা দেখে আসলো, তুমি কোথায় থাকো, কী খাও, না খাও তাই নিয়ে চিন্তায় থাকে।’
‘তাহলে তো পাসপোর্ট করতে হবে মা’র। সে তো আমি কবে বিপুলকে বলেছিলাম।’
‘আচ্ছা, তুমি করাও পাসপোর্ট কাকা! দু’জনেই ঘুরতে আসবা...’
এসব সহজ আলাপের ভেতর দিয়ে মীরা টের পেলো কাকার দরদ ভরা স্নেহের ধারা। মায়ের হাতটা ধরে আছে সে। দাদির বহুল ব্যবহৃত রুলি হাতে মা’র হাতখানা হাঁসের পায়ের পাতার মতো কুঁচকে আছে। নখগুলো মাছ ধোয়া, ডাল-চাল ধোয়ার চোটে শ্রীহারা। এতটুকু যত্ন নেই ত্বকের, নখের তবুও সেই হাত কাকা ছুঁয়ে আছে। নিজের হাতের দিকে দৃষ্টি ফেরাল মীরা। ক্রিম মাখা পেলব ত্বক। নখগুলো পার্লারে গিয়ে নিখুঁত করা, নেইল পলিশ দেওয়া। আসার আগেই নিয়ে গিয়েছিল নেইল পার্লারে মিরেলা। জোনাসের এক্স বউ এখন ওরও বন্ধু। মিরেলা হাসিখুশি মানুষ। প্রাধান্য দিতে পেরেছে নিজের মতামতের, বোধের। কোনো এক ভোরে হঠাৎই বুঝতে পারলো পুরুষের শরীর তাকে আর টানছে না। তৃপ্ত করছে না অমনি সিদ্ধান্ত নিতে পারা, অমনি প্রেমের পার্টনার বদলে ফেলা। তাও একটা নারীর শরীর- এ তো মুখের কথা নয়। কী অবাধ স্বাধীনতার, ভালোবাসার পরিপার্শ্ব পেলে মানুষ এত দূর গিয়ে পৌঁছুতে পারে। মীরা আর ওর ভাই কি-না মায়ের পুনরায় বিয়ে হওয়াটা মেনে নিতে পারেনি। দীর্ঘ দিন একটা গুমোট হাওয়া ওদের বাড়ির সকলকে পেঁচিয়ে রেখেছিল।
বিপুলের মুখে বোল ফুটলে সেই আধো আধো বুলিতে বুবু ডাকটা তরল করে দিয়েছিল মীরাকে। এখন বোঝে দাদির সিদ্ধান্তটা কত সহজ ও সুন্দর ছিল। তাড়াশ থেকে মা’র ভাইরা তো সেই নিয়ে গিয়ে বাড়িতেই দাদির মতো সোহাগ, সঙ্গীবিহীন জীবনের দিকে ঠেলে দিতো মাকে; কিন্তু দাদির সাংঘাতিক জেদের কাছে উড়ে ফুরে গেছে যা, তাই নিয়ে ভাইটা আঁকড়ে থাকলো জীবনভর। ক্বচিৎ ফোনটোনে কথা হয় টয়। নইলে ভুলে যেতে হয় মীরার বড় ভাই বলে কেউ একজন আছে। মা’দের নামিয়ে সপুরা সিল্কের বিল্ডিংটায় ঢুকলো যখন সুন্দর একটা চঞ্চলতা, কথার খই চারপাশে দেখলো মীরা। এ জিনিসটারই কেবল অভাব ইশোয় শহরে। মানুষের চাইতে ওখানে সী-গাল আর বালিহাঁসের দল সবচেয়ে মুখরা। পাঞ্জাবির চত্বরটাতে ঘুরলো দু’এক পাক। দু’টো নিলো ও। কি ভেবে আরও একটা নিল। মায়ের জন্য একটা শাড়ি, মিরেলার জন্য একটু বড় মাপের কুর্তি, দুটো স্কার্ফ এই সব নিল। জোনাসের বোট বাড়ির জন্য যাবে অন্য একটা বুটিকে। সেখানে হাতের সেলাই করা ফুল, নৌকা, হাতি ইত্যাদি নক্সার ভালো বিছানার চাদর আর পর্দা পাওয়া যায়। মনটা ভরে কেনা কাটা করলো মীরা বহু দিন পর। শামীমের সঙ্গে যা পেতেছিল, সেটা সংসার না বলে রণক্ষেত্র বলা ভালো। ঘুম থেকে উঠে যার মুখ আর দেখতে ইচ্ছে হয় না, সেই অপ্রেমের সংসার হতে এবার ও মুক্ত হবে। জোনাসের সঙ্গে ঘোর শীতে কাঁপতে কাঁপতে কায়াকিং করবে এখন থেকে নির্ভয়ে। আইরিশ হুইস্কি খাবে সপ্তাহান্তে, হাতে বানানো সিগারেটও টানবে। বিয়ের জিঞ্জিরে থেকে যা পায়নি, সেটা তো জোনাসের কাছে পেয়েছে ও। শুধু আঙ্গুলের জাদুতে মীরার শরীরের ভেতর লুকিয়ে রাখা গোপন মদের পিপে কেমন খুলে যেতে পারে, সে শুধু জোনাসই আবিষ্কার করতে জানে। সাংঘাতিকভাবেই জানে। বিয়েটা বালা মুছিবত লাগে আজকাল। মনে হয় কেউ একটু খালি মাথায় হাত রাখুক। দাদির মতো কপালে ফুঁ দিক।
অদ্ভুতভাবে দাদি জিকির করতো, সমস্ত শরীর তার দুলতো। ঘুমন্ত মীরার মাথায় ফুঁ দিতো আর বলতো -
‘যা বালা মুছিবত দূর হয়ি যা!
পীরের দোহাই, দোহাই কালামের!
দোহাই মাবুদের!’
জোনাস আর ও যখন দূরে সাইকেল নিয়ে পিকনিক করতে যায়, তখন দাদির গাওয়া মাধব রাজার কথা মনে হয় মীরার। এমন কী শীর্ষ সুখের সময় মীরা মাধব রাজা বলে আঁকড়ে ধরে জোনাসের সোনালি দীঘল চুল।
বুটিকটার দোতলায় ঠান্ডা পানীয়ের দোকান। একটা মেয়েই চালু করেছে না-কি। ডাবের জল আর একটা দই চিড়া নিয়ে বসে আছে ও। জোনাসকে ছবি পাঠালো হোয়াটসঅ্যাপে। বাংলায় লিখলো মাধব রাজা! অনেক চুমুর ইমো সেই সঙ্গে।
পরশু ফিরবে ডেনমার্ক। একদিকে বুকটা ফাঁকা হচ্ছে, অন্যদিকে জোনাসের সঙ্গে দ্রুত দেখা হবে সেই আনন্দে দিশেহারা খানিকটা। শামীম তো বেঁচেই যাবে ও চলে গেলে। সোহেলির সঙ্গে লুকিয়ে ডেট করার বালাই থাকবে না। ডাবের জলে চুমুক দিতে দিতে দৃশ্যগুলো ভেবে নিল পলকে মীরা! আশপাশে তেমন ভীড় নেই খুব একটা। চৈতালী নির্জন দুপুর রাস্তার পরে।
সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরলো ওরা। ঘুম এলো না মীরার চোখে সারা রাত। একটা অংক কষলো শুধু মনে মনে। দাদির দেওয়া গয়নাগুলো মায়ের কাছে রাখা আছে। সেসব এবার বিক্রি করে পয়সাগুলো নিয়ে যাবে। শামীমের কাছ থেকে বের হলে তো হবে না শুধু, হাতে পর্যাপ্ত টাকা চাই ওর। জোনাস যতই ভালোবাসুক, যতই সাসটেইনেবল জীবনে বাঁচুক কিছু চাহিদা তো আলাদা, ভীষণ আলাদা। প্রেম প্রেমের জায়গায়; কিন্তু অর্থনৈতিক ভারসাম্য সেটাও তো বুঝে নিতে হবে মীরাকে। পরস্পর সাম্য ও দেশে আছে বটে; কিন্তু মীরার তো গিয়েই ধাম করে কাজ হবে না। তাছাড়া আইনি প্রক্রিয়াগুলো পেরোতে গেলে টাকা ওর লাগবেই। বন্যার ঢলের মতো টাকা ওড়ায় শামীম। মীরার হাত শূন্য করে দিয়েছে, ইচ্ছে করেই হয়তো। নইলে কথার প্রত্যুত্তরে অমন দাঁত পেষা জবাব শোনাবে রোজ। ওর জীবনে তো আর কেউ আবাবিল পাখি পাঠাবে না, যে পাথর ফেলে শামীমের মতো নমরুদকে হটিয়ে দেবে জীবন থেকে। নিজের ঠোঁটে নিজেই পাথর ছুড়ে মারবে ঠিক করলো ও। তার আগে মা’র সঙ্গে কথা বলা দরকার।
মাকে পেতে পেতে পর দিনের বিকেল গড়িয়ে গেলো। রসুন তোলার মৌসুম এখন। ঘরে ঘরে কাজ। আলগা কথার সময় নেই কারও হাতে। এই মৌসুমের পর আরেক মৌসুমের প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই নিয়ে ব্যস্ততা লেগেই আছে এখানে। কাকাকে দেখলো বস্তা সেলাই করছে উঠোনে বসে। ওকে দেখে হাসলো মধুর করে। মা’র কাছে গয়নার কথা তুলল; কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে শুকনো গলায় মা বলে উঠলো-
‘সে গয়না তো বিপুলের বিয়ের জন্য তোলা। বিয়ের খরচ তো না কেবলি, একটা ব্যবসা ধরায় দিতি হবি ঔয়াক। তোমার ভাই তো হাত পাও ধুয়ে বসি আছে। ছোট ব্যাটাক তো কেউ দেখবা না তোমরা! চাকরির বাজার জানো কিছু? ধানের দাম জানো? সারের দাম জানো? কামলার খরচ জানো? ওই যে মানুষটা খাটি খাটি জান দিয়ে দিল, তার তো আরাম দেওয়া লাগবি!’
কালনাগিনীর ছোবল খেলো মীরা যেন। মায়ের কথাগুলোর ভেতর একটা ঠান্ডা অভিযোগ, যা কি-না মীরাকে আগত সুখের হাতছানি হতে টেনে হিঁচড়ে নামালো মুহূর্তে। সোজা চলে এলো দোতলায় দাদির ঘরে। রাগে ফুঁসছে রীতিমতো। রাতে খেলো না পর্যন্ত। কাকা এলো ভাতের থালা হাতে উপায় অন্ত না দেখে।
‘মা গো ভাতের সঙ্গে রাগ করে বোকারা। তুমায় মায়ের মনটা ভালো নাই, তাই ওরোম বলিছে। গয়না লাগে, টাকা লাগে তুমার যা লাগে নিয়ো তা। এখন উঠে খাও তো। সময়টা বড় খারাপ রে মা। হাট বাজারে আগুন। ফসলের দাম নেই। তার ওপর তুমি তো জানো মায়ের বয়স হইছে, আমার বয়স হইছে। সব দিকে খিয়াল করা যায় না।’
মীরা ফুঁপিয়ে উঠলো।
‘তোমাদের বয়স হইছে মানে, ওদেশে তোমাদের মতো মানুষ পাহাড়ে ওঠে, ক্যাম্পে যায়, কত ফুর্তি করে!’
কাকা দরাজ হেসে বললো-
‘ওদেশ আর এদেশ এক না তো! ’
মীরা মুখে ভাত তুলতে তুলতে বলে দিল, শামীমের সঙ্গে থাকব না আর। কাকাও সব কিছু বুঝেছে এমন ভাব নিয়ে জানাল-
‘সে যদি না পারো তাইলি থাকবা ক্যান! আত্মারে কষ্ট দিবা ক্যান! তুমি খেয়ে ঘুমাও, আমি মা’রে বুঝায় কবনে।’
মীরার মনে হলো যেন দাদির মরা রুহু ফিরে এসেছে। কাকা ঠিক দাদির মতো করে বলে গেলো।
‘রুহু কখনো মরে না রে, মরে না। রুহুরে শাস্তি দিবি না কোনো দিন।’
দাদি খুব বলতো কথাটা।
নির্ভরতা ঝেড়ে ফেলবে জীবন থেকে, কখনো যদি মিরেলার মতো উপলব্ধি করে হ্যাঁ ওরো আর পুরুষ সঙ্গীর দরকার নেই, তবে দরকার রাখবে না। জীবনটাকে তুরীয় করে তুলবে দিনে দিনে। কোন ভর্তষণা আর গায়ে মাখবে না। অদৃশ্য চাবুকের মারের ভয়ে পিছু পা হবে না আর। আবার নিজে কিছু করব।
ভাত খেয়ে দেয়ে নিচে নামলো কাকার জন্য আনা সিল্কের পাঞ্জাবি হাতে, বিপুলের জন্য কেনা পাঞ্জাবি আর মায়ের শাড়িটা তুলে দিল মীরা মা’র কাছে। সুপারি কাটছিল মা, আর কাকা কি সব প্যাকেট করছিল। মা বললো-
‘কাল কি মাছ খেতে চাও কও তুমার কাকারে। ভোরে বিলে যাবিনি মাছ আনতে। নাইলে আবার সব ব্যাপারীরা নাটোর নিয়ে দৌড় দিবিনি।’ মার গলায় মধু আর মায়া ঝরছিল, বিকেলের সেই রাগ উধাও!
মীরা একটা ক্রিম দিয়ে বলল-
‘এটা মাখবা হাতে। সারাক্ষণ খালি কাজ করো। বাইম মাছ পাওয়া যায় কাকা?’
কাকা প্যাকেট দেখিয়ে বলল-
‘সে তো পাওয়া যায়। এই দ্যাখো শোল মাছের শুঁটকি করিছে তুমার মা। রসুন নিয়ে যাইও কেজি খানেক। মুড়ি মোয়া আগেই ব্যাগে তুলবা।’
আজ বুঝতে পারছে মীরা আব্বার আরেকটা অংশ কি ভালোবাসায় ভরা ছিল এতদিন ওর জীবনে! কী আলোতে ভরা ওর কাকার চোখ! চৈত্র মাসের চাঁদেরও বুঝি এত আলো দেওয়ার ক্ষমতা নেই। কী ঐশ্বরিক আর্শীবাদে ভরা জীবন অথচ কত সময় লাগে বুঝতে সেটা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : মুর্শিদা জামান গল্প সাহিত্য
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh