শিরোনাম পড়েই কি অন্য কোনো স্মৃতি মস্তিষ্কের নিউরনে এসে ভিড় জমাচ্ছে?
এই ধরুন, সেই স্কুল বা কলেজ জীবনের কথা কি মনে পড়ছে? যখন কিংবদন্তি গায়ক মান্না দে’কে থোড়াই কেয়ার করে, তার গান শুনেও সেসবের পরামর্শ না মেনে হৃদয়ে নাম লেখার বদলে কোনো দেয়াল বা কাঠের বেঞ্চকে সুন্দর খাতা বানিয়ে লিখে দিতেন অমুক যোগ তমুক। হয়তো কাঁচা বয়সের ততোধিক কাঁচা আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে কিংবা সহপাঠী কারও মনের শান্তিতে আগুন জ্বালিয়ে দিতে দুষ্ট বুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে জায়গায়-বেজায়গায় রচনা বা সমীকরণসহ রচনা লেখার কাজটি অনেকেই করতেন। তবে ওপরের শিরোনাম দেখে কেউ যদি এখন তেমনটা ভেবে বসে মুখে একচিলতে হাসি নিয়ে আসেন, তবে সেই দায় একেবারেই আমার নয়। কারণ আমি আপনাদের সেই দুষ্ট হাসি উদ্রেককারী বিষয়টির অবতারণাই করিনি এবং বোঝাতেও চাইনি! সুতরাং কেউ দয়া করে সংক্ষুব্ধ হবেন না।
শিরোনামের প্রধান উদ্দেশ্য বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা এবং সেই সঙ্গে যদি প্রাসঙ্গিকভাবে কোনো বিষয় এসে যায়, তবে তা নিয়ে কিঞ্চিৎ বাক্য উদ্গিরণ। ‘স্যার’ এখন এই বাংলার অত্যন্ত আলোচিত একটি শব্দ। যে দেশে মাতৃভাষা বাংলা, সেই দেশে একটি পুরনো ইংরেজি শব্দের এতটা প্রতাপ নিয়ে পুনরায় আবির্ভূত হওয়া কিছুটা চমকপ্রদ বটে। হঠাৎ করেই আমরা পত্র-পত্রিকা মারফত জানতে পারছি যে, এ দেশে স্যারদের সংখ্যা অপ্রত্যাশিতহারে বেড়ে গেছে। এবং এই স্যারদের মনের দেওয়াল খুবই পাতলা কাচ দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ আল্ট্রা সেনসিটিভ আর কি! তাতে কোনোভাবে একটা টোকা পড়লেই সেটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে এবং বেরিয়ে পড়ে ভয়াল রাগ ও ক্ষোভ। তাতে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় স্যারদের স্যার হিসেবে চিনতে না পারা মানুষেরা।
যদিও এক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। স্যারদের পাশাপাশি ম্যাডামরাও সোচ্চার। ডাকাডাকি নিয়ে এই হুল্লোড়ে বিপদে পড়েছে মূলত আমাদের মতো ‘জাস্ট’ পাবলিকেরা। ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’-এর মতো দশা আমাদের দীর্ঘকাল ধরেই। সবাই আমাদের ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’ তকমার মতোই মনে করে। কারও কাছেই আমরা স্পেশাল নই, স্যার-ম্যাডাম মনে করা তো দূর অস্ত। ফলে আমাদের ব্যবহারও আলুর মতো। সব তরকারিতেই লাগে, কিন্তু দাম পাওয়া যায় না মোটেও। প্রস্তর যুগের প্রায় কাছাকাছি সময় থেকে এই দাম না পেতে পেতে আমরা একেবারে মূল্যহীনই হয়ে গেছি। যেহেতু নিজেদের মূল্য নেই, ফলে অন্যকে মূল্য দিতে গিয়েও আমরা বুঝি না কী করতে হবে! আরে, নিজেরা প্রাপ্যটা পেলে তো অন্যের পাওনা বুঝিয়ে দেব, নাকি? আর তাতেই বোধ করি স্যার-ম্যাডামরা ক্ষেপে যাচ্ছেন। ক্ষেপে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। যেটা না পাওয়ার, তা নিয়ে আকাক্সক্ষা কারও খুব একটা থাকে না। কিন্তু কেউ তেল দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে না- তখন তো মেজাজ খারাপ হবেই। তাছাড়া আলগা প্রভাব-প্রতিপত্তি কে না চায়! আলগা জিনিস সেটিই, যা পাওয়ার কথা না থাকলেও মেলে। সুতরাং আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠলে কি দোষ দেওয়া যায়?
সুতরাং নন্দ ঘোষের ঘাড়ে দোষ চাপানোটা খারাপ কিছু নয়। দোষ চাপালেও নন্দ কখনোই নিরানন্দ হয় না বলেই তো তার নাম নন্দ ঘোষ! হ্যাঁ, সামনে ‘আ’ না বসলেও নন্দ কখনো ‘নিরা’কে ডাক দিয়ে পাশে বসায় না। কারণ ওতে শান্তি শব্দটির সঙ্গে যে ‘অ’ যুক্ত হয়ে যায়। এমনিতেই নন্দদের জীবনে প্যারা অনেক। জাস্ট ফ্রেন্ড অবস্থায় ‘নিরা’র সঙ্গে পার্কে এক বেঞ্চে বসাটাও নন্দদের জন্য বিলাসিতা। কারণ একসঙ্গে বসলেই যে বুট-বাদাম কেনা লাগে!
তাই স্যার-ম্যাডামরা যখন ক্ষেপে গিয়ে আমাদের ওপর
ইট-পাটকেল ছোড়েন, তখন আমরা ভাবতে থাকি বাঁচার উপায়। সমাধান তো প্রয়োজন। হুটহাট হ্যাডম দেখলে কারই বা ভালো লাগে, বলুন? সুতরাং দুই পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক একটি সমাধান খোঁজা এ দেশে খুবই দরকার। আর সেই ‘স্যার সমাধান’কে খুঁজে পেতেই এবার জোর চেষ্টা চলবে। এই লেখার শিরোনামটিও সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি। আমাদের আসলে স্যার+ম্যাডামের সন্ধিপূর্ণ ফলাফল ব্যাকরণগতভাবে খুঁজে বের করতে হবে।
আপনারা জানতে চাইতেই পারেন, সন্ধিপূর্ণ শব্দটি পেলে কী হবে?
প্রথম সুবিধাটি হলো, স্যার ও ম্যাডাম এবং স্যার-ম্যাডামের সন্ধিপূর্ণ শব্দটি বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধ হবে। এই সন্ধিসিদ্ধ শব্দ আমরা ছোটবেলা থেকেই আমাদের উত্তরসূরিদের শেখাতে পারব এবং আমরাও নতুন করে শব্দভা-ার সমৃদ্ধ করতে পারব। এই শব্দত্রয়কে বাংলা অভিধানেও উপযুক্ত শ্রদ্ধাপূর্ণ স্থান দিতে হবে। তখন পুরো বিষয়টিই প্রাতিষ্ঠানিক একটা রূপ লাভ করবে। আর তখনই আমাদের সবার মগজে ও মননে প্রতিষ্ঠিত হবে স্যার ও ম্যাডাম সম্পর্কিত প্রকৃত ধারণা। এ ক্ষেত্রে মেডিক্যাল সায়েন্সে কর্মরত বিশেষজ্ঞ ও ডিজিটাল মিডিয়ার টিকটকারদেরও করণীয় আছে। স্যার ও ম্যাডাম হলে দেহ থেকে কোনো আলাদা দ্যুতি বের হয় কিনা বা কী দেখলে বুঝবেন কে স্যার বা কে ম্যাডাম- এ ধরনের বিষয়াদির ব্যাখ্যা ম্যাংগো পিপলদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে ব্যাপকভাবে। এভাবে সবগুলো কার্যক্রম একযোগে চলতে
থাকলে অচিরেই স্যার বা ম্যাডামদের অহমের চারপাশে চীনের মহাপ্রাচীর গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, স্যার + ম্যাডাম = ? এই অর্বাচীনের মতে, উত্তরটি হতে পারে ‘স্যারাম’। একে প্রচলিত আধুনিক বাংলার ‘সেরাম’ বা ‘সেইরাম’-এর সমার্থক করে তোলা খুবই সম্ভব। কেবলই তো বানান পরিমার্জনের বিষয় এটি। আর কে না জানে, এ বঙ্গে শব্দের বানান পরিবর্তন ছেলে বা মেয়ের হাতের মোয়ার মতো একটি ব্যাপার। ওতে কোনো হুজ্জত নেই, কর্তৃপক্ষও সাবলীল।
এবার তবে নটে গাছটি মুড়াই। যদিও বাঙালির সহজাত স্বভাববশত শেষটায় একটা শিক্ষামূলক বিষয় অবতারণার ইচ্ছা প্রবল হচ্ছে। শৈশব থেকেই আমাদের অনেকেরই মীনা কার্টুন বেশ পছন্দ ছিল কিনা! শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারটি তাই রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর একবার শিক্ষা দিতে পারলেই এই অধমকে ‘স্যার’ না ডেকে কেউ কি পার পাবে?
যাক গে, মনের ইচ্ছা বালিশে চেপে এবারের মতো না হয় যাই। ঈদের পরের আন্দোলনের মতো নিশ্চয়ই একদিন আবার দেখা হবে!
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : রম্য রম্যগল্প অর্ণব সান্যাল শিল্প সাহিত্য
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh