
রাহেলা ও মোবারক হোসেন। প্রতীকী ছবি
‘রাহেলা, ওহ্ রাহেলা, কোথায় গেলে? একটু তাড়াতাড়ি এদিকে এসো তো।’
রাহেলা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে দেখল মোবারক হোসেন ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে এসেছে। মোবারক হোসেনের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বলল, ‘এত বাজার করতে কে বলেছে তোমাকে? এখনো মাসের ১৫ দিন বাকি, মাসের শেষের দিকে গ্যাস বিল কারেন্ট বিল দিতে হবে। আমাদের তো আগের মতো অবস্থা নেই, যে হাত ভরে খরচ করব। আর তা ছাড়া তোমার নিজের দিকেও একটু খেয়াল রাখা দরকার। এত বড় বাজারের ব্যাগ কি তুমি টানতে পারো? এই শীতের দিনেও ঘেমে অস্থির হয়ে গেছ। আমি ফ্যান চালিয়ে দিচ্ছি তুমি একটু বসো।’
রাহেলা ফ্যান চালিয়ে দিল। মোবারক হোসেন বিছানায় বসতে বসতে বলল, ‘জানো রাহেলা অনেক দিন ধরে ভালো কিছু খেতে ইচ্ছা করছিল, এখন তো রোজ রোজ ভালো কিছু খাওয়া হয় না। হাতে কিছু টাকা ছিল তাই ভাবলাম আজ কিছু ভালো বাজার নিয়ে যাই বাড়িতে। বলা তো যায় না, কখন বাঁচি কখন মরি! জীবনের শেষ সময়গুলোতে ভালো কিছু খেয়ে মরাই উচিত কী বলো, হা হা হা...’
মোবারক হোসেন বেশ কিছুক্ষণ হাসলেন।
রাহেলা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে রান্না ঘরে আসলেন। ঘরে এসে হাত দিয়ে মুখ চেপে রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর ও ঘর থেকে আবার মোবারক হোসেন ডাকতে লাগলেন। রাহেলা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘কী হলো ডাকছো কেন?’
‘রাহেলা দেখো বাজারের ব্যাগে ইলিশ মাছ আছে। বেশ বড় ইলিশ বুঝলে তো!’
‘হুম বুঝলাম।’
‘ইলিশটা সর্ষে দিয়ে রান্না কোরো। তোমার হাতের ইলিশ রান্না কত দিন খাই না!’
রাহেলা আবারও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। মানুষটার এত পছন্দ ইলিশ অথচ কত দিন খায় না! খাবে কেমন করে? ইলিশ কেনার টাকাও তো হাতে থাকে না। পেনশনের টাকায় গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল, দুজনের ওষুধপত্র, আরও টুকিটাকি সব মিলিয়ে অর্ধেক টাকা চলেই যায়। বাকি অর্ধেক রাখা হয় বাজার খরচের জন্য। বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে ভালো বাজার তো দূরে থাক শাকসবজি আর কম দামি মাছ কিনতেও মাস যেতে চায় না। অথচ কয়েক বছর আগেও এ বাড়ির চেহারা ছিল অন্যরকম। বাড়িতে কাজের লোকই ছিল চার-পাঁচজন। বাজারের সবচেয়ে বড় মাছ এই বাড়ির জন্য বরাদ্দ থাকত। তিন বেলা আলাদা আলাদা তরকারি থাকত। এবেলা মাছ থাকলে ওবেলা মাংস থাকত। আর ইলিশ মাছের মৌসুমে মোবারক হোসেনের পাতে প্রতিবেলা অন্তত এক পিস মাছ থাকত।
আহা! কী দিন গেছে তখন। তারপর হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। যে জমিগুলো ছিল ধীরে ধীরে তা অন্যের দখলে চলে গেল। ওই সময় আবার হাসান যেতে চাইল বিদেশে পড়ার জন্য। হাসান ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ভালো ছিল। ওর বাবারও ইচ্ছা ছিল একমাত্র ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করে তোলার। তাই সঞ্চয়ের যে টাকা ছিল তা ভেঙে ছেলেকে পড়াতে পাঠালেন বিদেশে। ছেলেকে নিয়ে কত আশা ছিল বাবার! মোবারক হোসেন মাঝেমধ্যেই বলতেন, ‘বুঝলে রাহেলা আমাদের আর দুঃখ থাকবে না! ছেলে লেখাপড়া করে ফিরে এলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
অবশেষে ছেলে ফিরল। বাবা-মাকে না জানিয়ে বিয়েও করল। প্রথম দিকে মোবারক হোসেন রাগ করলেও পরে বললেন, ‘কী হবে রাগ করে? এখনকার ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কী বলো রাহেলা?’
একদিন মোবারক হোসেন ঠিক করলেন ছেলের বাসায় যাবেন। রাহেলা যাওয়ার দিন কত কিছু দিলেন মোবারক হোসেনের সাথে। মানুষটা হাসিমুখে গেলেন ছেলের বাড়িতে। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘বুঝলে রাহেলা ছেলের বাড়িতে যাচ্ছি। নিশ্চয়ই এক সপ্তাহের আগে আসতে দেবে না। তুমি গেলেও পারতে আমার সাথে, কী বলো?’
রাহেলা বলল, ‘না না তুমি যাও! ঢাকা তো অনেক দূরে, আমি যেতে পারব না।’
মানুষটা সকাল ছয়টার ট্রেনে গেলেন। সারাদিন রাহেলা একা একা কাটালো। রাতে শুয়ে চিন্তা করছিলেন এক সপ্তাহ কীভাবে একা একা থাকবেন? তার থেকে মোবারক হোসেনের সাথে যাওয়া উচিত ছিল। এক সময় রাহেলা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
খট্ খট্ শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ভোর চারটা বাজে। এখনো ভোরের আলো ফোটেনি। অথচ কে যেন সদর দরজায় টোকা দিচ্ছে!
কিছুক্ষণ পর মোবারক হোসেন ডাক দিলেন, ‘রাহেলা, ওহ্ রাহেলা, দরজা খোলো আমি এসেছি।’ রাহেলা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি ঢাকা যাওনি?’
মোবারক হোসেন কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ, গেছিলাম।’
‘তাহলে ফিরে এলে কেন?’
মোবারক হোসেন আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। রাহেলা আর মোবারক হোসেনকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। তার দুই মাস পর থেকে তাদের ছেলে তাদের কাছে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়। এমনকি একবার ফোনও করেনি তারপর থেকে। এখন গ্রামের লোকজনের কাছে মাঝে মাঝে শুনতে পান রাহেলা, ছেলে নাকি রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি করেছে। ছেলে আর ছেলের বউ খুব সুখে আছে। রাহেলাও চায় তার ছেলে সুখেই থাকুক। মা হয়ে তো আর ছেলের দুঃখ কামনা করতে পারেন না। ছিঃ! ছিঃ! তিনি এসব কী ভাবছেন? ছেলের দুঃখ কেন তিনি কামনা করবেন।
পাশের ঘর থেকে মোবারক হোসেন আবারও বলল, ‘রাহেলা আমাকে এক বালতি গরম পানি দাও তো গোসল করব।’