খাটিয়ায় সাদা
কাফনের কাপড় পরিয়ে রাখা আজগার সাহেবের লাশ। প্রতিনিয়ত মানসিক অত্যাচার আর রোগ-ব্যাধির
শরীরে তিনি ষাটের বেশি বয়স পাননি, পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন গত মধ্যরাতে। সকাল হতেই
তার মৃত্যুর খবর গেল চতুর্দিকে। শেষবারের মতো তাকে দেখতে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন ভিড় জমাচ্ছে।
বাড়ির উঠানে আজগার সাহেবের লাশ রেখেই তার রেখে যাওয়া অর্থ-সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছে।
আজগার সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী তারা বেগম ও তার একমাত্র সন্তান সাহারা লোকলজ্জার তোয়াক্কা
না করেই ঝগড়া বাধাচ্ছে। মরা-বাড়িতে এমন অপ্রত্যাশিত ঝগড়ায় অম্লান করে দেয় তার মৃত্যুশোকও!
তাতে কী কষ্ট পাচ্ছেন সদ্য প্রয়াত আজগার সাহেব! মৃত্যুর পরও নাকি মৃত ব্যক্তির আত্মা...!
আজগার সাহেব
ছিলেন দাঁতের চিকিৎসক। মফস্বল শহরে ছিল তার চেম্বার; আয়-রোজগার করেছেন ভালোই। যথেষ্ট
অর্থ-সম্পদও জমিয়েছেন। স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে সাহারাকে নিয়ে ছিল তার প্রথম সংসার।
জরায়ু ক্যান্সারে যখন তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হলো, তখন সাহারার বয়স প্রায় আঠারো।
মেয়ের চেহারার দিকে চেয়ে স্ত্রীর মৃত্যুশোক ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল আজগার সাহেবের।
মাকে হারিয়ে সাহারাও কেমন মনমরা স্বভাবের হয়ে গেল! মায়ের মৃত্যুর পরের বছরই বিয়ে হয়
সাহারার, স্বামীর সংসারে চলে গেল সে। আজগার সাহেব বাড়িতে একা হয়ে পড়লেন। বিপদে-আপদে,
রাতবিরাতে খুব নিঃসঙ্গ মানুষ তিনি। বাড়িতে তিনি ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় প্রাণি নেই। সারা
দিনে কাজে ব্যস্ত থাকলেও গভীর রাত পর্যন্ত বিছানায় চুপচাপ শোয়ে থাকেন, তার চোখে ঘুম
হয় না। তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ে, মেয়েটার কথা মনে পড়ে, একা বিছানায় কত কী-যে ভাবেন
তিনি; কখনো কখনো কাঁদেনও। সাহারা স্বামীর সংসারে চলে যাওয়ার পর কয়েকদিনে ঘরটাও কেমন
অগোছালো হয়ে গেল! স্ত্রী-সন্তানকে ছাড়া মধ্যবয়সী আজগার সাহেবের বড় একঘেয়েমি, ক্লান্তিকর
জীবন কাটছে; কদিন আর বেঁচে থাকবেন এভাবে! কর্মজীবনে সাফল্য অর্জন করলেও কেউ কেউ বোধহয়
ব্যক্তিজীবনে তেমন সুখী হতে পারেন না! নিজের জীবনের চরম অভিজ্ঞতা দিয়েই এই বিষয়টি উপলব্ধি
করছেন আজগার সাহেব। যেই মানুষটা কত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে, কত আত্মত্যাগ স্বীকার করে,
কত মায়া-মমতা দিয়ে নিজের একটা সংসার সাজায়; আর সময়ের ব্যবধানে সেই সংসারেও একদিন এত
নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে সেই মানুষটা! আহা! সত্যিই তো বড় রহস্যময় এ মানবজনম! যখনই বেঁচে থাকার
একটু অদম্য আশা জাগে তার বুকে; তখনই আজগার সাহেব ভাবেন, মানুষ তো চাইলে যে-কোনো অবস্থায়
নতুন করে শুরু করতে পারে জীবনটা! বোধহয় মনের জোরটুকু থাকা জরুরি...। সাহারার বিয়ের
কয়েক মাস পর, অনিচ্ছা নিয়েও দ্বিতীয় বিয়েটা করতেই হলো তাকে। বয়সে প্রায় নয় বছরের পার্থক্য
তার দ্বিতীয় স্ত্রী তারা বেগম ডিভোর্সি নারী। অতি চঞ্চল স্বভাবের তারা বেগম যখন-তখন
দুমদাম কীসব কথা বলে! দ্বিধাহীন ভাবে যে-কোনো বিশ্রী কথাও তাকে বলতে পারে তারা বেগম।
আজগার সাহেব খুব সঙ্গত কারণেই কমই কথা বলার আগ্রহ বোধ করেন তারা বেগমের সঙ্গে। আজগার
সাহেবের পরের সংসারে কোনো সন্তান-সন্ততি হলো না। তারা বেগম বন্ধ্যা নারী, বোধহয় সেই
কারণেই প্রথম স্বামী ডিভোর্স দেয় তাকে। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকেই খুব অসুস্থ হয়ে
পড়লেন আজগার সাহেব; কয়েকবার স্ট্রোকও করলেন। এমন অসুস্থ স্বামীকে ছেড়ে যেতে মোটেও আপত্তি
থাকার কথা নয় তারা বেগমের মতন তিরিক্ষি স্বভাবের নারীর, তবু পড়ে থেকেছিল বোধহয় স্বামীর
বিষয়-সম্পত্তির লোভে! কারণ দুজনের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততাও ছিল চরমে। অবস্থা এমনটি
হয়েছিল যে, আজগার সাহেব মরলেই বুঝি হাঁপ ছেড়ে বাঁচে তারা বেগম। কিন্তু ওপরওলার ইচ্ছায়
সেটাও যেন হচ্ছিল না! নিত্যদিনে তারা বেগমের অসহ্য চিৎকার-চেঁচামেচি আর মানসিক অত্যাচারেও
যেন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। রাগে একদিন তাকে বাথরুমেও আটকে রেখেছিল তারা বেগম। ঘুমের
ওষুধ খাইয়েও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল! কিন্তু অজানা কেলেঙ্কারির ভয়ে বিষয়টি কাউকে
বলেননি আজগার সাহেব। যদিও অপ্রকাশ্য দহনে ভেতরে ভেতরে পুড়েছেন ঠিকই তিনি, তার চোখেমুখে
সারাক্ষণই লেগে থাকত একটা বেদনার ভাব। হঠাৎ করে তার বুক ভারি হয়ে উঠত, দীর্ঘ নিঃশ্বাসও
ছাড়তেন অতি গোপনে। শেষ বয়সে চাইলেই তো আর সব গোপন ব্যাপার-স্যাপার বাইরের যে কাউকে
বলা যায় না; এছাড়া তার দি¦তীয় স্ত্রী তারা বেগম যতই মন্দ স্বভাবের নারী হোক না কেনো,
অনিবার্য কারণে তার সামনে বিবস্ত্র হতে পারলেও অন্য কারো সামনে তো সেটা কখনো সম্ভব
নয়! তাছাড়া কোনো কোনো পুরুষের জীবনে স্ত্রী হলো বড় দুর্বোধ্য প্রাণি, কখন যে কী করে
বসবে সেটা বলাও দায়! আর দ্বিতীয় স্ত্রী বদরাগী হলে তো বিপদও দি¦গুণ বোধহয়! দুজনের মধ্যে
সম্পর্ক আর বয়সের ব্যবধান যেমনটিই হোক না কেন, তবু আজগার সাহেবের শেষ বয়সের দিনগুলো
কোনো রকমে কেটে যাচ্ছিল তারা বেগমের সঙ্গেই তো!
তারপর যখন আজগার
সাহেব খুব অসুস্থাবস্থায় একেবারে দীর্ঘ শয্যাশায়ী, তখন তারা বেগম তার বড় ভাইদের শলাপরামর্শে
স্বামীর বাড়ির জায়গা-জমি কৌশলে নিজের নামে দলিল করে নিয়ে নেয়। বিষয়টির বিন্দুবিসর্গও
তখন জানতে পারেনি সাহারা! আজগার সাহেবের মৃত্যুর খবরে বাপের বাড়ি ছুটে আসে সাহারা,
সঙ্গে এসেছে তার স্বামী সাজ্জাদ আর চার বছরের বাচ্চা মেয়েটাও। বাড়ির উঠানে আজগার সাহেবের
লাশ কাপনে ঢাকা। কাপনের কাপড় সরিয়ে শেষবারের মতো বাপের মরা মুখটা দেখে নেয় সাহারা,
পিতৃশোকে কান্না থামাতে পারে না সে। এদিকে বাড়িতে সাহারাকে দেখে মন্দ কথা বলা শুরু
করেছে তারা বেগম,‘কেমুন বদ মাইয়া-গো! বুড়া বাপটা বাঁইছা থাকতে তো আইলোই না...!’ বাপের
মৃত্যুর শোকে কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে সাহারা; কোনো কথার জবাব দেয় না সে।
তবু তারা বেগম কী একটা সামান্য বিষয় নিয়ে খুব রেগে সাহারার শিশু মেয়েটাকে বের করে দেয়
নানার ঘর থেকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে সৎ-মায়ের সঙ্গে একটু ঝগড়াও বেধে যায় সাহারার,
তখন তারা বেগম উত্তেজিত হয়ে সাহারাকেও বেরিয়ে যেতে বলে বাপের বাড়ি থেকে। সাহারার স্বামী
সাজ্জাদের সঙ্গেও রাগারাগি হয় তারা বেগমের। সৎ-মায়ের সঙ্গে ঝগড়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে বাপের
রেখে যাওয়া অর্থ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিষয়টিও জানতে পারে সাহারা। আজগার সাহেবের
বাড়ির নয় শতক জমিসহ তিন তলা ভবনটি হেবা দলিল করে নিয়ে গেছে তারা বেগম। ব্যাংকে রাখা
পঁচিশ লাখ টাকাও তার সৎ-মায়ের অ্যাকাউন্টে জমা; আর গ্রামের চাষের সকল জমি হাতিয়ে নিয়েছে
তার চাচারা। সবকিছু জেনে বাপের মৃত্যুর দিনেও সাহারার মনে কী-যে তীব্র ক্ষোভ! অগত্যা,
সৎ-মায়ের সঙ্গে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে ঝগড়াঝাটি শুরু করে সে। সাহারার স্বামী রেগে গিয়ে শ্বশুরের
লাশ বাড়িতে আটকে রাখে, দাফন করতে দেয় না। বিষয়টি জেনে থানা থেকে পুলিশ আসে বাড়িতে।
উঠানে স্বামীর লাশ রেখে উত্তরাধিকারের অর্থ-সম্পত্তি নিয়ে কোনো কথা বলতে নারাজ তারা
বেগম। পুলিশি হস্তক্ষেপে আজগার সাহেবের লাশের জানাজা শেষে দাফন হয় শেষ বিকেলে। এদিন
সন্ধ্যার আগেই বাপের বাড়ি থেকে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হলো সাহারাকে। জগতে
বন-জঙ্গলের বাঘ-ভাল্লুক তো নয়, কখনো কখনো মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায় কাছের
মানুষই- বাপের মৃত্যুর পর এমনটিই বোধ করছে সাহারা! এক রাতের জন্যেও বাপের বাড়িতে থাকতে
দেয়া হলো না তাকে! অর্থ-সম্পত্তির জন্য কত নিষ্ঠুর হতে পারছে কাছের মানুষজন! সৎ-মায়ের
আর চাচাদের অবিশ্বাস্য বিশ্বাসঘাতকতায় সাহারার মনটা পুড়ছে; তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা
অবিরত জোরে জোরে আঘাত করছে কেমন বিষের যন্ত্রণায়! একমাত্র সন্তান হয়েও বাপের রেখে যাওয়া
সমস্ত অর্থ-সম্পত্তি থেকে, জাতাধিকার সূত্রে কিছুই পাবে না সে? এমন একটা অমীমাংসিত
প্রশ্নেও সাহারার নীরব রোদন কী শুধুই পিতৃশোকে!
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : গল্প আরিফ মজুমদার
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh