গাসসান কানাফানি’র গল্প
লেখক পরিচিতি : গাসসান কানাফানি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ নেতা, শিক্ষাবিদ ও শহিদ লেখক। ফিলিস্তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন’-এর এই নেতাকে ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই বৈরুতে মোসাদ হত্যা করে। তিনি এমন একজন কমান্ডো যিনি কখনো বন্দুকের গুলি ছুঁড়েননি, তার অস্ত্র ছিল বল-পয়েন্ট কলম ও তার ক্ষেত্র ‘সংবাদপত্রের পাতা’ হিসাবে পরিচিত ছিল। কানাফানি একজন আবেগপ্রবণ জাতীয়তাবাদী ছিলেন। গাসসান ফয়েজ কানাফানি ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশদের ফিলিস্তিন দখলের সময় আক্কা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। আইনজীবী ফায়েজ ও তার স্ত্রী আয়েশা আল-সালিমের ঘরে গাসসান জন্মগ্রহণ করেন। এই দম্পতির আট সন্তান ছিল। গাসসান ছিলেন তৃতীয়। এক দশকের মধ্যে ইসরায়েলি সন্ত্রাসীরা তিনজনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়-১৯৭২ সালে কানাফানি, ১৯৭৩ সালে নাসের ও ১৯৮১ সালে আবু শরার।
জায়নবাদীরা কখনই বেসামরিক ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে তাদের হত্যা অভিযানের পার্থক্য করতে মাথা ঘামায়নি। প্রকৃতপক্ষে, অনেক অনুষ্ঠানে ইসরায়েলি সরকার(অথবা এমনকি দখলদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেও জায়নবাদীরা) বেসামরিক লোকজনের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। সম্ভবত ইসরায়েল কানাফানিকে হত্যা করতে চেয়েছিল ও তার কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। তারপরও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়নি। বরং মৃত্যুর পর আরব বিশ্বে তার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে। কানাফানির উপস্থিতি সর্বব্যাপী।
কানাফানি সম্পর্কে আস-আদ আবু খলিল লিখেছেন, ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিন ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী গাসসান কানাফানি, মাজেদ আবু শারর ও কামাল নাসের-প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের তথ্য অফিস গঠনে সহযোগিতা করেছিলেন।
আরব সোশ্যাল মিডিয়াতে, এমনকি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যারা বই পড়তে অভ্যস্ত নয়-তাদের মধ্যেও কানাফানি উপস্থিত। তার ছবি বা প্রতিকৃতি অগণিত আরবের প্রোফাইল ছবি করা হয়েছে আর তার নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃতিগুলি সামাজিক মিডিয়ায় স্থান পূর্ণ করে। তার আঁকা পোস্টার ও ডিজাইন আজকাল বেশ সাধারণী হয়ে আছে। এগুলি বিপ্লব ও ফিলিস্তিন ছাড়াও আরও অনেক কিছুর প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়েছে।
#
বেতন অনুসারে অর্থাৎ পদমর্যাদার ভিত্তিতে আমাদের পৃথিবীটা খুব যত্ন সহকারে সাজানো হয়েছিল। কোম্পানির প্রকৌশলী হিসেবে আমরা যে ভবনে কাজ করতাম সেখানকার গার্ডদের সাথে এক ধরণের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাদের সাথে সালাম বা শুভকামনার সম্পর্ক ছাড়া আলাদা কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
‘আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন, হে জাদআন।’
কাঠের বেঞ্চ থেকে সংক্ষেপে একইভাবে উত্তর আসে:
‘আল্লাহ তোমার কল্যাণ করুন, আবদুল্লাহ...’
আর এই আবদুল্লাহ আমরা সবাই, আমাদের প্রত্যেককে সে আবদুল্লাহ বলে সম্বোধন করে...আমাদের নাম মুখস্থ করার ব্যাপারে জাদআন কোনো পরোয়া করে না। আল্লাহ তুমি বিদেশীদের নাম মুখস্থ করার বিরক্তি থেকে মুমিনদের মুক্তি দাও!
গার্ডদের কক্ষটি করিডোরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত ছিল, যেট মূলত আমাদের জন্য বরাদ্দ করা নতুন ভবনের কাছে। আসলে, এটি একটি দুর্দান্ত ভবন ছিল, আমরা আগে যে দালানে থাকতাম তার থেকে ভিন্ন।আগেরটা ছিল নোংরা, ইঁদুর আর প্রতিবেশীদের অসহনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলাম।
এখানে এই নতুন ভবনে আমরা সবকিছু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আর যত দিন যেতে থাকছে, আমরা প্রায় বিচ্ছিন্ন। আমরা যে শুধু পাড়া থেকে বিচ্ছিন্ন তা নয়, পুরো শহর থেকে... আর ভাগ্যিস আমাদের বিদায় জানাতে থাকা দুই প্রহরী আছে। আমরা যখনই দালান থেকে বের হই বা প্রবেশ করি তখন তারা আমাদের অভ্যর্থনা জানায়, কিন্তু বরাদ্দকৃত এই দালানটাতে সত্যিই মনে হয় আমাদের একটি পরিপাটি খাঁচায় রাখা হয়েছে।
সেই প্রহরী দুজন হল বেদুইন যারা মরুভূমি থেকে এসেছে। জাদাআন ছিল নৈশপ্রহরী। তা সত্ত্বেও, সে দিনের কয়েক ঘন্টা ঘুরে বেড়াত, কারণ সেখানে আর কিছুই করার ছিল না। দিনের প্রহরী যে তার নাম মুবারক, আর সে চল্লিশের কোঠার একজন বলিষ্ঠ জওয়ান। সে কালো চামড়ার অধিকারী আর কুঁজো হয়ে হাঁটে। দেখলে মনে হয় সে এইমাত্র একটা লম্বা সেশন থেকে উঠে এসেছে। সে প্রহরীদের জন্য সংরক্ষিত অফিসিয়াল ইউনিফর্ম পরেছিল, যা বড় পিতলের বোতাম সহ নেভি ব্লু রঙের। সে আড়ম্বরপূর্ণ ঘরের ভিতর চাদর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সপ্তাহে একবার এই সাদা চাদর বদলানো হয়।
জাদআন আর মুবারকের জগত থেকে যদিও আমাদের দূরত্ব আছে তা সত্ত্বেও আমরা অনুভব করেছিÑতাদের দুজনার মধ্যে কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল আছে। দুজনের মধ্যে আছে অজানা শত্রুতা বা ঘৃণা। এ ছাড়া আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় জাদআন কখনো শুধু ইউনিফর্ম পরত না। বরঞ্চ তার ওপর একটা উগ্র পোশাক পরত। এটা ছিল ময়লা টি-শার্ট। একসময় যেটা ছিল সাদা ধবধবে।
আমরা আরও লক্ষ্য করেছি যে জাদাআন, মোবারকের বিপরীতে, পরিপাটি ঘরের ভেতরে ঘুমাতে অস্বীকার করেছিল এবং সে একটি বড় বাক্স থেকে নেওয়া তিনটি কাঠের তক্তা দিয়ে নিজের জন্য একটি অদ্ভুত বিছানা তৈরি করেছিল। প্রথমে ওই তক্তা তিনটে ওপরে তুলে ছয়টা পা জুড়ে দেয়। এরপরে তার উপরে এক টুকরো কালো ছাগলের চামড়া বিছিয়ে দেয়। আমরা তাকে রাতের শেষ দিকে তার ময়লা চাদর ভাঁজ করে, ঢেকে রাখতে ও গায়ে চাদর না জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তে দেখতাম। আমরা তাকে কখনোই মার্জিত ঘরের ভিতরে দেখিনি বা বড় হলুদ বোতাম সহ নেভি ব্লু স্যুটের ভিতরে... খুব সম্ভবত আমরা এভাবেই ভেবেছিলাম যে জাদাআন তার সহকর্মী মুবারককে একরকম অবজ্ঞা করে... আর মুবারক, জাদাআনের সামনে লজ্জা বোধ করে।
বিষয়টি তখনই আরো নিশ্চিত হয়েছিলাম যখন মুবারক একদিন আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেনÑ আমি তাকে কোম্পানি প্রধানের কাছে অভিযোগ সংক্রান্ত একটি পত্র লিখে দিতে সাহায্য করব কি না।
‘কার বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুবারক?’
যার বেতন ছয়গুণ বেশি আমি এমন একজন প্রকৌশলীÑসে সুরে একজন প্রহরীকে উদ্দেশ করে জিজ্ঞাসা ছুঁড়লাম-
‘জাদাআনের বিরুদ্ধে... যখন তার পালা সে টয়লেট পরিষ্কার করতে অস্বীকার করে।’
‘কেন?’
‘আমি জানি না। সে আপনার ভৃত্যকে কাজে নিযুক্ত করেছে আর তাকে তিন রুপি দিয়েছে।
‘তাতে তোমার কী যদি সময়মত টয়লেট পরিষ্কার থাকে?’
মুবারক দেয়ালের সাথে হেলান দেয়। সে রেগেমেগে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলে,
‘স্যার শুনুন... এক সপ্তাহ আগে আপনার ভৃত্য কাজ করতে অস্বীকার করেছিল।
আপনাকে জানানোর জন্য বলছি, সে আমাকে ৫ রুপির বিনিময়ে টয়লেট পরিষ্কার করতে বলেছিল।
কেন জাদাআন নিজে এই কাজ করে না? এটা তার কাজের অংশে পড়ে না? তার কাজ কী ? ’
সে তার মাথা নাড়ল, তারপর উরুতে হাত রাখল।
‘হ্যাঁ... হ্যাঁ... কিন্তু আপনি জানেন কেন সে তা মানছে না?
আমি আপনাকে জানাচ্ছি, এটা হয় না। সে এখানে কাজ করতে আসে।
অথচ সে এটা করে না। তাহলে সে কী করতে আসে?’
ভ্যাবাচাকা খেয়ে মুবারক বলতে থাকে-
‘আমি জানি না... আমি আপনাকে বলছি... কিন্তু আমার মনে হয় সে তার পরিবার থেকে পালিয়ে এসেছে।’
‘তার পরিবার থেকে ? সেতো একজন বৃদ্ধ, কেন সে তার পরিবার থেকে পালাবে ?’
মুবারক জাদাআনের বেঞ্চে বসে আমার দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে-
‘এটা অনেকদিন আগে ঘটেছিল। সে লাল চুলের মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।
সে একবার তাকে দেখেছিল তার বাড়ির কাছে। মেয়েটি এসেছিল হরিণ শিকার করতে আসা একটা দলের সাথে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘জাদআন? জাদআন প্রেমে পড়েছিল?’
‘হ্যাঁ, তাদের এলাকার শেখ তাকে হরিণ শিকারে আসা পুরুষ ও মহিলাদের সাথে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
সেসময় সে মেয়েটির প্রেমে পড়ে। সে চলে গেলে জাদআন পাগল হয়ে গেল।’
মুবারক একটি ছোট ডাল নিয়ে উদ্দেশ্যহীন মাটি খোঁচাতে লাগল, আর বলতে থাকল-
‘আপনি জানেন তারা চলে গেলে এলাকার লোকজন নানা কথা বলতে থাকে। তারা এও বলে মেয়েটিÑসেও তাকে ভালবাসত।
‘সে তাকে ভালবাসত? তারা বিয়ে করেনি কেন?’
‘কোন লাল কেশি নারী বেদুইনকে বিয়ে করবে? জাদআন একজন ভাল মানুষ ছিল। কিন্তু তাতে কোন লাভ নেই... আপনি কি জানেন সে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে।’
আমি উঠলাম, তবে হাঁটার আগে জিজ্ঞেস করলাম:
‘তাহলে সে এখানে কাজ করে কেন?’
‘সে বলল জাদআন এখানে কাজ করে না.. সে শুধু এখানেই বসে থাকে।’
‘একজন মানুষ পৃথিবীর যে কোন জায়গায় বসে থাকে’.. সে বললো, ‘আমি আপনাকে বলছি, সে খুব ক্লান্ত, আর এখানে সে একজন মানুষ হিসেবে বসে বসে খেতে পারছে.. সে আরো বললো, ‘সে এখানে চুপচাপ মরতে চায়, সে তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চায় না .. সে পাগল। আপনি কি অভিযোগটা লিখেছেন।’
আমি উত্তর না দিয়ে দরজার কাছে গেলাম, তারপর সিঁড়ি দিয়ে আমার রুমে চলে গেলাম। জাদাআনের পাশে বসা সহজ ছিল না.. তবুও আমি হতাশা ছাড়াই বারবার চেষ্টা করেছি, আর প্রতিবারই আমি তার কঠোর, ডুবে যাওয়া চোখের সামনে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। অবশেষে আমি তার পাশে বসতে পেরেছিলাম। তার ছোট কাঠের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল রুমের চাবির জন্য। কারণ বন্ধুর বাসায় ভুলক্রমে চাবিটা ফেলে এসেছিলাম।
‘আজ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে, কাল শিকার করতে যাব।’
‘শিকার?’
ভেতরে ঢোকার সময় পাতলা কাগজে তামাক গোটাতে গোটাতে জাদআন ঠান্ডা গলায় প্রশ্নটা করল।
‘হ্যাঁ...হরিণ শিকার।’
‘আপনি কিভাবে হরিণ শিকার করেন?
‘যথারীতি... গাড়িতে চড়ে।’
সে মাথা নাড়ল, আর তামাক গোটাতে লাগল, তারপর নিজের সাথে কথা বলার মত করে বলল:
‘আপনি গাড়ি নিয়ে দুর্বল হরিণটিকে অনুসরণ করবেন... এটিকে তার পাল থেকে আলাদা করার চেষ্টা করতে তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাড়া করবেন। যখন ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে, তখন গাড়ি থেকে নামবেন। তারপর তাকে খপাত করে ধরবেন যেমন মুরগী ধরে।’...
কথা শেষ না করে জাদআন হাতের সিগারেটটা ধরালেন, তারপর সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। আমার চোখে চোখ রেখে সে দার্ঢ্য কণ্ঠে বলে-
‘গলদ!’
আমার হঠাৎ মনে হলো কেউ আমাকে অপমান করতে চাইছে, তাই আমি ছুটে গেলাম:
‘গলদ? মানুষ কীভাবে হরিণ শিকার করে? বন্দুক নিয়ে?’
‘না। সেটাও গলদ।’
সে আরেকটা শ্বাস নিল, আর সেই রূঢ়চেহারাটা মেঘের ভিতর দিয়ে আমার উপর ভেসে এল...
সে ধোয়ার কুণ্ডলি ছাড়তে ছাড়তে মৃদুস্বরে বলে-
‘আপনার কখনো হরিণ শিকার করা উচিত নয় আবদুল্লাহ... না গাড়িতে, না বন্দুক নিয়ে’....
‘কেন?’
সে হঠাৎ আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমার প্রশ্ন তাকে আঘাত করেছে। তারপর সে তার আঙ্গুলের মধ্যে সিগারেটটি নাড়ালো। তার চোখ চকচক করছে।
‘আপনি কি কখনো মরুভূমিতে বসে থাকার চেষ্টা করেছেন আর হরিণটি নিজে থেকেই কাছে এসেছে, আপনার কাছে? সে আপনার বাহুতে তার মাথা গুঁজে দিয়েছে এবং আপনার ঘাড়ের কাছে তার মুখ নিয়ে এসেছে, আপনাকে প্রদক্ষিণ করে। সে তার বড় চোখ দিয়ে আপনার দিকে তাকায়, তারপর চলে যায়.. আপনি কি চেষ্টা করেছেন?’
‘না.. তুমি কি চেষ্টা করেছ?’
সে যেন আমার প্রশ্ন শুনেনি, সে ব্যঙ্গ করে বলল:
‘আর তিনি হরিণ ধরার কথা বলেন।’
আমি আর তার অভিমান সহ্য করতে পারলাম না, আমি ফেটে পড়লাম-
‘তুমি শিকারী ছিলে না?’
‘হ্যাঁ, অনেক আগে, আবদুল্লাহ, অনেক আগে।’
আমি আরও এগিয়ে গেলাম:
‘তুমি কীভাবে হরিণ শিকার করেছ?’
সে মাটির দিকে তাকিয়ে খালি পায়ে ময়লা ঘষে, তারপর ফিসফিস করে যেন বলল।
সে তার কণ্ঠস্বর উঁচু করতে লজ্জা পায়:
‘বাজপাখির দিয়ে...’
‘একটি বাজপাখি দিয়ে?’
‘হ্যাঁ, ওরা সবাই তাই করে।’
সে তার জায়গা থেকে উঠে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল যতক্ষণ না আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সিগারেটের আভা। তারপর সে ফিরে এসে আমার পাশে বসল। আর নীরবতা ভেঙে এগিয়ে গেল।
‘যখন আপনি একটি হরিণকে দেখবেন, তখন বাজপাখির চোখ থেকে চামড়ার ব্যাগটি তুলে নেবেন আর এটি বিদ্যুতের মতো উড়ে যাবে। বজ্রপাতের মতো হামলে পড়বে। আবার হরিণ উঠে দাঁড়াবে।’
আমি ক্ষোভে বললাম,
‘তাহলে ওকে মুরগির মতো চেপে ধরবে?’
জাদআন মন খারাবের ভাব নিয়ে মাথা নাড়িয়ে পুনরাবৃত্তি করলেন:
‘হ্যাঁ। সে তাকে মুরগির মতো ধরে রাখবে... শুনুন আবদুল্লাহ... সে ঘুরে ফিরে আমার মুখোমুখি হল, তারপর সে তার পা তুলে বেঞ্চের ওপর নিজেকে ছাড়িয়ে বসল আর তার রুক্ষ হাতের তালু আমার হাঁটুর ওপর রাখল। সে অন্ধকার ভেদ করে দূর থেকে আসছে: শোন আবদুল্লাহ, বিশ বছর আগে আমি হরিণ শিকারী ছিলাম... আমার কাছে ‘নার’ (আগুন) নামে একটি বিস্ময়কর বাজপাখি ছিল। এটি উপজাতিদের মধ্যে অনেক বছর ধরে শোনা সেরা বাজপাখি ছিল। যখন এটি উড়ত, তখন এর ডানাগুলি সূর্যের আলোকে আটকে রাখত। এটি তার ডানা ভাঁজ করে একটি পাথরের বলের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ত তখন লোকেরা বলত জাদআনের ‘নার’ হরিণকে পুড়িয়ে মেরেছে।’
চারপাশে নীরবতা বিরাজ করছিল, আর আমার কাছে মনে হচ্ছিল সে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। অন্ধকার সত্ত্বেও, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এই মুহূর্তে তার মুখটি সেই অজানা সুখে আচ্ছাদিত ছিল যা এমন একজন ব্যক্তির মুখ ঢেকে রাখে যে তার পছন্দের জিনিসগুলি নিয়ে কথা বলে। একসময় তার কণ্ঠস্বর ফিরে আসে, কিন্তু দুর্বল, অস্পষ্ট। শুনতে কষ্ট হয়-
‘বিশ বছর আগে... আমি নারের চোখ থেকে চামড়ার ব্যাগটা তুলে নিলাম আর সে উড়ে গেল। দূরে একটা মাত্র হরিণ ছিল, আর দূর থেকে আমি তার রঙ ঠাওর করতে পারছিলাম। এটি একটি লালচে রঙ, বাদামীর কাছাকাছি, না- এটি একটি হরিণের রঙ...
আপনি কখনও সেই রঙটি দেখেননি, এটি হরিণের রঙ, এমন একটি রঙ যা কেবল একটি হরিণের হতে পারে। পাখিটা উঁচুতে উঠেছিল, তারপরে পাথরের মতো ডানা গুটিয়ে পড়ছিল ...
যখন এটি হরিণ থেকে একটু উচ্চতায় পৌঁছায়, তখন এটি তার ডানা ছড়িয়ে দেয়... আর শূন্যে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে পড়ে, তারপরে এটি ছোট কাগজের পাতার মতো বিস্তারিত হতে থাকে। সে মাটিতে নেমে আবার উঁচুতে উড়ে গেলো। হরিণটি ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছিল কেউ তাকে মাটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। আমি ভাবলাম ‘নার’ বুঝি পশুর সামনে তার শক্তি-দক্ষতা প্রদর্শন করছে।
সাধারণত অনেক শক্তিশালী জন্তু-জানোয়াররা করে। কিন্তু নার ছয়বারের বেশি তা করেছে এবং সেই সময় তার অভিব্যক্তি ছিল খুবই হিংস্র। একসময় সে আবারো বৃত্তাকারে উড়তে থাকে এবং অবশেষে আমার কাছে ফিরে আসে। আমি দেখেছি তাকে তার বিশাল ডানা মেলে ধরে ধীরে ধীরে গর্বিতভাবে নেমে আসতে। যখন হরিণ সরু পায়ে তার কাছে আসে, মনে হয় কোনো হায়েনা তার কাছে এসেছে।’
জাদআনের কাঁধ ধরে আমি ঝাকি দিই। মনে হচ্ছিল সে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ডুবে গেছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
‘তারপর কী হলো?’
আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে আসি.. আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে নার সেদিন শিকার করতে চায় না.. আপনি জানেন যে বাজপাখিদের নিজস্ব নীতি আছে, কিন্তু যা ঘটেছিল তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল.. এরপর থেকে নার তার জন্য তৈরি করা কাঠের খুঁটি ছেড়ে কোত্থাও যায় না । সে তার গর্বিত বুকে দাঁড়িয়ে রইল আর তার সাথে থাকা হরিণটিতে হুক করা চঞ্চুটি রয়ে গেল। আমি তার চোখ থেকে চামড়ার ব্যাগ সরিয়ে দিলেও সে পুরো এক সপ্তাহ খায়নি। সে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হরিণটির দিকেও তাকালো না, নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটি শিশুর মতো আমার চারপাশে, আমার হাতের পিছনে তার গোলাপী নাক ঘষে। এটি তার মুখ আমার ঘাড় পর্যন্ত প্রসারিত করে, আমার বাহুতে তার মাথা আঁচড়ায়। তারপর এটি ঘুরে দাঁড়ায়।
জাদাআন উঠে কাঠের বেঞ্চের কাছে গেল। মরচে ধরা বাক্সটি বের করে তার থেকে তামাক নিয়ে আবার সিগারেট বানাতে থাকে। আমি সেই অন্ধকারে আমি তার বৈশিষ্ট্যগুলি আলাদা করতে পারিনি, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেলাম। মনে হচ্ছিল দূরের গুহা থেকে স্বর ভেসে আসছে।
‘আমি একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি নার কাঠের পাশে পড়ে আছে। তার বুক অনাবৃত ও ক্ষীণ, আর তার চোখ বন্ধ ছিল। বাজপাখিটি মারা যাওয়ার পর আমি হরিণটিকে খুঁজে পেলাম না। সে সম্ভবত রাতের বেলায় কোথাও চলে যায়। আমি উঠে তার সামনে দাঁড়ালাম, জাদআন সিগারেট বানানো শেষ করেছে। তাই আমি ম্যাচ জ্বালালাম আর জিজ্ঞাসা করলাম:
‘দেখেছিলে হরিণটা কোথায় গিয়েছিল?’
আর ম্যাচের ফ্যাকাশে আলোতে আমি তার মুখটা দেখলাম, সে দুর্বল, শক্ত ও শীতল। তার ঠোঁট নড়ে উঠল-
‘সে তার পরিবারের সাথে মরতে গিয়েছিল.. হরিণ তাদের পরিবারের সাথে মরতে ভালবাসে। বাজপাখিরা কোথায় মারা যায় সেদিকে খেয়াল রাখে না।’
বৈরুত ১৯৬১
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh