বাদলার দিনে

-পুঙ্গীর পুত!
জিভ কাটে রোশনা,
বুড়ি শ্বাশুড়ির মুখ খুব খারাপ। রুটি বেলতে বেলতে ঘোমটার কাপড়ে জিভ কাটে সে। হাসিটা স্বামীকে দেখাতে চায় না। স্বামী জয়নাল তার সমুখেই বসা। জয়নাল অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসে। মায়ের মুখ সে জানে। কিন্তু যাকে এই কথা বলা হলো তাকে নিয়ে আরও বড় অস্বস্তি। দুই রুমের এই টিনের চালের বেড়ার ঘর খানা আসলে একটাই ঘর। মাঝখানে পার্টিশানটা একটা বেড়া দিয়ে দেওয়া।

বহু বছর আগে। সেই মতলব দুনিয়ায় আসার আগে। জয়নালের বিবাহের পর পর। নতুন বউয়ের ওম! তখন শীতের সময়। রোশনার বাপ একখানা শক্ত কাঠের চৌকি আর লাল লেপ মেয়ের সাথে পাঠিয়েছিল। লেপের চাইতে বেশি পছন্দ ছিল জয়নালের বউ-সঙ্গ। পার্টিশন জরুরি ছিল। এখন এই ঘরে থাকে জয়নালের বুড়ি মা আর ছোট পুত্র। চার সন্তানের মধ্যে মেয়ের বিবাহ দেয়া শেষ। সে দূর গ্রামে সংসার করে। খারাপ থাক ভালো থাক বাপের কাছে হাত পাতে না। হাত পাতলেও কিছু করার ছিল না জয়নালের। বর্গা চাষ করে এখন কোনো লাভ নাই। ফসল ঘরে ওঠে আর কই! গত বৎসর আচমকা ঢলের পানিতে সব শেষ। বিকালে যেখানে হালকা হলুদ সবুজ ধান ঢেউ খেলছিল পরদিন বিহান কালে সেখানে হাঁটু সমান পানি, চোখের সামনে গলা পানি হয়ে গেল। নাও নিয়ে ফসল বাঁচাতে চেষ্টা করছে প্রাণপণ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ধারের পয়সার ফসল। কর্জ শোধ হয় নাই। মেজো ছেলেটা ছিল হাতের লাঠি। তারে পাঠাতে হয়েছে সিলেট শহরে মোটর মেকানিকের কাজ শিখতে। কে না জানে, এই যাওয়াই তার যাওয়া। ছেলেপুলেরে শহর কি চেনাইতে আছে? এই ছেলে আর ফিরবে? বড় জনেরে ঢাকায় দিয়ে বড় শিক্ষা হয়েছে তার।
বিবাহ-শাদি করে এখন আর বাড়ি আসে না। বাপের খোঁজ রাখতে পারে না। তারপরও কথা থাকে। এই সব নিয়ে সে আর মন কষাকষির করে না। বউ রোশনা মেয়ে ভালো। ভালো বংশীয় ঘরের মেয়ে, চালচলনে বোঝা যায়, সে মাঝেমধ্যে কথা তুলতে চায় জয়নাল থামায়। কী দরকার! ভালো থাকলে থাউক। সমস্যা হলো ধারের টাকা শোধ দেয়া মুশকিল। মেজো ছেলের এখনও কাজ শেখার সময়, তারপরও কিছু আয় আছে। মালিকের সাথে কথা আছে, টাকাটা তারেই পাঠায়। চুলার পাশে থেকে ওঠে সে। মায়েরে থামানো দরকার। এই ছোট ছেলেটাকে সে লেখাপড়া শেখাতে চায়। দেখা যাক। আল্লাহ ভরসা। মুসিবত এই যে, সারাদিন সে দাদির পিছ ছাড়ে না। পাড়া বেড়ানির অভ্যাস তার নাই; কিন্তু মুখ খারাপ দাদির কাছে সহবতের গালিগালাজও শেখা হয়ে যায়। জয়নাল বহুদিন বলেছে- থামো মা! কিন্তু তাতেই কি সব শেষ হয়?
মাটির মেঝেতে সিমেন্টের হাতের প্রলেপ দেওয়া। জায়গায় জায়গায় দাদরা খাদরা হয়ে আছে। বেড়া সারাই করানো দরকার। গত বছর বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা যায়নি এখনও। পুরো ঘরের কাচার বেড়ায় ঘুণ, টিনের চালায় শত ছিদ্র ঠিকঠাক করা অসম্ভব । রোশনার পরামর্শে তাই চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিল টিন চাইতে। কিন্তু চেয়ারম্যানের চেলা মুন্সির প্যানর প্যানর শুনে চলে আসতে হয়েছে। হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া টিন পায়নি কেউ। তবে টিনের চেহারা সে দেখেছে। কী চকচকা, ঝকঝকা। চেয়ারম্যানের নতুন দোতলা বাড়ি উঠেছে, ঝলসাচ্ছে নতুন টিন।
সে কী বাহার!
হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়।
চোরা।
সেই চোট্টার কী খাতির গ্রামে! কী সম্মান! ছি।
কিন্তু মাকে থামানো দরকার। চেয়ারম্যানেরে কী বলতে কী বলে, কাজ কী?
প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গেলে কোচিংয়ের টাকা দিতে হবে। এই এক জ্বালা! খাবার পয়সা জোটে না, গরিবের লেখাপড়ার খরচ আসে কোত্থেকে?
সরকারি হিসাব পরিষ্কার। ফ্রি।
ইস্কুলের মাস্টারদের খাই মেটাতে কোচিংয়ের পয়সা? তাইলে ইস্কুল কী জন্য?
জয়নালের সরল মনে প্রশ্ন।
জয়নালের মা ফিরে তাকায়।
- আইয়ো বাপধন।
টিভিটা বালোই। মাঝে মাঝে এট্টু ঝিরঝিরায় তয় হারামজাদাগুলিরে আর দেখতে মুন চায় না।
ছোট ছেলে মাটিতে বসে পড়ে। সেদিকে চেয়ে কথা ঘোরায় জয়নাল।
পায়ের ব্যাদনা কিরাম মা?
আর বেদনা। সর্বাঙ্গে সবকানে বিষ বাবা।
জয়নালের ঘরের অবস্থা খুব নাজুক। পিছনের চালাও মরিচা ধরা।
টিনে শক্ত জুতার বাক্সের ঠেকনা দেয়া। অসাবধান হলেই বিড়াল ঢুকে পড়ে ঠেলা দিয়ে।
বহু আগের ঘর। এইবার বন্যার পরপর রোশনা গিয়েছিল চেয়ারম্যানের বাড়ি, ভাবিসাবে চাল পিষায়ে নিলেন।
ঢাকা থাকি মেহমান আসবে মুরগি কাটা লাগল সাত-আটখান। তাতে আপত্তি ছিল না তার।
কিন্তু কাজটা হয়নি।
সে বলতে চেয়েছিল বানের পানিতে ঘরের করুণ দশার কথা। সাহায্য পাওয়া ত্রাণের টিন যদি কিছু পাওয়া যায়, ঘরখান হয়, গরিব বাঁচে।
না গো! সব গোছায়-কাটায় নিয়ে দশখান কথা শুনায় সাতখান বুঝায় দিলো তারে। টিন নাই।
বাটোয়ারা শেষ। আগে জানাইলে পাইতা, পরেরবার দিলে তুমি পাইবা।
কইছে!
আসলে দিতো নায়।
বাইরে মেঘ ডাকে। গুড়ুম-গুড়ুম শব্দে। রোশনার বুক কাঁপে । বাদলা বৃষ্টি থামে না ক্যান?
পানি কি আবার বাড়ব?
 চেয়ারম্যানের চকচকে টিনের দোতলা শৌখিন বাসাটা চোখের সামনে ভাসে রোশনার।
পাশের ফুটো দিয়ে টপ টপ করে জমে থাকা চালের পানি পড়ছে। একটা গামলা এগিয়ে দেয় সে জায়গামতো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh