আমার বাবা খুব কড়া হেডমাস্টার ছিলেন। ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্য ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। একটু এদিক-ওদিক হবার জোগাড় নেই। তা নিয়মের ক্ষেত্রে হোক কী সময়ের ক্ষেত্রে হোক। আমি নিজেও খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কখন শাস্তি নেমে আসে! ছেলে বলে কোনো বাড়তি খাতিরের প্রত্যাশা তো ছিলই না, উল্টো বাড়তি শাস্তির আশঙ্কায় টেনশনে থাকতাম। আমার দুর্দশা দেখে একদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার স্যার তো নিচু গলায় বলেই বসলেন, এত ভয়ের কী আছে? তুমি তো নকল করছ না! আমি এসব সুবচন কানে না নিয়ে নিজ সুরক্ষায় বাবার রুদ্র চেহারা কল্পনা করে পরীক্ষার খাতায় লাঙলের মতো কলম ঠেকিয়ে আগের মতো ব্যস্ত থাকতাম। আর আমার করুণ দশা দেখে বন্ধুরা মিটিমিটি হাসত।
চাকরিতে এসে আমি যখন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরীক্ষার হলে ঢুকলাম আমার মনে হলো বাবা যেন দূর থেকে তাকিয়ে আছে আমার কাণ্ড-কারখানা দেখতে। নো মার্সি। পরীক্ষা পরীক্ষার মতো হবে। পরীক্ষার দুই দিন আগে ডিসি স্যার পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্রিফ করেছেন। উনি বলেচ্ছেন, ‘কথা একটাই-পরীক্ষা নকলমুক্ত হবে। এর কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হবে না। টুকলির আলামত পেলেই কট!’
একে তো নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি! আমায় আর দেখে কে? পরীক্ষা কাকে বলে দেখিয়ে দিতে হবে। কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেবের কক্ষে ম্যানেজিং কমিটির দুজন সদস্য ছিলেন। তাদের বক্তব্য সারা দেশে যেভাবে পরীক্ষা হচ্ছে, এখানেও সেভাবেই হোক। আমি বিস্ময়ে বললাম, সেকি সারা দেশে দেদার নকল চললে এখানেও নকলের দুয়ার খুলে দেব? একজন রাগত স্বরে বললেন, তাই তো করা উচিত, এটা কি আলাদা কোনো প্রদেশ যে পরীক্ষা ভিন্ন কায়দায় হবে? কথাটা কড়া গোছের হয়েছে ভেবে প্রিন্সিপাল সাহেব বাতচিতে ঢুকে বললেন, বিষয়টি এমন নয়, বেশি কড়াকড়ি করলে ছাত্রছাত্রীরা ভয় পেয়ে যেতে পারে-ও রকম ভেবে বলছেন আর কী? সঙ্গে সম্ভবত চোখের ইশারাও করেছেন, ভদ্রলোক চুপ হয়ে গেলেন।
আমার মেজাজ একটু বিগড়ে গেল। আমি প্রিন্সিপাল সাহেবকে বললাম, দয়া করে সব পরীক্ষার হলে জানিয়ে দিন, কোনো রকম কাগজ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, দেখাদেখি, কথা বলা সব বন্ধ।
ততক্ষণে চা এসে গেছে। আমি চা খেয়ে রওনা দেব ভেবে বিস্কুটে কামড় বসালাম। এ সময় সন্তর্পণে এক শিক্ষক এসে প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে মুখ নিয়ে বলতে লাগলেন, ‘বুঝিয়েছি স্যার, শোনে না। বলে কি না, আমার মতো আমি পরীক্ষা দেব। নিয়মনীতি আমাকে শোনাবেন না। টেবিলের ওপর ফুল, চকলেট এসব বিছিয়ে রেখেছে। কিছুই শুনছে না স্যার। আপনি চলেন স্যার!’
প্রিন্সিপাল সাহেব ব্যস্তসমস্ত হয়ে অই শিক্ষকের সঙ্গে ছুটলেন। ম্যানেজিং কমিটির বাতচিত করা সদস্যও সায় দিলেন, ‘যান, যান।’ প্রিন্সিপাল সাহেবের ভঙ্গি দেখে কিছুটা অবাক হয়ে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যটির চোখে চোখ রাখতেই তিনি খানিক লজ্জা পেয়েছেন মনে হলো। আমতা আমতা করে বললেন, আমাদের এমপি সাহেবের মেয়ে। একটু খেয়ালি আর কি। ভালো মেয়ে। বোঝালে বুঝে। প্রিন্সিপাল সাহেব পারবেন।
আমি একটু মজাই পেলাম। পরীক্ষার হলো না চিড়িয়াখানা?
আদর-আহ্লাদের জায়গা মনে হচ্ছে। একবার যদি হাতেনাতে ধরতে পারি সোজা এক্সপেল! এমপির মেয়ে হোক আর রাণী হোক কিচ্ছু আসে যায় না। মনে মনে বললাম, আমাকে তো চেন না। আমার বাবাকেও চেন না। পরীক্ষা কাকে বলে, কেন বলে উদাহরণসহ বুঝিয়ে দেব- এমনভাবে যে চৌদ্দ গোষ্ঠী টের পাবে তোমার!!
টানা লম্বা কলেজ ভবন। ম্যালা রুম। অনেক ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে। আমি টহল দেওয়া শুরু করলাম। ভাবলাম, প্রথমেই রুমে ঢুকব না। দরজা বা জানালার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকব। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই টের পাওয়া যায়। কেউ নকল করছে কি না? যারা নকল করে তাদের বসার ধরন, আচরণ অন্যদের মতো হয় না। একটু ভিন্ন রকমের হয়। এটা অনেকটা অস্বাভাবিক আচরণ বলা যায়। হয় স্টিফ হয়ে আছে অথবা অস্বাভাবিক নড়াচড়া করছে। কিংবা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। অথবা অযথা সামনে পেছনে খেয়াল করার ভঙ্গি করছে। খাতা ওলটপালট করছে, বেঞ্চের নিচে কিছু খুঁজছে। কেউবা দর দর করে ঘামছে। পানি খাওয়ার জন্য অস্বাভাবিক দ্রুততায় সিট ছেড়ে উঠে যাচ্ছে।
৪ নম্বর রুমের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় মনে হলো এক ছাত্রী কতক্ষণ পর পর শাড়ির কুচি ঠিক করছে দুই হাতে। মানুষের অনেক ধরনের মুদ্রাদোষ থাকে। এটি সে রকম কিছু নয়তো? একবার এক ছাত্রকে দেখেছি কিছুক্ষণ পর পর শার্টের কলার ঠিক করছে। আমি সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রুমে ঢুকে ওই ছাত্রীর কাছে দাঁড়িয়ে বললাম, তোমার হাত টেবিলের ওপর তোলো। ছাত্রীটি অনেকটা চ্যালেঞ্জের সুরে বলল, ‘কেন স্যার?’
আমি কড়া গলায় বললাম, ‘তোলো’।
ছাত্রী কঠিন স্বরে বলল, আপনার অসুবিধা কী?
আমি রুমে ইনভিজিলেটর হিসেবে দায়িত্বরত শিক্ষককে বলাম, ম্যাডাম এদিকে আসুন। এই মেয়ের হাতে কী আছে বের করুন।
ম্যাডাম এগিয়ে এলেন। ছাত্রীটি আবার শাড়ির কুচিতে হাত ঢোকাতে চাইল। ম্যাডাম ততক্ষণে ছাত্রীর হাত টেবিলে তুলে এনে বললেন, কিছু থাকলে ফেলে দাও। ছাত্রীটি হাত ঘুরিয়ে বলল, কিছু নেই ম্যাডাম। ততক্ষণে আরো দুজন শিক্ষক, শিক্ষিকা আমাদের পাশে এসেছেন।
আমি বললাম, তুমি মুঠ খোলো।
ছাত্রীটি গাঁট হয়ে বলল, কিছু নাই। এবার শিক্ষকরা সমস্বরে বললেন, তাহলে অসুবিধা কী? তুমি দেখিয়ে দাও তোমার হাতে কিছু নেই!
ছাত্রীটি হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাতে রাখা ছোট্ট কাগজ দূরে ছুড়ে দিয়ে খোলা হাত দেখিয়ে বলল, কিছু নেই বললাম তো। আপনারা বিশ্বাস করেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় একজন শিক্ষক অত্যন্ত খেপে গিয়ে বললেন, তুমি বললে কিছু নাই, আবার কাগজ ছুড়ে দিলে কেন?
ছাত্রীটি এবারও বলল, কিছু নাই।
শিক্ষক নিজেই কাগজ কুড়িয়ে আনলেন। দেখলাম, খুব ছোট ছোট অক্ষরে লেখা- নকলই বটে। শিক্ষকরা এবার থ মেরে গেলেন। ছাত্রীকে বাঁচাতে আমাকে দেখিয়ে বললেন, স্যারের কাছে মাফ চাও। ছাত্রীটি কিছুটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ওটা আমার নয়। আমি ওখান থেকে কিছু লিখিনি। খাতায় লেখা উত্তরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেল, কথা সত্যি নয়। সে হুবহু উত্তরটা লিখেছে। পরে নকলটা শাড়ির ভাঁজে রাখতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ছাত্রীটি সজোরে কাঁদতে শুরু করল। মাফ চাইল। কিন্তু কিছুই টিকল না। অনিবার্য পরিণতি পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার।
এই রুমের পাশের রুমেই কথিত এমপি সাহেবের মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। রুমে ঢুকে বেঞ্চের ওপর থাকা গোলাপ দেখে টের পেলাম। প্রিন্সিপাল সাহেবের রুমের আলোচনা মনে পড়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটার মতিগতি। আপাতত নকল করছে বলে মনে হয় না। তবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ফুল গোছাচ্ছে। খাতা ওলটপালট করে দেখছে। আশপাশের পরীক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও মনোসংযোগ হারাচ্ছে।
আমি তাকে উদ্দেশ করে বললাম, তোমার জন্য অন্যরা ডিস্টার্বড হচ্ছে। এটা তো ঠিক হচ্ছে না। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তো নকল করছি না। তাহলে আপনি কেন আমাকে ডিস্টার্ব করছেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম, তাই বুঝি?
মেয়েটি আমার হাতে একটি গোলাপ তুলে দিতে চাইতেই আমি তারস্বরে জোর গলায় বললাম, করো কী, করো কী?
আপনি গোলাপ দেখতে থাকুন, আমি পরীক্ষা দিতে থাকি। ইনভিজিলেটরদের একজন বললেন, নিন স্যার, পাগল কিসিমের মেয়ে। দেখবেন চুপ করে যাবে।
কিছু না ভেবেই আমি হুট করে গোলাপ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখি শান্ত হয়ে বসে খাতায় লেখালেখি শুরু করছে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে গোলাপ হাতে আমি বের হয়ে আসলাম। আঁচ করলাম, শিক্ষকরা মৃদু হাসাহাসি করছেন।
আমি অন্য পরীক্ষার রুমের দিকে পা বাড়ালাম। শেষে ঘুরেফিরে প্রিন্সিপাল সাহেবের রুমে গিয়ে বসলাম। পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা বেজেছে। কিছুক্ষণ পর দরজায় কোনো ছাত্রীর বাগবিতণ্ড কানে এলো। বুঝলাম তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সে ঢুকতে চায়। প্রিন্সিপাল সাহেব গিয়ে তাকে নিয়ে এলেন। এমপি সাহেবের সেই মেয়ে। আমি হেসে বললাম, আর কোনো ঝামেলা করোনি তো? তার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে উশকোখুশকো চুল নিয়ে বহিষ্কৃত ছাত্রীটি।
আমি একটু অবাক হলাম। মেয়েটি এখনো সেন্টার থেকে যায়নি?
না। আপনাকে স্যার ধন্যবাদ। এক গোছা গোলাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল আপনি খুব ভালো স্যার। আমি থতমত খেয়ে বললাম, তুমিও খুব লক্ষ্মী মেয়ে। তুমি কথা রেখেছ। আমার চোখে চোখ রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল, আমার একটা কথা রাখবেন স্যার? ওকে একটা গোলাপ দিন স্যার। এক্সপেল হওয়ার অপমানে সে আত্মহত্যা করবে বলেছে। আমি হই হই করে বললাম, কক্ষনো না। ওসব করতে নেই। তোমার জন্য জোড়া গোলাপ শুভেচ্ছা। তোমার চকলেট কই? দেবে না ওকে?
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : জোড়া গোলাপ প্রণব চক্রবর্তী গল্প সাহিত্য
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh