চিত্রপটে নাগরিক আখ্যান

শিল্পী সনজীব দাস অপুর তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী আয়োজন হয়েছে ঢাকায় গ্যালারি চিত্রকে। গত চার-পাঁচ বছরে আঁকা শিল্পীর ৫৪টি চিত্রকর্ম নিয়ে এই প্রদর্শনী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তাঁর কতক চিত্রকর্ম আগেই দেখছি আমরা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু তাঁর তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী শেষ হবে ৬ মার্চ।

সেখানে আছে নাগরিক মন ও মননের নানা ছবি। গান শুনতে শুনতে ছবি আঁকার অভ্যাসের বশে চিত্রপটে বাদ্যযন্ত্রের উপস্থাপন সংগীতের প্রতি শিল্পীর ভালোবাসারই নৈবেদ্য বলা যায়। শিল্পীর আঁকা একটি চিত্রে পিয়ানো বাদনরত এক তন্বীর পেছন ফেরা অবয়ব লালের ওপর কালচে ও ধূসর বর্ণের আলিম্পনে অসামান্য এক স্বপ্নিল আবহ তৈরি করেছে! দেশের নানা প্রান্তের মানুষ নগর ঢাকায় আসেন নিজেকে গড়তে, ভাগ্যের অন্বেষণে, বেঁচে থাকার তাগিদে। তাই এ নগর অনেকের কাছে যেমন চেনা তেমনই অচেনাও! ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও আধ্যাত্মিক চেতনা এ নগরকে যেন একটা ঐন্দ্রজালিক আবহে ঘিরে রেখেছে। সেই ইন্দ্রজাল ছিঁড়ে এই জাদুর শহরের অলিগলি, কিংবদন্তির রহস্য ব্যবচ্ছেদ করেছেন কতিপয় স্বনামধন্য ঐতিহাসিক-কবি-ঔপন্যাসিক ও চিত্রশিল্পী। যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মুনতাসীর মামুন, শহিদুল জহির, চার্লস ড’য়েল, পরিতোষ সেন, রফিকুন নবী প্রমুখ। এবার এ দলে পেলাম সনজীব দাসকে।

এ নগরীর প্রকট শ্রেণিবিভাজিত সুরম্য অট্টালিকার পাশে জীর্ণ বস্তিঘর এবং যানবাহন, যেমন- আকাশযান, রেলগাড়ি, বাস-ট্যাক্সি, রিকশা-ভ্যান, লঞ্চ-স্টিমার-ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ঘোড়াটানা শকট আর ঠেলাগাড়িতে। এসবই চলে আসে সনজীবের চিত্রপটে নতুন আর পুরোনো ঢাকার চাকচিক্যময়তার সঙ্গে জীর্ণতার অসমতার প্রতীক হয়ে। 

নগরজীবনে শোষিত মানুষের শ্রমসাধ্য এই অজানা অধরা অকথিত গল্পগুলোকে সযত্নে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন শিল্পী সনজীব দাস অপু। তিনি ওই মানুষগুলোর জীবন ও তাদের জীবনসংগ্রামকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন এ শহরের একজন আগন্তুক হিসেবে ঐতিহাসিক নগর স্থাপনার আবহকে ব্যবহার করে। ছবিতে পুরোনো দিনের নানা ভবন, আর্চ আকৃতির দরজা, জানালা, ঘোড়ার গাড়ি, এক্কাগাড়ি- এসব এঁকেছেন ভিনসেন্ট কালার প্রয়োগ করে। এতে চার শতাধিক বছর আগে গোড়াপত্তনকৃত নগর ঢাকার অতীত-বর্তমান সময়ের আবহ তৈরি হয়েছে। ঢাকার নবাববাড়ি, লালবাগ কেল্লা, বড় ও ছোট কাটরা, সাতমসজিদ, শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তানের কামান, বঙ্গভবন, বর্ধমান হাউস, ঢাকা মেডিক্যালের পুরোনো ভবন, 

হাইকোর্ট- সুপ্রিম কোর্ট- এসব ভবন ও স্থাপনা নগর ঢাকার এসব অবয়বকে আকারে-ইঙ্গিতে ব্যবহার করেছেন শিল্পী। কোভিড-১৯ মহামারিকালে ঘরে আবদ্ধ থেকে শিল্পী বাড়ির জানালা দিয়ে কিংবা সংসারের প্রয়োজনে বাজারঘাটে তাঁর আসা-যাওয়ার পথে দেখেছেন গরিব রিকশাঅলা, ঠেলাগাড়ি আর ভ্যানচালক, মিন্তিসহ শ্রমজীবী মানুষগুলোর বেকারত্বের দুর্দশা। ২০২১ সালে আঁকা ‘অকথিত গল্প’ শীর্ষক ধারাবাহিক চিত্রের অন্যতম একটি কাজের কথাই ধরা যাক। রিকশার আসনে অলস শুয়ে থাকা চালকের দেহভঙ্গি করোনাকালের অযাত্রিক বেকারত্বের দুর্দশার সাক্ষ্য দেয়। একই রকম আরো কয়েকটি চিত্রে দেখতে পাই- নগর প্রেক্ষিতে রিকশা, রিকশা ভ্যানচালকদের অবসরজনিত অবসাদ উঠে এসেছে।  রেললাইনের ধারে বেকার বস্তিবাসিনী রূপচর্চিত এক  নারীমুখে অনিশ্চয়তার দূরদৃষ্টি সে সময়ের কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্বের লড়াইকে মনে করায়। 

সনজীবের আঁকা বেশির ভাগ চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু বাস্তবানুগ ও বিষয়ভিত্তিক হলেও তিনি অঙ্কনের দৃঢ়তাকে সরাসরি না দেখিয়ে রং, আলো আর নানা রেখার ঘেরাটোপে তাকে রহস্যের বাতাবরণে বেঁধেছেন। শিল্পীর প্রয়োগকৃত উজ্জ্বল সব রং, প্রধানত নীল, হলুদ, লাল রঙের সঙ্গে সাদা-কালোর প্রয়োগ দেখি তাঁর সব চিত্রপটে। আবহে পুরোনো স্থাপনাগুলো আলোছায়াময়। এর দ্বান্দ্বিক কনট্রাস্ট, প্রচলিত-অপ্রচলিত বর্ণলেপন, রেখার কারিকুরি দিয়ে স্থাপনার সঙ্গে বিষয়ের দূরত্ব সৃজন আর অঙ্কনরহস্য তৈরির মুন্সিয়ানা মিলিয়ে শিল্পী একটা স্বকীয় অবস্থান নির্মাণের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। তবে প্রায় এক ধরনের নকশার কারিকুরির একটা একঘেয়েমি রূপও এখানে বিরাজমান। চারকোলে আঁকা কয়েকটি অঙ্কনও স্থান পেয়েছে, যাতে বৈচিত্র্য এসেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh