Logo
×

Follow Us

উপসম্পাদকীয়

ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হলেই ফারাক্কার সমাধান হবে

Icon

ম. ইনামুল হক

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৫, ১৫:৫৩

ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হলেই ফারাক্কার সমাধান হবে

বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে তাদের রাজনীতিটা ফারাক্কা নিয়ে নয় কিংবা  তিস্তা নিয়েও নয়। তাদের রাজনীতি চিকেন নেক বা সেভেন সিস্টার্স নিয়ে। ভারতের যে দুর্বলতা রয়েছে, সরকারের বক্তব্য বারবার সে জায়গায় আঘাত করছে। কিন্তু ওটা তো আমরা দখল করতে পারব না। আমরা যদি দখল করি, ভারত তো বসে থাকবে না, তারাও বাংলাদেশের একটা জায়গা দখল করবে। ভারত আমাদের চেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। আরেকটা বিষয় হলো, চিকেন নেক দখল করে কী হবে, যদি দখলই করতে হয় তাহলে পুরো পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে হবে। অতএব রাজনীতিটা এখন ফারাক্কা আর তিস্তায় নেই।

ফারাক্কা বা তিস্তা দুটো নিয়ে যখন আমরা কথা বলতে যাই তখন চিকেন নেকের ব্যাপার থাকে না, তখন থাকে দুই দেশের জনগণের স্বার্থ। চিকেন নেক জনগণের স্বার্থের কোনো ব্যপার নয়। ফারাক্কা বা তিস্তার পানির বণ্টন নিয়ে কথা বলাই হলো জনগণের স্বার্থ। সেভেন সিস্টার্স নিয়ে কথা বললে বাংলাদেশের মানুষের লাভ নেই। সেভেন সিস্টার্সের বিষয়টি সেখানকার অধিবাসী আর ভারতের জনগণ বুঝবে, তারা যদি চায় বাংলাদেশের সঙ্গে আসবে না চাইলে আসবে না। গণভোট হতে পারে বিষয়ে, কিন্তু যুদ্ধ নয়। যুদ্ধ করে একজনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।

অনেক ভেবে দেখলাম, ফারাক্কা তিস্তার পানির বিষয়ে ভাগাভাগির কথা হয়, ন্যায্যতার কথা হয় না। আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশনে ভাগাভাগির কোনো উল্লেখ নেই। ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ দুজন মানুষ একই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, দুজনেরই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু চলাচলের সময় একজন আরেকজনকে আঘাত করার অধিকার নেই, এটা ন্যায্যতা নয়।

নদী তো প্রকৃতির অবদান। কিন্তু পানি ব্যবহারের সুবিধার্থে ভারত নিজেদের সীমান্তের ভেতর বাঁধ দিয়েছে, না দিলে তো কথাই ছিল না। যেহেতু বাঁধ দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটা কার্য পরিকল্পনা, কার্যবিধি থাকা দরকার। তাহলে উভয় দেশের জন্যই ভালো। কিন্তু এভাবে কখনো কথা আগায়নি।

ফারাক্কা তিস্তার বিষয়টি ভারত-বাংলাদেশের স্বার্থ বললে চলবে না, এটি এপার বাংলা-ওপার বাংলার স্বার্থ বলতে হবে। কারণ পুরো উজানের যে ভারত তাদের সঙ্গে এই এলাকার স্বার্থের কোনো ব্যাপারই নেই। আমাদের দুই বাংলার মানুষের অভিন্ন স্বার্থ চিন্তা করে আগাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা না বলে তাকে বোঝাতে হবে যে, ‘আমরা তো অভিন্ন মানুষ, আমাদের ক্ষতি তো আপনার উদ্দেশ্য হতে পারে না। আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে পানিটা নিই।আমরা যদি দুই বঙ্গের স্বার্থ হিসেবে এটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, ভারতের অন্য কোনো রাজ্য যদি পানি আটকায় তাহলে আমরা একসঙ্গেই প্রশ্ন তুলতে পারি, কেন পানি আটকানো হলো? যেমনÑমমতা বলেছেন, ‘তিস্তায় তো জল নেই পানি তো ছিল, কিন্তু গেল কোথায়! পানি তো সিকিম আটকাচ্ছে। কিন্তু মমতা মুখ দিয়ে কথাটি একবারও বলছেন না।

আমাদের যদি অভিন্ন স্বার্থের বিষয়টি প্রধান্য পেত তাহলে আমাদের কূটনীতিক বলতেন, ‘কেন দিদি! পানি তো সিকিম আটকে রেখেছে।তখন মমতা কার্যকর কিছু বলত আর নয়তো চুপ হয়ে যেত। তখন মমতাকে প্রস্তাব দেওয়া যেত, আপনি দুজন প্রতিনিধি দিন আর আমরা দুজন প্রতিনিধি দিচ্ছি, পানি কেন আটকাচ্ছে আমরা দেখে আসি।

এখানে একটু বলা দরকার, অন্তর্বর্তী সরকার যখন ক্ষমতায় এলো, তখন যে বন্যা হলো দেশে, বলা হলোÑত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় এই বন্যা হয়েছে। তখন সেখানকার মন্ত্রী বলেছিলেন, ওরা আসুক, আমি গাড়িতে করে ওদের সেখানে নিয়ে যাব পরিদর্শনে। কথার মধ্যে এই রকম একটা ব্যাপার থাকা দরকার। শুধু আমি অভিযোগ দিলেই হলো না। কাজেই মমতা যখন বলেন বা বলবেনতিস্তায় জল নেই’, তখন আমাদের বলতে হবে, ‘দিদি তাহলে জল গেল কোথায়, আমরা আপনার অতিথি হয়ে আসছি, আপনি আমাদের পরিদর্শনে নিয়ে চলুন।ফারাক্কা ব্যারাজ, তিস্তা ব্যারাজ পশ্চিমবঙ্গে আরো যে ড্যামগুলো রয়েছে, যেখানে পানি আটকাচ্ছে তাদের কাছে ড্যামগুলোর অপারেশন শিডিউল রয়েছে তা চাইলে ঠিকঠাক দেখাতে পারবে না। আমাদের কূটনীতিকদের ঠিকঠাক কাজ করতে হবে, কোনো রকম কাজ করে গেলে হবে না। কার্যকর কূটনৈতিক চাল দিতে হবে।

ফারাক্কা তিস্তার পানির বণ্টন আমার মতে ৭০-৩০ শতাংশ হতে পারে। ব্যারাজ পয়েন্টে যতটুকু পানি আসুক না কেন, ৭০ শতাংশ বাংলাদেশে যাবে আর ৩০ শতাংশ ভারতের কাছে থাকবে। এতেই একটা ন্যায্যতার ভিত্তি দাঁড়ায়। আমাদের এলাকা বড় তাই আমাদের বেশি, আর ভারতের কম তাই পানিও কম। নদী তো আমার দেশের ওপর দিয়েই যাচ্ছে, ভারত তো পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এই ফর্মুলায় একটা সমাধান হতে পারে। দুই দেশের মানুষকে এটা বাস্তবতার দৃষ্টিতে দেখে বুঝতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে।

ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হলেই ফারাক্কার সমাধান হবে। দুই দেশ একে অপরের ডিপ্লোমেটিক ভাষা বুঝবে, তবেই সমস্যার সমাধান হবে। বাংলাদেশ ভারত কোনো দেশেরই সম্পর্ক উন্নয়নের চর্চা নেই। ভারত-পাকিস্তানের সশস্ত্র যুদ্ধ হয়েছে সীমান্তে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের যুদ্ধ হয়েছে মিডিয়ায়। রাষ্ট্র যারা চালায় তাদের আচরণ এমন হবে, যাতে দুটি দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। কিন্তু এখানে তা একেবারেই বিপরীত। আমরা তো এক অপরের শত্রু রাষ্ট্র নই। ঘোষণা করারও সুযোগ নেই কারো। বাংলাদেশ যারা চালাচ্ছেন, তাদের যে কূটনৈতিক ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন, সেটা এখনো দেখা যাচ্ছে না। কূটনৈতিক ভাষাটা আগে, তার পরই উদ্যোগ। ধরা যাক, ভারতের কূটনীতিকরা চরম বাজে মন্তব্য করল কোনো বিষয়ে, আমাদের কূটনীতিকদের এমনভাবে কথা বলতে হবে, যাতে করে ভারতও সব মিলিয়ে আমাদের পক্ষে চলে আসে। এটাই কূটনীতির ভাষা।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। গঙ্গা তিস্তা হলো গুরুত্বপূর্ণ নদী। এই নদীগুলোর পানির যে ঐতিহাসিক অধিকার দেশের মানুষের তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ-ভারতের ভবিষ্যৎ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক।

অনুলিখন : বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫