Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

জুনের মধ্যে কোন নির্বাচন হবে?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১৩:৩২

জুনের মধ্যে কোন নির্বাচন হবে?

আমীন আল রশীদ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচনের সম্ভাব্য দুটি তারিখের বিষয়ে মোটামুটি শক্ত অবস্থানে আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথমে তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ‘কম সংস্কার’ চাইলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে, আর যদি তারা ‘বেশি সংস্কার’ চায় তাহলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এখন অবশ্য তিনি বলছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে। তার মানে ডিসেম্বরের মধ্যে নয়।

জুনের মধ্যে বলতে সেটা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও হতে পারে, অর্থটা এমনই। গত ১৮ মে রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখেছেন, নির্বাচনের জন্য আগামী ডিসেম্বর কেন লাগবে? সরকার চাইলে আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও ভোট হতে পারে। তিনি মনে করেন, নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য তিন মাস যথেষ্ট সময়।

বাস্তবতা হলো, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যে নির্বাচন হবে না, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। ধরা যাক জুনের মধ্যে বা জুন মাসেই নির্বাচন হবে, কিন্তু সেটা কোন নির্বাচন? ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, গণপরিষদ নির্বাচন, নাকি ‘হ্যাঁ না’ ভোট? প্রশ্নটা অনেকের মনেই আছে। কেননা, প্রধান উপদেষ্টা বারবার ‘নির্বাচন’ শব্দটি বললেও এটি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কি না, সেটি পরিষ্কার করেননি।

নির্বাচন বলতে তিনি হয়তো ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেই বুঝাচ্ছেন, কিন্তু গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে যেহেতু জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বেশ জোরালোভাবে দাবি জানাচ্ছে এবং এই ইস্যুতে জামায়াতসহ আরো কিছু দলেরও সায় আছে, ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য জুনের মধ্যে গণপরিষদ নির্বাচন হবে কি না এই প্রশ্ন অনেকের মনে আছে। তা ছাড়া ‘ইউনূস সরকারকে পাঁচ বছর চাই’ এ রকম দাবিও সম্প্রতি উঠেছে।

ফলে অনেকের মনে এই প্রশ্নও আছে যে, তাহলে কি জুনের মধ্যে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আরো পাঁচ বছর থাকা না থাকার প্রশ্নে ‘হ্যাঁ না’ ভোট হবে? 

এনসিপি ও জামায়াতের আরেকটি দাবি ছিল, জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, যাতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকারে কিছু নির্দলীয় ভালো ও যোগ্য মানুষ জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। যদিও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সরাসরি বিরোধী অবস্থানে বিএনপি।

ফলে অনেকের মনে এই প্রশ্নও আছে যে, বিএনপির দাবি উপেক্ষা করে সরকার কি আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে? অর্থাৎ জুনের মধ্যে ঠিক কোন নির্বাচনটি হবে, তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা আছে বলেই কি প্রধান উপদেষ্টা বা সরকারের তরফে সুনির্দিষ্টভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথাটি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে?

এসব বিতর্ক এড়িয়ে ধরা যাক সরকার আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথাই বলছে। কিন্তু দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা কি এখন পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য যে সত্যিই আগামী বছরের জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বা সরকার এই সময়ের মধ্যে সংসদ নির্বাচন দেবে বা দিতে পারবে?

এখানে প্রশ্ন তিনটি ?

১. সরকার আদৌ আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন দিতে চায় কি না।

২. সরকার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তথা আপাতদৃষ্টিতে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে দেবে কি না।

৩. সরকার না চাইলেও কিংবা বিরোধিতা থাকলেও ওই সময়ের মধ্যে বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায় করে নিতে পারবে কি না।

নির্বাচনের প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে এবং এটি যে আরো বাড়বে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদের মতো নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির একটা টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।

তাদের মনে হয়তো প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তারা হয়তো ধারণা করছেন, আগামী দিনগুলোতে সরকারের ‘প্রধান স্টেকহোল্ডার’ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন দল ও সংগঠন এমন সব দাবি নিয়ে রাস্তায় নামবে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করবে।

হয়তো জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করতে গিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনৈক্য দেখা দেবে। এনসিপি যেভাবে এই ঘোষণাপত্র দেখতে চায়, সেভাবে না হলে তারা হয়তো আবার রাস্তায় নামবে। জাতীয় সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতেও তারা আন্দোলন করতে পারে। কোনোা কোনো দল হয়তো সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে মাঠ গরম করবে।

দেশের অবস্থা, বিশেষ করে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেলে; রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মি এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ইস্যুতে সীমান্ত পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে; করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার ইস্যু নিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলে সরকারের ‘লেজিটিমিসি’ বা রাজনৈতিক বৈধতার জন্য ‘হ্যাঁ না’ ভোটের ইস্যুটিও সামনে আসতে পারে বা আনা হতে পারে।

দেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যে তিনটি (১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১) গণভোট বা ‘হ্যাঁ না’ ভোট হয়েছে, তার প্রতিটি ভোটের ফলাফলই অবিশ্বাস্যভাবে সরকারের পক্ষে গেছে। কেননা এই ধরনের ভোট করাই হয় সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণে এবং এর ফলাফল মোটামুটি পূর্ব নির্ধারিত।

ফলে এবারও ড. ইউনূসের ওপর আস্থা-অনাস্থার প্রশ্নে ‘হ্যাঁ না’ ভোট হলে তার ফলাফল কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। এমতাবস্থায় জাতীয় সংসদের আগে গণপরিষদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ইস্যুতেও বিএনপির অবস্থান হবে সরকার ও তার স্টেকহোল্ডারদের বিপরীত। ফলে বিএনপি যদি সত্যিই দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামে, তখন জুলাই অভ্যুত্থানে অভিন্ন লক্ষ্যে আন্দোলনকারী দলগুলোই পরস্পর সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

নির্বাচন দ্রুত না হলে কী হবে?

অন্তর্বর্তী সরকারকে মনে রাখতে হবে, একটি রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে গঠিত হয়েছে। সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিধান না থাকলেও সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে দেওয়া বিশেষ ক্ষমতাবলে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে এই সরকারটি গঠিত হয়েছে মূলত অন্তর্বর্তী দায়িত্ব পালনের জন্য। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ; সংবিধান-আইন ও নীতিমালার পরিবর্তন বা বৃহৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার তাদের নেই।

কেননা তারা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়।তা ছাড়া তারা যদি দীর্ঘমেয়াদি এবং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করবে, যা ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী এবং তার অব্যবহিত পরবর্তী পরিস্থিতিরই পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।

জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে গত সরকার যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছে, নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার যদি সেই একই পথে পা বাড়ায়, সেটি দেশকে অধিকতর সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। সুতরাং ‘কম সংস্কার’ বা ‘বেশি সংস্কারের’ বিতর্কে না গিয়ে সরকারের উচিত হবে প্রতিশ্রুত সময় তথা আগামী বছরের জুনের মধ্যে, সম্ভব হলে আগামী বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি করে ফেলা।

না হলে এমন সব বিষয় সামনে আসবে যা হয়তো সরকারের পক্ষেও সামাল দেওয়া কঠিন হবে। সেই সঙ্গে আগামী বছরের জুনের মধ্যে যে গণপরিষদ, স্থানীয় সরকার বা হ্যাঁ না ভোট নয়, বরং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই হবে এ বিষয়টিও সরকারের তরফে পরিষ্কার করা দরকার, যাতে মানুষের মনে নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের সংশয় না থাকে এবং সরকারের ওপর অনাস্থা ও অবিশ্বাস তৈরি না হয়।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫