-683579f1ac493.jpg)
জয়নাল আবদীন
খাইলেই মজা, মচমচে ভাজা, না খাইলে কেমনে বুঝবেন মজা’ মিঠাপুকুরের ১০-১২ বছরের সজিব হাকডাক করে বাসের মধ্যে পাপ্পন বেচে, প্রাইমারির গন্ডি ডিঙ্গাতে পারেনি সে। এখন ঢাকা শহরে হকার। আবার ৮-৯ বছর বয়সী যে মতিন খিরাই ১০ টাকা, আমড়া ১০ টাকা, কাঁচা মিঠা আম ১০ টাকা এমন সুরে ডেকে খরিদ্দার আকর্ষণ করে, তার বাড়ি পটুয়াখালী।
এসব আমাদের নিত্যই দেখা হয়। আপনার আমার ছেলেমেয়েকে যে রিকশাওয়ালা পেডেল ঘুরিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যায়, সেই সোহেলের বয়স ১৬ কি ১৭ বছর। মাধ্যমিকে ঝরে পড়েছে। এ রকম সজিব, মতিন, সোহেলের মতো লাখো লাখো ছেলেপুলের সঙ্গে রাস্তাঘাটে আমাদের দেখা মেলে।
তারা কেন প্রাথমিক, মাধ্যমিকের চৌকাঠ ডিঙ্গাতে পারেনি, সেই খবর কি বৈষম্যবিরোধীরা নিয়েছেন, নাকি নেবেন? জন্মেই অপুষ্টিতে ভোগে দেশের ৫০ শতাংশ শিশু। শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার ওপর নির্ভর করে ওঠানামা করে। সরকারি চাকরিজীবী, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, ব্যবসায়ী এসব অভিজাত পেশার মানুষের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে না।
কিন্তু সজিব, মতিন, সোহেলরা স্কুল-কলেজে পড়া শেষ করতে পারবে না। মেধার প্রতিযোগিতায় তাদের জায়গা হয়নি। মেধাবী হতে হলে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়, সেই সামর্থ্য তার পরিবারের ছিল না। এখনো কোটি কোটি মানুষের সেই সামর্থ্য নেই।
প্রধান উপদেষ্টার প্রদত্ত তথ্য দেশের চার কোটি মানুষকে দৈনিক ১০০ টাকার নিচে জীবন বাঁচাতে হয়। তাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় লেখাপড়া করে, কেউ কি খবর নিয়েছে, না নেবে? আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য টিফিন বাক্স, ওয়াটার পট, দামি পোশাক-আশাক লাগে।
প্রাইভেট কার, রিকশা, জিনিয়াস শিক্ষক, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল লাগে। ভিকারুননেসা, আইডিয়াল, রাজউক, উত্তরা মডেল, মাইলস্টোনের মতো খ্যাতনামা শত শত স্কুল-কলেজ আমরা শহরে গড়ে তুলেছি। কেউ কি বলতে পারবেন ভিকারুননিসার মতো একটি স্কুল এ দেশের কোন গ্রামে আছে? মেধাবী শিক্ষক আছে?
গ্রামের প্রাইমারি বা মাধ্যমিকে যেসব ছাত্রছাত্রী পড়ে, তাদের কেউ একজন যদি জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ভালো কিছু করে, আমরা সেটাকে মিডিয়ায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেশের মানুষকে দেখাই। কোনো রিকশাচালকের ছেলেমেয়ে যদি ভালো একটা রেজাল্ট করে, সেটা হয়ে যায় উদাহরণ।
শহরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে? তাদের মা-বাবার
পেশা কী? রিকশাচালক, হকার গার্মেন্টসকর্মী এসব পেশার লোকজনের ছেলেমেয়েরাই শহরের সরকারি প্রাইমারিতে পড়ে। অর্থাভাবে ভালো স্কুলে পড়াতে পারে না। প্রতি সাবজেক্টের জন্য প্রাইভেট টিউটর দিতে পারে না, তাই তাদের মেধাও হয় না। মেধা বানানোর জন্য টাকাকড়ি বিনিয়োগের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সেই দৌড়ে যে যত বেশি ছুটতে পারে, তার ছেলেমেয়ে তত বেশি মেধাবী।
লম্বা লম্বা লেকচার দিয়ে যারা অতীতে বলেছেন বৈষম্য দূরের কথা, এখনো বলছেন, তাদের সর্দি-কাশি হলে ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে চিকিৎসা হয়। তাদের থেকে একটু নিচে যারা আছেন তারা বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। বাকি কোটি কোটি মানুষ অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারে না। খুব বেশি হলে সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় গড়াগড়ি খায়।
বৈষ্যমের শুরুটা হয় শিক্ষাব্যবস্থার একেবারে গোড়া থেকে। সরকার পরিচালিত হরেক রকমের প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা। গ্রাম অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শহরের শিক্ষাব্যবস্থার যোজন যোজন দূরত্ব। গ্রামের স্কুলে মেধাবী শিক্ষক নেই, থাকে না। স্কুলের অবকাঠামোর জরাজীর্ণ, শিক্ষকের স্বল্পতা, দু-তিনজন, এমনকি একজন শিক্ষক দিয়েও স্কুল চলে।
দেশের আনাচ-কানাচে হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ৪০০টির মাত্র অনুমোদন আছে, বাকি সব অনুমোদনহীন। দুই কোটির ওপর ছাত্রছাত্রী কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। দেশের ২১টি উপকূলীয় জেলা অর্থাৎ দেশের এক-তৃতীয়াংশ জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষার বাস্তব অবস্থা আরো করুন।
এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা বহুধাবিভক্ত। সুন্নি মতবাদী শিক্ষাব্যবস্থা, কওমি মতবাদ অনুসারী শিক্ষা, মাজারভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা, মাইজভাণ্ডারি ধর্মীয় শিক্ষা, ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের ইচ্ছামতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বানাচ্ছে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
সরকারি সিলেবাস পড়ানো হয় কি না, দেখার কেউ নেই। রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র দেশে কোচিং ব্যবসার যে ছড়াছড়ি স্কুল কলেজের চেয়ার-টেবিল খালি, ছাত্রছাত্রীরা কোচিংয়ে দৌড়াচ্ছে।
স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাই কোচিং ব্যবসা খুলে বসেছেন। শিক্ষকের কোচিংয়ে পড়লে
যত হাজার হাজার কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরকার আছে বলে হয় না। শহুরে শিক্ষাব্যবস্থায় সরকার ইংলিশ মিডিয়াম ও বাংলা মিডিয়ামে পড়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। সেখানে সব ধনী আর শিক্ষিত মানুষের ছেলেমেয়েরা পড়ে। সরকার পরিচালিত বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্যাডেট কলেজ তো আছেই।
কেউ হয়তো যুক্তি জুড়ে দেবেন। সব ক্ষেত্রে মেধার প্রতিযোগিতা আছে। এ দেশে এ পর্যন্ত কেউ বলেনি, মেধাবী করে গড়ে তোলার জন্য যে অর্থবিত্তের জোগান দিতে হয়। সেই পরিমাণ আর্থিক সচ্ছলতা কত শতাংশ মানুষের আছে? প্রান্তিক কৃষক, দিন মজুর, গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ফুটপাতের দোকানদার কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিসহ খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানেরা কোথায় লেখাপড়া করে? তাদের লেখাপড়ার পেছনে পরিবার কত টাকা খরচ করতে পারে, সে হিসাব করলে আয়নার মতো পরিষ্কার হবে, যাদের টাকা আছে, তাদের সন্তানসন্ততিরাই মেধাবী হচ্ছে।
মেধার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ডিগ্রির জন্য যাচ্ছে। স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করছে, দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনছে। লেখাপড়ার অসিলায় বিদেশে পাড়ি দিতে পারলে আর ফিরছে না। পরিবারকে দেখতে, দেশের সেবা করতে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদেশেই।
ভুলে গেছে তার অতীত। তিনি বা তারা এখন আরেক সভ্যতার সদস্য। এই যে মা-বাবার অর্থবিত্তের অভাবে যারা মেধাবী হতে পারেনি, তাদের কেউ প্রাইমারি শেষ করতে পারেনি, কেউ মাধ্যমিকে ইতি টেনেছেন কেউবা কলেজ ডিঙ্গাতে পারেনি। তারা অর্থবিত্তে মেধাবীদের থেকে বহু গুণই পিছিয়ে আছেন থাকবেন।
পুরুষানুক্রমে তো আমরা এভাবেই দেখতে অভ্যস্ত। কিছু কিছু যে ছন্দঃপতন হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। গড়পড়তা হিসেবে চাষার ছেলে কেরানি হচ্ছে, রিকশাচালকের ছেলে মোটর ড্রাইভারই হচ্ছে। বৈষম্য বিলোপের যে মাতম আমরা চারদিকে শুনতে পাচ্ছিÑফাঁকা বুলি, অন্তসারশূন্য। রাজনীতি মার্কেটিংয়ের নতুন প্রোডাক্ট।
আমাদের জাতীয় আয়ের ৫৪ শতাংশ যায় ১০ শতাংশ মানুষের পকেটে। অবশিষ্ট ৫৬ শতাংশ স্তরে স্তরে বণ্টন হয়। চার কোটি মানুষের যাদের ১০০ টাকার নিচে জীবন বাঁচাতে হয়। তাদের জন্য রবী ঠাকুরের জীবন স্মৃতি গ্রন্থের একটি সংলাপ দিয়ে শেষ করলাম।
‘অদৃষ্টেরে শুধালেম চিরদিন পিছে, অমোঘ নিষ্ঠুর বলে, কে মোরে ঠেলিছে? সে কহিল, ফিরে দেখ, দেখিলাম আমি, সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।’