Logo
×

Follow Us

উপসম্পাদকীয়

স্যার যদুনাথ সরকার রাজশাহীর সন্তান

Icon

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ২০:০৩

স্যার যদুনাথ সরকার রাজশাহীর সন্তান

স্যার যদুনাথ সরকার

ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার ক্ষেত্রে স্যার যদুনাথ সরকার ছিলেন পথিকৃৎ। বেশ কয়েকটি ভাষার ওপর তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সত্যনিষ্ঠ, তথ্যসমৃদ্ধ ও প্রামাণিক ইতিহাস রচনার জন্যই মূলত তিনি উর্দু, ফার্সি, মারাঠি ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন।

তিনিই প্রথম ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগারে মীর্জা নাথান রচিত বাহরিস্তান-ই-গায়বী-এর পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। পরে তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন জার্নালে বাংলা এবং ইংরেজিতে প্রবন্ধ রচনা করেন।

এই খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন রজশাহী জেলার (বর্তমান নাটোর) ছত্রদিঘী করচমারিয়া গ্রামে ১৮৭০ সালের ১০ ডিসেম্বর। বাবা শিক্ষানুরাগী রাজকুমার সরকার, মা হরিসুন্দরী দেবীর ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম। বাবা রাজকুমার সরকার জমিদারি দেখাশোনা করতেন। এই জমিদার পরিবারের একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল, যা যদুনাথের মেধা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

যদুনাথ সরকারের লেখাপড়ার হাতেখড়ি বাবার কাছে। বাবার প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিত শম্ভুনাথ পাঠশালায় তাকে ভর্তি করানো হয়। এরপর কলকাতা ঘুরে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। বিদ্যানুরাগী রাজকুমার সরকারের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ছিল বিশালাকার। গণিতের ছাত্র হলেও ইতিহাসে ছিল গভীর আগ্রহ।

নানা জনহিতকর কাজে তিনি সময় ও অর্থ ব্যয় করতে ভালোবাসতেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই বিষয়াদি যদুনাথ সরকারকে প্রভাবান্বিত করেছিল। তিনি রবীন্দ্র-সাহিত্যের সমঝদার পাঠক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার লাভের আগেই তিনি কবির রচনার ইংরেজি অনুবাদ করে পাশ্চাত্য জগতের কাছে তার পরিচয় তুলে ধরেন। ১৯১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মডার্ন রিভিউয়ে রবীন্দ্রনাথের ১৭টি প্রবন্ধ ও একাধিক কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেন যদুনাথ।

পিতার মাধ্যমেই অল্প বয়সে তার পরিচয় হয়েছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড’ নামীয় গ্রন্থের সঙ্গে। রাজকুমার সরকার পুত্রের হাতে প্লুটার্ক রচিত প্রাচীন গ্রিক ও রোমান নায়কদের জীবনী তুলে দিয়েছিলেন। পিতাই তার কিশোর চিত্তে ইতিহাসের নেশা জাগিয়ে দিয়েছিলেন।

রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন যদুনাথ। এখান থেকে এফএ পরীক্ষায় দশম স্থান লাভ করেন তিনি। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ পড়তে যান।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে ১৮৯৩ সালে যদুনাথ ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কলকাতার রিপন কলেজে যোগদান করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগে যোগ দেন এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে নিয়োগ লাভ করেন। তার প্রবন্ধ ‘ঐরংঃড়ৎু ড়ভ অঁৎধহমুরন’ ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয়।

১৯১৭ সালে যদুনাথ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন। ১৯১৮ সালে তিনি ভারতীয় শিক্ষা বিভাগের জন্য মনোনীত হন। ইংরেজি ও ইতিহাস দুটি বিষয়ই পড়াবার জন্য তাকে কটকের র‌্যাভন’শ কলেজে বদলি করা হয়। ১৯২৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর যদুনাথ  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন।

১৯২৮ সালের ৭ আগস্ট তাকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। 

বাংলায় প্রকাশিত তার প্রবন্ধের সংখ্যা ১৪৮টি, যা ইংরেজিতে প্রকাশিত ৩৬৫টি প্রবন্ধের চেয়ে সংখ্যায় অনেক কম। বাংলায় যেখানে তিনি মাত্র চারটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেখানে সম্পাদিত গ্রন্থাবলিসহ ইংরেজিতে তার গ্রন্থের সংখ্যা ৩১টি।

উনিশ শতকের বাংলায় দুটি ঐতিহাসিক ধারণা মুখোমুখি হয়। একটি আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া ইংরেজ ঐতিহাসিকদের লেখা। আর দ্বিতীয়টি, বাঙালি জাতীয়তাবাদী লেখা, যেগুলোতে প্রায়ই বাংলায় বীরের সৃষ্টি করা হতো এবং যদুনাথ প্রায়ই যার বিরোধিতা করে লিখতেন। 

ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারকে নিয়ে খানিকটা বিতর্কও রয়েছে। ‘বাঙালিরা কাপুরুষ’ ইংরেজদের মধ্যে প্রচলিত এই মতবাদকে যারা খণ্ডন করতে চেষ্টা করেছিলেন, যদুনাথ ছিলেন সেসব জাতীয়তাবাদী বাঙালির সাহিত্যকর্মের বিরোধী। ফলে যদুনাথকে প্রায়ই ইংরেজ সমর্থক আখ্যা দেওয়া হতো।

ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইট’ উপাধি দান করলে তার সম্পর্কে এ ধারণা আরো জোরালো হয়। যদুনাথ মনে করতেন যে, ইংরেজদের কারণে ভারতের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে যদুনাথ তার গ্রন্থাবলির জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। খ্যাতিমান বাঙালি এই ইতিহাসবিদ ৮৮ বছর বয়সে ১৯৫৮ খিষ্টাব্দের ১৯ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫