
কাজী জহিরুল ইসলাম
আজ
থেকে ৩৩ বছর আগে, ১৯৯১ সালে ব্র্যাকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিই বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্র
নামের একটি এনজিওতে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ছিলেন ড. মুহাম্মদ
ইব্রাহীম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। সম্ভবত বলা উচিত
যে তিনি নোবেল লরিয়েট এবং বর্তমানে বাংলাদেশের সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাই।
বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্রের একটি কর্মসূচি ছিল কিশোরী কর্মসূচি। আমি যোগ দেওয়ার পরে
যেহেতু ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি থেকেই আমি এসেছি, তাই কিশোরী কর্মসূচির সঙ্গে
ঋণদান কর্মসূচিটি যুক্ত করা হয়। গ্রামীণ ট্রাস্ট থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণ এনে কিশোরী কর্মসূচির
মেয়েদের ঋণ দিতে শুরু করি। এই ঋণদান কর্মসূচিটিকে একেবারে শূন্য থেকে আমিই দাঁড় করাই।
ড.
ইউনূস এবং আত্মবিশ্বাস ড. ইউনূস চিরকালের সুপার স্টার। তিনি এলে পুরো অফিস আলোকিত হয়ে
উঠত। সবাই তার কথা শোনার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। একদিন তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের কৃষকের
হাতে হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেব। একেকটা ফোনের দাম হবে মাত্র ১০ হাজার টাকা। আমরা বিস্মিত।
তখন দেশের একমাত্র মোবাইল কোম্পানি মোরশেদ খানের সিটিসেল, একেকটা ফোনের দাম এক থেকে
দেড় লাখ টাকা। বাংলাদেশে কোনো জিনিসের দাম তো কখনো কমতে শুনিনি। দিন দিন জিনিসের দাম
বাড়েই। সেই লাখ টাকার ফোন কী করে ১০ হাজার টাকা হবে? আমরা শুধু অবাকই হইনি, আমাদের
নিজেদের অদূরদর্শিতার কারণে অবিশ্বাসও করি। তবে এই অবিশ্বাসের মধ্যেও আমরা যারা স্বপ্ন
দেখতে ভালোবাসি তারা স্বপ্ন দেখতে থাকি। আমার হাতে একটা মোবাইল ফোন, কোনো তারের সংযোগ
নেই, পকেটে নিয়ে ঘুরছি, প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলছি। আহ, কী দারুণ একটা ব্যাপার! আমরা
স্বপ্ন দেখি আর শিহরিত হই
পাঁচ
বছর সেখানে কাজ করে ১৯৯৬ সালে আমি যোগ দিই সেইভ দ্য চিলড্রেন-ইউকে নামের একটি আন্তর্জাতিক
এনজিওতে। বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্রের একজন বোর্ড মেম্বার ছিলেন ড. ইউনূস। প্রতি কোয়ার্টারে
তিনি আমাদের মোহাম্মদপুরের ছোট্ট অফিসটিতে আসতেন। ড. ইউনূস চিরকালের সুপার স্টার। তিনি
এলে পুরো অফিস আলোকিত হয়ে উঠত। সবাই তার কথা শোনার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। একদিন তিনি
বলেন, আমি বাংলাদেশের কৃষকের হাতে হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেব। একেকটা ফোনের দাম হবে
মাত্র ১০ হাজার টাকা। আমরা বিস্মিত। তখন দেশের একমাত্র মোবাইল কোম্পানি মোরশেদ খানের
সিটিসেল, একেকটা ফোনের দাম এক থেকে দেড় লাখ টাকা। বাংলাদেশে কোনো জিনিসের দাম তো কখনো
কমতে শুনিনি। দিন দিন জিনিসের দাম বাড়েই।
সেই
লাখ টাকার ফোন কী করে ১০ হাজার টাকা হবে? আমরা শুধু অবাকই হইনি, আমাদের নিজেদের অদূরদর্শিতার
কারণে অবিশ্বাসও করি। তবে এই অবিশ্বাসের মধ্যেও আমরা যারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি তারা
স্বপ্ন দেখতে থাকি। আমার হাতে একটা মোবাইল ফোন, কোনো তারের সংযোগ নেই, পকেটে নিয়ে ঘুরছি,
প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলছি। আহ, কী দারুণ একটা ব্যাপার! আমরা স্বপ্ন দেখি আর শিহরিত
হই। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন তো ঘটল, তিনিই তা ঘটালেন। অল্প সময়ের মধ্যেই মোবাইল ফোন
মানুষের নাগালের মধ্যে চলে এলো। ২০০৬ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন, খবর
শোনার পর মিডিয়ায় এসে একটি বারের জন্যও বলেননি, আমি পেয়েছি। প্রথম যে বাক্যটি তিনি
উচ্চারণ করেন তা ছিল, বাংলাদেশ পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরাও পারি।
পৃথিবীর
কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। তার এই বক্তব্য সব বাংলাদেশিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ
করেছিল, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করেছিল। আমি নিজে একজন লেখক মানুষ, কম বয়স থেকেই সাহিত্যে
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তবে সেই স্বপ্ন মাঝেমধ্যেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেত।
তিনি যখন বলেন, আমরা কারো চেয়ে কম নই, আমরাও পারি, আমার সেই স্বপ্ন আরো দৃঢ় হয় এবং
সত্যি কথা বলতে কী আমি এখনো সেই স্বপ্ন থেকে একটুও বিচ্যুত হইনি। ২০০১ সালে আমি কসোভোতে
কাজ করি। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনের প্রশাসন বিভাগের একজন কর্মকর্তা। মহাসচিব কফি
আনান এবং পিস-কিপিং মিশন যৌথভাবে সে বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়।
কিছুদিনের
মধ্যেই কফি আনানের সই করা আমার নামে একটি চিঠি আসে। সেই চিঠিতে লেখা পিস-কিপিং মিশনের
কর্মী হিসেবে আমিও এই নোবেল পুরস্কারের একজন অংশীদার। জানি না কী কারণে আমার অন্য সহকর্মীদের
অনেকেই এই চিঠি পাননি। ওরা আমাকে এই বলে খেপাত, কফি আনান তো তোমাকে পুরস্কারের টাকার
ভাগটা দিল না। আমি কিন্তু সেই চিঠি পেয়ে এত আনন্দ পাইনি, যে আনন্দ আমি পেয়েছি ২০০৬
সালে যখন ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেলেন। কফি আনানের পুরস্কার, অফিশিয়ালি আমিও যার
অংশীদার, আমাকে তেমন আত্মবিশ্বাসী করেনি; কিন্তু ড. ইউনূসের পুরস্কার আমাকে অনেক বেশি
আত্মবিশ্বাসী করেছে। তখন থেকেই মনে হতো, যদি তিনি একদিন বাংলাদেশের শাসনভার পরিচালনার
দায়িত্ব পেতেন, তাহলে এই দেশটাকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে দাঁড়
করিয়ে দিতে পারতেন।
আমাদের
দরকার তার মতো একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি নির্লোভ এবং একজন দক্ষ দলনেতা। বাংলাদেশ আজ
সেই মানুষকে দেশের কর্ণধার হিসেবে পেয়েছে। আমার বিশ্বাস ১০ হাজার টাকায় মোবাইল ফোনের
স্বপ্ন পূরণের মতো এই দেশকে ‘তিন শূন্যের বাংলাদেশ’ হিসেবেও তিনি গড়ে তুলতে পারবেন,
যদি এ দেশের মানুষ তার পাশে থাকে।