
সিরাজুল আলম খানকে সশরীরে দেখার অনেক আগেই আমরা তাঁহার নাম শুনিয়াছিলাম। আমরা মানে যাহারা ১৯৭১ সালের পর ঢাকায় আসিয়াছিলাম। শুনিয়াছিলাম ১৯৬০-এর দশকের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন অগ্রনায়ক ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁহার কীর্তি সম্পর্কে লোকে নানা কথা বলে। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন সিরাজুল আলম খান কে? একজন সাবেক ছাত্রনেতা। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য নেতা নন তিনি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনিও আর দশজনের মতো পাশের দেশে চলে গেলেন। যুদ্ধে তাঁহার সত্যকার কী ভূমিকা ছিল তাহার কোনো নির্দিষ্ট বিবরণ পাওয়া যায় না। দুঃখের মধ্যে, তিনিও নিজের কাহিনীটা নিজের হাতে লিখিয়া যান নাই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বিরোধী একটি রাজনৈতিক শিবিরের নেতৃত্ব হাতে লইয়াছিলেন। এই শিবিরের জবানে অন্য অনেক কথার মতো ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটাও শোনা যাইতেছিল। এই সমাজতন্ত্র জিনিশটি কি পদার্থ তাহার অধিক বিবরণ তো কোথায়ও পাওয়া যায় নাই। শুধু এইটুকু শোনা গিয়াছিল যে বাংলাদেশে ধনতন্ত্রের বিকাশ হইতেছে, সুতরাং দেশ এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের উপযুক্ত ।
আজ মনে হয়, সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করার কোনো বিকল্প ছিল না। সেই বিকল্প কী তাহা সিরাজুল আলম খানও জানিতেন না। শুধু জানিতেন বিকল্প একটা চাই। কারণ প্রকৃতির মতো সংস্কৃতিও শূন্যতা সহ্য করে না।
সিরাজুল আলম খান প্রভাবিত রাজনৈতিক শিবিরের পরাজয়টা কিন্তু তাঁহার দীর্ঘদিনের স্বপ্নভঙ্গ ঘটাইল। এই পরাজয়ের ফলাফল স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁহার সত্যকার কীর্তিটাও ম্লান করিয়া ফেলিল। সম্ভবত এই পরাজয়ের সুবাদেই সম্প্রতি একজন বিদগ্ধ লেখক তাঁহাকে ‘প্রতিনায়ক’ উপাধি দান করিবার সুযোগটা হাতছাড়া করেন নাই।
সিরাজুল আলম খানকে কখন প্রথম দেখিয়াছিলাম তাহা আজ আর মনে পড়ে না। এই মাত্র মনে পড়ে যে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে দেশের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হাতে নিয়াছে আর ঘটনার বছরখানেক পর একদিন ঢাকা শহরের এক মধ্যবিত্ত পাড়া ইস্কাটনে তাঁহার এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় এই কিংবদন্তী বসবাস করেন। সেই সময়, ১৯৮৩ সালের গোড়ায়, তাঁহার দেখা পাইয়াছিলাম।
তখন দেশে ঢিলেঢালা সামরিক শাসন চলিতেছে। তিনি আত্মগোপন করেন নাই, তবে বরাবরের মতোই প্রকাশ্যে বসবাস করেন না। সর্বসমক্ষে বক্তৃতাদি করেন না। তাঁহার সহিত প্রথম সাক্ষাতের পর আমার মনে হইয়াছিল, তাঁহার সঙ্গে জেনারেল হোসেন মুহাম্মদ এরশাদের একপ্রকার বোঝাপড়া হইয়া গিয়াছে। তবে তিনি তাহা তখনও সবার কাছে প্রকাশ করেন নাই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র আন্দোলনে এই অপ্রকাশের ছায়া দেখা গেল ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন জেনারেল সাহেব আন্দোলন দমনে সফল হইয়াছিলেন। সিরাজুল আলম খান একটু দ্বিধাগ্রস্ত। কিংবদন্তী এখন ইতিহাসে নামিয়া আসিয়াছেন।
আরও কিছুদিন পর শুনিলাম যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত দেশি অধ্যাপক জিল্লুর রহমান খানের সহায়তা লইয়া তিনি ‘সংবিধান ও সাংবিধানিক সমস্যা’ নামে একটি পুস্তিকার মতো প্রকাশ করিয়াছেন। এই পুস্তিকায় তাঁহারা অনেকগুলি প্রশাসনিক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়াছিলেন। শুনিয়াছিলাম জেনারেল এরশাদ তাঁহাদের উপস্থাপন করা কোনো কোনো প্রস্তাবে প্রভাবিত হইয়াছিলেন। উদাহরণ আকারে উল্লেখ করা যায়, দেশের একেকটা জেলার অন্তর্ভুক্ত সকল থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা কর্তব্য। এই কাজটি জেনারেল এরশাদ করিয়াছিলেন। তাঁহার ধারণাটা সিরাজুল আলম খানের কাছে ছিল। নিদেনপক্ষে ইহা তাঁহার অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করিয়াছিল।
দুঃখের মধ্যে, তাঁহার অনেকগুলি আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হইলেও তিনি কোনো পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লিখিয়া গিয়াছেন বলিয়া জানা যায় না। অন্তত এখন পর্যন্ত জানা যায় নাই। তিনি যদি একটি আত্মজীবনী লিখিয়া যাইতেন বড় ভালো হইত। জাতির সম্মানে বা জাতীয় আত্মভাবের ছায়ায় বাংলাদেশ আজও গড়িয়া উঠিতেছে মাত্র। সংকটের পর সংকটে তাহার জীবন এখনও অতিষ্ঠ। তাহাকে তিষ্ঠিতে হইলে অন্য অনেকের মতো সিরাজুল আলম খানকেও স্মরণ করিতে হইবে।
আজ তাঁহার পরলোক গমনের গোটা দুই বছর পার হইতেছে। মাঝখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটিয়াছে। কিন্তু এই পরিবর্তন কতটুকু গভীর হইবে তাহা এখনও হলপ করিয়া বলা যাইতেছে না।
তবে একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আজও এই দেশে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকট অভাব ঘোচে নাই। তাই নতুন ঔপনিবেশিক দশায় দেশ দিশাহীন।
সিরাজুল আলম খান বাঁচিয়া থাকিলে বর্তমান সংকট মুহূর্তে কী বলিতেন তাহা নিশ্চয়ই কৌতূহলের বিষয়। অনুমান করিতে পারি, তবে তাঁহার স্মৃতির সম্মানে এইটুকু নিবেদন করিতে দোষ নাই যে তিনি এই পরিবর্তনকে অভিনন্দন জানাইতেন।
নিছক অতীত দিনের স্মৃতিচারণা করিয়া একবিংশ শতাব্দীর সমাজ পরিবর্তন কার্যকর হইবে না। অতীতের যাবতীয় কুসংস্কার হইতে আস্ত ছকশুদ্ধ মুক্ত হইতে না পারিলে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, তাহার রূপরেখা আঁকাও সম্ভব হইবে না। অথচ আজ বাংলাদেশে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি লইয়া বলি, প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না। আমরা বিকল্প খুঁজিয়া যদি না পাই তো প্রকৃতি একটা বিকল্প চাপাইয়া দিবে। তাহা খুব উপাদেয় হইবে এমন কোনো নিশ্চয়তা কিন্তু নাই।