
দীর্ঘ ১৫ বছরের নির্যাতন, বিরোধী মত দমন, গুম-খুন ও পাতানো নির্বাচনের পরও ক্ষমতা ধরে রাখেন শেখ হাসিনা। বিএনপি-জামায়াত আন্দোলন করেও এই দীর্ঘ শাসনামলে আওয়ামী লীগকে খুব একটা অসুবিধায় ফেলতে পারেনি। একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, ‘ছাত্ররা পথে নামলে খোলনলচে বদলে যায়।’ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান প্রচলিত এই উক্তির বাস্তব ভিত্তি আরো একবার প্রমাণ করে দেয়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে। পরবর্তী সময়ে সরকার আন্দোলন দমনে হত্যা-নির্যাতন শুরু করলে আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়। যার ফলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর ১৪ জুলাই শিক্ষার্থীরা রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও অবরোধ জারি রাখে। সে দিন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি পেশ করেন। একই দিন সন্ধ্যায় গণভবনে প্রেস ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ইঙ্গিত করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে?’
তার এই মন্তব্য আন্দোলনকে আরো উসকে দেয়। জবাবে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় মধ্যরাতে বিক্ষোভ মিছিল করে। ছাত্ররা দাবি আদায়ের আন্দোলনে মরিয়া হয়ে উঠলে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করতে অপারেটরদের নির্দেশ প্রদান করে। অন্যদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালান, এতে ১৩ জন আহত হন। জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ‘উচিত জবাব’ দেবে। আন্দোলনকারীরাও সাধ্যমতো জবাব দিতে থাকে। এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করে শিক্ষার্থীরা। সারা দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর নেমে আসে চূড়ান্ত দমন-পীড়ন। বাড়তে থাকে আন্দোলনের তীব্রতা। শিক্ষার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
আওয়ামী লীগ ও পুলিশের নিদারুণ হত্যাযজ্ঞের প্রতি তীব্র ঘৃণায় ৩০ জুলাই উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বামপন্থি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো রাজধানীর রাস্তায় নেমে আসে। অনুষ্ঠিত হয় ‘গানের মিছিল’। এটি ছিল সে সময় দারুণ এক সাহসী উদ্যোগ। যেকোনো কিছুই ঘটতে পারত তখন। সব জেনে-বুঝেই শিল্পীরা নেমে এসেছিলেন। বিকাল ৩টায় এই গানের মিছিল নূর হোসেন চত্বর (জিপিও, জিরো পয়েন্ট) থেকে শুরু হয়। বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে মিছিল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জিপিও চত্বর থেকে একটু সামনে এগোনোর পর বাধা দেয় পুলিশ। পরে রাস্তায়ই বসে পড়েন তারা। গান, আবৃত্তি, স্লোগানে আশপাশের পরিবেশ উত্তপ্ত করে তোলেন শিল্পীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। গানের মিছিলে বিভিন্ন দাবি, স্লোগান, কার্টুন, মুখোশ, ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করা হয়।
গানের মিছিলে ব্যাপক জনসমাগম হয়। এ মানুষের অনেকেই কেউ-কাউকে চিনত না, কিন্তু একই দাবিতে লাঠি-গুলির তোয়াক্কা না করে শামিল হয়েছিল গানের মিছিলে। মানুষ যে পরিবর্তন চাইছে, সেটা তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। গানের মিছিল শেষ হতেই খবর আসে শিক্ষক ও নাগরিক সমাজ ‘দ্রোহযাত্রা’র ডাক দিয়েছে।
২ আগস্ট দুপুর ২টা থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘দ্রোহযাত্রা’য় অংশ নিতে জড়ো হন হাজারও শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। দ্রোহযাত্রার মিছিল হাইকোর্টের মাজারগেট হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর দিয়ে শহীদ মিনারে পৌঁছায়। এ সময় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
‘দ্রোহযাত্রা’ শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে সরকারের পদত্যাগসহ চার দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি মানা না হলে রবিবার বিকাল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে গণমিছিলের কথা জানানো হয়। সেদিনের দ্রোহযাত্রায় যেসব দায়িত্বশীল নাগরিক উপস্থিত ছিলেন- অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সি আর আবরার, উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা, শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ, আসিফ নজরুল, সামিনা লুৎফা, লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রমুখ।
শিক্ষকদের রাস্তায় নামতে দেখে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি উৎসাহিত বোধ করেন। শহুরে মধ্যবিত্তের একটি অংশের ভয় কেটে যায়, যারা দ্বিধায় ভুগছিল তারা দ্বিধার বাধা ডিঙিয়ে লহমায় নেমে আসে রাজপথে। সেদিনের পর থেকে মনে হচ্ছিল সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই। মানুষের ভয় ভেঙে যায়।
তারপরের দৃশ্য দেখেছি ৫ আগস্ট। কী উত্তাল জনসমুদ্র। মানুষের কত কালের ক্ষোভ যেন আছড়ে পড়েছে শহরে-নগরে-গ্রামে। মানুষের কি উল্লাস! মনে হয় বহুকালের আরাধ্য মুক্তির স্বাদ পেয়েছে সবাই।