
২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি হলো। এই এক বছরকে বিবেচনায় নিয়ে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তিযোগ কতটুকু হয়েছে। স্মরণাতীতকালে আমাদের দেশে যেসব গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে তার তুলনায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল অনেক বেশি গভীর ও রক্তক্ষয়ী। মাত্র ৩৬ দিনে ছাত্র-জনতা প্রাণপণ যে লড়াই করেছে, তা ছিল ত্যাগ, প্রতিজ্ঞা ও নিঃস্বার্থতায় অনন্য।
স্কুলে পড়া শহীদ শিশুরা আন্দোলনের মিছিলে যাওয়ার আগে তাদের মা-বাবার কাছে যে চিরকুট লিখে গিয়েছিল, তা পড়তে আজও চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। মা-বাবা তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাড়ির ভেতরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু কি এক উন্মাদনা ওদের পেয়ে বসে যে তারা বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থাকতে রাজি ছিল না। নিষেধের বাঁধন ছিন্ন করে ওরা বাড়ি ছেড়ে রাজপথে বেরিয়ে এসেছিল প্রথম সুযোগেই। চিরকুটে লিখে গিয়েছিল, ‘মা আমার পক্ষে আর স্বার্থপর থাকা সম্ভব নয়।’
এ থেকেই বোঝা যায়- যারা জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে, বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে তাদের কোনো ভয় ছিল না। এই দুর্দমনীয় সাহসের উজ্জ্বল উদাহরণ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাইদ। তারা ভিন্ন এক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তারা চেয়েছিলেন যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসান। শেখ হাসিনার দুঃশাসন এতই ভয়াবহ ছিল যে, একে অতীতের অন্যান্য দুঃশাসনের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। সে ক্ষেত্রে এটি একক ও অদ্বিতীয়।
আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে। কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় আন্দোলনটি পরিণত হয় শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসান ও তার পদত্যাগের আন্দোলনে। দুই সহস্রাধিক মানুষ হত্যা, কয়েক সহস্র মানুষকে আহত ও পঙ্গু করেও শেখ হাসিনার রক্তপিপাসা মিটছিল না। তিনি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের হুকুম দিয়েছিলেন আরও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আন্দোলনটিকে চিরতরে দাবিয়ে দিতে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার সেই নির্মম আবদারে রাজি হয়নি। ফলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে আত্মরক্ষার জন্য ভারতে পালিয়ে যেতে হলো। অবশ্য তার পালিয়ে যাওয়ায় সহায়তা করেছেন সেনা কর্মকর্তারা। এর ফলে শেখ হাসিনা এক রক্তাক্ত পরিণতি থেকে রক্ষা পেলেন। এতে সম্ভবত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে উজ্জ্বল হলো।
শেখ হাসিনাকে বিচারবহির্ভূতভাবে জনরোষে প্রাণ হারাতে হয়নি। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন তার প্রভুর দেশে, যে প্রভুর পদযুগলে তিনি বাংলাদেশকে সমর্পণ করেছিলেন। শুধু তিনিই ভারতে পালিয়ে যাননি, তাকে অনুসরণ করেছে তার দলের লক্ষাধিক নেতা ও কর্মী। এই গণ-অভ্যুত্থানে শুধু আওয়ামী নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়নি, তাদের সঙ্গে পালিয়ে গেছে পুলিশ বাহিনীর লোকজন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যসহ অনেক কর্মকর্তা। অতীতের কোনো গণ-অভ্যুত্থানে এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।
এদিক থেকে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ছিল অনন্য। এসব সত্ত্বেও গণ-অভ্যুত্থানটি বিপ্লবে পরিণত হতে পারেনি। বিপ্লব হলো জনগণের সৃষ্টির অনন্য উৎসব। যে উৎসবের মধ্য দিয়ে পুরাতন রাষ্ট্রকাঠামো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে নতুন যুগের উপযোগী রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি হয়। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান বীরের রক্তস্রোত ও মায়ের অশ্রুধারার বিনিময়েও নতুন রাষ্ট্রকাঠামো উপহার দিতে পারল না। বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন হয় বিপ্লবী পার্টির, যে পার্টির নেতৃত্বে সংগঠিত জনগণ একটি অগ্রসর সমাজের কর্মসূচির জন্য বিপ্লবী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এ সংগ্রাম হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী, হতে পারে রুশ বিপ্লবের মতো দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিনের।
মূল কথা হলো, পুরাতন সমাজের খোলনলচে সব পাল্টে ফেলা। এমনটি হয়নি বলে এটি বিপ্লব নয়, তবে ছাত্র-জনতার মহা-অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রযন্ত্রকে এমনভাবে নিজের কুক্ষিগত করে ফেলেছিলেন, যাতে মনে হতো শেখ হাসিনাই রাষ্ট্র। এই অবস্থার ওপর আঘাত হানা এবং একে একটি পরিণতির দিকে নেওয়া সহজ কাজ ছিল না। জনতার অভূতপূর্ব ঐক্য সেই কঠিন কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব করেছে।
শেখ হাসিনার পতনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে তার ১৫ বছরের অধিক কালের শাসনে নিপীড়ন-নির্যাতন ও মানুষের ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে; তিল তিল করে মানুষ যে সংগ্রাম করেছে তার মধ্য দিয়ে। শেখ হাসিনা নির্যাতন-নিপীড়নের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। মামলা-হামলা, জেল-জুলুম, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, আয়নাঘর নামক বিভীষিকাময় গোপন কারাগারে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস মানুষকে বন্দি রেখে যে নিপীড়ন-নির্যাতনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে তা এ দেশের মানুষ অতীতে আর কখনো দেখেনি। দেশব্যাপী সর্বত্র এমন এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল যে মানুষ কথা বলতে ভয় পেত। মানুষ নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে শঙ্কা বোধ করেছে সে সময়। এমন জুলুমের রাজত্বের অবসান ঘটানো সহজ ছিল না। তবে ক্ষোভ যেভাবে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল তাতে মহাবিস্ফোরণের দাহ্য পদার্থ শুধু স্তূপীকৃত হয়। তার বিস্ফোরণই ঘটেছে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে।
শেখ হাসিনা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে মানুষের চরম ঘৃণার বিষয়ে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও মোটেও অনুতপ্ত নন। তিনি দেশবাসীর কাছে ন্যূনতম ক্ষমাটিও চাননি। কথায় বলে, চুরি তো চুরি, আরও সিনাজোরি। শেখ হাসিনার মনোভাব তেমনটি। তিনি চেষ্টায় আছেন তার ভারতীয় প্রভুদের মদদে বাংলাদেশের একটি প্রতিবিপ্লবী রক্তক্ষরণ ঘটাতে। তার জাতিবিরোধী, দেশবিরোধী ও গণবিরোধী চরিত্র কখনো পাল্টাবে বলে মনে হয় না। ভারতীয় প্রভুরা তাকে দুধ-কলা খাইয়ে পুষছে, কারণ তার সরকার বাংলাদেশটাকে কুমড়ার মতো ফালি ফালি করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল। আমাদের সীমান্ত, আমাদের দেশ, আমাদের জনগণ হয়ে পড়েছিল নিরাপত্তাহীন। আজও পুনর্বার নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে এ দেশের জনগণ ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। এই নিরাপত্তাহীনতা বোধ থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আওয়ামী বয়ানের ফলে জনগণের একাংশের মধ্যে অহেতুক ভারতপ্রীতি জমাট বেঁধেছিল। এই জমাট বাঁধা ভারতপ্রীতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ন্যুব্জ ও খর্ব করে ফেলেছিল। এখন নতুন চেতনার সঞ্চার হয়েছে। এটাই আশার কথা, আর এটাই হলো এই অভ্যুত্থান থেকে আমাদের বড় প্রাপ্তি।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামীবিরোধী ও আগ্রাসনবিরোধী বিশাল এক গণ ঐক্য গড়ে উঠেছিল। আওয়ামী বলয়ের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য দেখে জনগণ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু যতই দিন গড়াতে লাগল ততই আমরা দেখলাম এই ঐক্যে ফাটল ধরছে এবং ক্রমাগত এই ফাটল বাড়ছে। এতে লাভ কার? লাভ পতিত ফ্যাসিবাদের ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের। রাজনৈতিক দলগুলো সংকীর্ণ গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না। ক্ষুদ্র ও মামুলি স্বার্থে বিভাজন বাড়ছে। শুধু তা-ই নয়, এর সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিবাদের দোসররা পুনর্বাসিত হচ্ছে, এমনকি ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অন্দর মহলে জায়গা করে নিচ্ছে বলেও অনেকে মনে করেন। এটা এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। যদি তা না পারা যায়, তা হবে শহীদদের রক্তের প্রতি চরম বেঈমানি।
২৪-এর অভ্যুত্থানের পর এমন বেঈমানির সুযোগ কাউকে গ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না। এটাই হলো চব্বিশের শিক্ষা।
২৪-এর অভ্যুত্থানের মুখে দেশ বদল বা দিন বদলের লিখিত বা উচ্চারিত কর্মসূচি ছিল না। ফলে এই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাখ্যায় ডান-বাম ও মধ্যপন্থিদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির সুযোগ ঘটেছে। অভ্যুত্থানের পর, বলতে গেলে বেশ কিছুদিন পর তরুণ নেতৃত্ব জুলাই ঘোষণাপত্রের কথা বলতে শুরু করল। কিন্তু তা নিয়েও কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বিষয়টি দুঃখজনক। এ ব্যাপারে যদি ন্যূনতম একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতের দিনগুলোতে যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে জনগণ ঘোষণাপত্রের মর্মবাণী প্রতিষ্ঠার দাবি তুলতে পারবে। সেটা হবে জাতির জন্য আশাব্যাঞ্জক। জুলাই সনদ বা জুলাই ঘোষণাপত্র যদি রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম বিষয়ে একমত হয়ে জনগণকে উপহার দিতে পারত, তাহলে আমার দৃষ্টিতে সেটাই হতে পারে জুলাই অভ্যুত্থানের অনন্য অবদান।