Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক’ কতদূর

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৬:০৭

শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক’ কতদূর

২৯ জুলাইয়ের কথা আমরা কি মনে রেখেছি? ২০১৮ সালের কথা।  মাত্র সাত বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ বিস্মরণের অমোঘ অভিধায় মনে হচ্ছে আমরা কোনো কিছুই মনে রাখি না। আমরা আন্দোলন করি, সংগ্রাম করি, কিন্তু ঘরে ফিরে সব ভুলে যাই। এই সেদিনের কথা, জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বেপরোয়া বাসের চাপায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজীব নিহত হয়। স্কুলে পড়া ছাত্ররা এই অপকাণ্ডের প্রতিবাদে সবাই রাস্তায় নেমে আসে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি নিয়ে তারা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাদের আন্দোলনের মুখে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীর যান চলাচল। তারপর সে আন্দোলনের শিখা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। প্রাথমিকভাবে ‘রাজীব-দিয়া হত্যার বিচার চাই’ স্লোগানে আন্দোলনের সূচনা হলেও পরে তা এক বৃহৎ আন্দোলনে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক আন্দোলনে সমর্থন জানায় দেশের আপামর জনতা। কীভাবে গোটা রাজধানীতে ট্রাফিক-ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করতে হয় এবং যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হয়, সেই আন্দোলনমুখর সময়ে সাধারণ ছাত্ররা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। আমরা ভাবতাম এই প্রজন্মটি তেমন কিছু বোঝে না, স্কুল কলেজেও ভালো পড়াশোনা করে না, সারা দিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে তাদের পরিপক্বতা দেখে সবাই বিস্মিত হয়েছিল। তেমন কিছু না বোঝা ছেলেরা সড়ক বন্ধ করে লিখে রেখেছিল ‘রাষ্ট্র মেরামত কাজে সামান্য কষ্ট হওয়ার জন্য দুঃখিত।’ এমন অজস্র সেøাগান প্ল্যাকার্ডে লিখে তারা সারা দেশের সড়কের দখল নিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, কোথাও কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও গাড়ির চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করতে দেখা গেছে। তারা সামরিক বাহিনীর গাড়িও আটকে দিয়েছিল। সেই আন্দোলনের কঠিন মুহূর্তে অভিভাবকরাও খাবার পানি নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

তৎকালীন সরকার প্রথম দিকে এই আন্দোলনকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে ‘নিরাপদ সড়কে’র দাবিতে শুরু করা আন্দোলনে যখন সারা দেশ অচল হয়ে যায় তখন তারা গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়। আন্দোলনে সেদিন পথে নেমেছিল সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। এক শিক্ষার্থীর জন্য আরেক শিক্ষার্থী অন্তর্গত সংহতি জানাতে চলে আসে সড়কে। ফলে সরকার বাধ্য হয় আন্দোলনের দাবিদাওয়াকে মেনে নিতে। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে কোনো মৃত্যু ঘটলে চালকের মৃত্যুদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রেখে সে বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার। সেপ্টেম্বরে আইনটি পাস হলেও সেটি কার্যকর করা হয় পরের বছরের ১ নভেম্বর। 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সাত বছর পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু সড়কে শান্তি আসেনি। বরং দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। ছাত্রদের আন্দোলনের ফলে ১৯ সেপ্টেম্বর সরকার যে পরিবহন আইন পাস করে অল্প দিনেই তা গুরুত্ব হারায়। সরকারের পাস করা  আইন শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিক্ষোভ-কর্মবিরতির মুখে আইন শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এত বড় আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার পরও সড়ক নিরাপত্তার স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি শিক্ষার্থীদের। সড়ক দুর্ঘনা এখনো নিত্যদিনের ঘটনা, এ ঘটনা বাড়ছেই। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়কের দুর্বল অবকাঠামো, ত্রুটিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অনভিজ্ঞ ও মাদকাসক্ত চালক এবং প্রধান সড়কগুলোতে নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলের কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষত আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে সড়কে পুলিশের সংখ্যা প্রথম দিকে ছিল না। শিক্ষার্থীরা সড়কের নিরাপত্তা দিত। এখনো অনেক সড়কে পুলিশের সঙ্গে কমিউনিটি পুলিশ নামে এলাকার তরুণদের দেখা গেলেও সড়কের অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। বিশেষত আমাদের সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় যারা নিবেদিত তাদের চরিত্র সবার জানা। তাদের জন্যই সড়কে ফিটনেসহীন গাড়ি, চলার অযোগ্য গাড়ি টিকে থাকে। অর্থাৎ অব্যবস্থাপনার সঙ্গে সড়কের নিরাপত্তা বলতে যা কিছু বোঝায় তার কিছু আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু চলতি বছর জুন মাসেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭১১ জনের মৃত্যু এবং এক হাজার ৯০২ জন আহত হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ছয় হাজার ৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ২৯৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১২ হাজার ১৯ জন। 

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সড়কে মানুষের জীবন এখন মূল্যহীন। ত্রুটিপূর্ণ রোড ইঞ্জিনিয়ারিং, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালানোয় বাড়ছে দুর্ঘটনা। ২০২৪ সালে সরকার ‘মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা’ জারি করলেও তা প্রয়োগের নির্দেশনা না থাকায় সুফল মিলছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মামলার ১ শতাংশেরও চূড়ান্ত বিচার হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ১৯৯৭ সালে সুইডিশ পার্লামেন্ট প্রাণহানি শূন্যে নামিয়ে আনতে আইন পাস করে। এ লক্ষ্য অর্জনে দেশটি যানবাহনের মানোন্নয়ন, গতি কমানো, সড়ক উন্নয়ন ও দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় বিপুল বিনিয়োগ করে। সড়কের মাঝের লেন দিয়ে ওভারটেকিংয়ের নিয়ম চালু করে। এতে দুর্ঘটনা ৬৬ শতাংশ কমে যায়। বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সরকার সড়ক পরিবহন আইন করে। কিন্তু সরকারের ভেতরে মালিক ও শ্রমিক নেতৃত্ব প্রভাবশালী হওয়ায় আইন সংশোধন করেছিল সরকার। ফলে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবির আন্দোলন আর হালে পানি পায়নি।

সড়ক নিরাপদ করতে গেলে সার্বিক ব্যবস্থাপনা, সড়ক ও মহাসড়কের দিকে সার্বিক দৃষ্টি রাখার বিকল্প নেই। যেসব যান অনিরাপদ এবং অনুমোদনহীন, এগুলোর কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেÑএ কথা সবার জানা। তার পরও একই ঘটনা ঘটছে দিনের পর দিন। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। ২০১৮ সালের সেই ছাত্র আন্দোলনের সাত বছর পূর্ণ হলেও আইনের বাস্তবায়ন হয়নি। সড়কেও আসেনি শৃঙ্খলা। ঘর থেকে বের হওয়ার পরে কেউ ঘরে ফিরতে পারবে কি না তা জানে না কেউ।  কিন্তু প্রশ্ন হলো বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫