
৩৬ জুলাই নিয়ে আমার একটি সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা আছে। বিভিন্ন মঞ্চে যখন আমাকে কথা বলার জন্য ডাকা হয়, বিশেষ করে নতুন দেশ ও স্বাধীনতা নিয়ে, আমি তখন আমাদের সাংস্কৃতিক পরাধীনতার কথা বলি। আমরা রাজনৈতিক ও সীমান্তগতভাবে স্বাধীন হলেও সাংস্কৃতিক পরিচর্যায় পরাধীন।
আমাদের সাংস্কৃতিক যে ধারাবাহিকতা, তা হাজার বছরের পুরোনো। সেন রাজাদের ধুতি পরার পরাধীনতা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। তারপর ইংরেজ পরাধীনতার রাজনৈতিক শাসন-শোষণ ভেদ করে স্বাধীন হতেও কম জীবন ও রক্ত ঝরাতে হয়নি। কিন্তু তার পরও আমরা দেখতে পেলাম শার্ট ও প্যান্ট না পরলে, স্যুটেড-বুটেড না থাকলে নিজেকে ‘ভদ্দরনোক’ মনে হয় না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফুটফাট ইংরেজি না বললে নিজেকে শিক্ষিতজন ভাবতে পারি না। এই মন, মনন ও মানসিকতা-এটাই হচ্ছে কালচারাল হেজেমনি বা ইউরো-সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের অন্তর্গত সত্য রক্তধারা।
ব্রিটিশরা ১৯০ বছর শাসন করে চলে গেছে। কিন্তু আমাদের কালচারকে দূষিত করে গেছে, যাতে আমরা বাংলা সন-তারিখ ভুলে যাই। কারণ তাতেই প্রমাণ হবে আমরা পিছিয়ে আছি, পিছিয়ে পড়েছি। এই যে মনে করার চেতনা প্রবাহিত হচ্ছে-এই ধারণা ও বিশ্বাস থেকে নিজেদের বের করতে পারছি না। ৩৬ জুলাইয়ের তরুণরা সেটা সামান্য হলেও পেরেছে এবং চিন্তাধারায় একটি বাধার শির ধসিয়ে দিয়েছে।
আমি একেই বলি, ‘আমরা মনন ও মানসিকভাবে পরাধীন’। আমরা ইউরোপিয়ান জ্ঞানধারাকেই প্রাগ্রসর, আধুনিক ও চলমান বৈশ্বিক উপযোগী বলে বিবেচনা করি। মগজ দখল করার এই কুবুদ্ধিদাতা হচ্ছে মেকলে। তিনি বলেছিলেন, নেটিভদের তোমরা শিক্ষা-দীক্ষায়, পোশাকে-আশাকে ইংরেজ বানাও, দেখবে আমাদের শাসন ও শোষণ অব্যাহত থাকবে।
আমরা পোশাকে, শিক্ষায়, অ্যাটিকেটে, মন ও মানসিকতায় ইউরো কালচারের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে নিজেদের কালচারালি পরাধীন প্রমাণ করেছি। কিন্তু সেটা বুঝতেও পারছি না। কারণ ওই কালচারাল হেজেমেনির, আভিজাত্যিক বোধের বড়শিতে গাঁথা এক একটি তরতাজা বাংলাদেশি, মানুষ। বাংলাদেশ এবং গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক রূপ এটাই।
দুই.
এবারই প্রথম ছাত্র-জনতা সেই কালচারাল হেজেমনির ধারাবাহিকতার প্রবাহকে সামান্য হলেও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে-৫ আগস্ট না লিখে ৩৬ জুলাই লিখে। এটা তাদের নতুন চেতনা, নতুন জ্ঞানের লক্ষণ। তারা যদি ৫ আগস্টকে লিখত শ্রাবণের ১৬/ ১৭/১৮/১৯ তারিখ, যা বাংলা সন-তারিখ, তাহলে ওই সাংস্কৃতিক পরাধীনতার অদৃশ্য দেওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়ার সূচনা হতো। কিন্তু গণমানুষের সঙ্গে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক গ্যাপ বা ফাঁক, তাকে পূরণ করা যেত না। যোগাযোগের স্বাভাবিক ও সাধারণ স্রোতের মধ্যে থেকেও যে নিজেদের প্রতিবাদী অস্তিত্বকে প্রকাশ/জানান দেওয়া যায়, ৩৬ জুলাই লিখে সেটা প্রমাণ করা গেছে। এভাবে আমরা ফিরে আসতে পারতাম/পারি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির হাজার বছরের ধারায়। বুঝতে পারতাম, আমরা ইউরোপিয়ান কালচারাল হেজেমনির, আভিজাত্যিক ‘অন্ধকারে’ উটপাখির মতো মাথা গুঁজে রেখেছি।
তিন.
এখনো অনেককে বলতে শুনি-৫ আগস্টকে কেন ৩৬ জুলাই লিখছি? কেন একে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছি? কেউ কেউ বলেন, দেশের স্বাধীনতা তো একবারই অর্জন করতে হয়। তাদের মাথায় একবারও খেলে না যে বাংলাদেশ কেবল এবারই স্বাধীন হলো না, এর আগেও হয়েছে। ১৯৭১ সালেই কি প্রথম স্বাধীন হয়েছে? ১৯৪৭ সালে তাহলে কী হয়েছিল? পাকিস্তানি শাসনামল ছিল পরাধীনতার আরেকটি রূপ ও কাঠামো। মানলাম। যদি ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে যুক্ত করে যেত ব্রিটিশ শাসক, তা কি ওই পাকিস্তানিদের মতো পরাধীনতাই আমাদের গ্রাস করত না?
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, না হতো না। কারণ তারা আমাদের মতোই বাংলায় কথা বলে। ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক এবং জনগণের ভাষা বাংলা নয় হিন্দি, সেটা মনে রাখলে এমন কথা উচ্চারিত হতো না। বিষয়টি যে ভাষাগত নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার, বাকস্বাধীনতার, চিন্তার স্বাধীনতার, কর্ম ও মর্ম-ধারণ ও অধিকার অর্জনের স্বাধীনতার-সে খেয়াল কি প্রশ্ন কর্তাদের আছে? অনেকে বলেন, পাকিস্তানিরা ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্নভাষী, উর্দু তাদের মাতৃবুলি, সে জন্য কালচারালি আমাদের সঙ্গে তাদের মেলে না।
এতটাই মূর্খের বয়ান, এটা যে কি বলব। যারা ভাষার ইতিহাস জানেন, তারা কিছুটা বুঝবেন। ড. সুনীতি, ড. শহীদুল্লাহসহ সব ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর পন্ডিতরা মনে করেন অর্বাচীন প্রাকৃত ভাষা থেকে একই সঙ্গে জন্মেছে বাংলা, উর্দু, হিন্দি ও আসামি ভাষা। ফলে এরা সহোদর, একটি ভাষাবোধের অধিকারী। পাকিস্তানিরা যেভাবে আমাদের শাসন ও শোষণ করেছে, হিন্দিভাষী ভারতীয়রাও সেটাই করত। কারণ শাসন ও শোষণ বিষয়টি রাজনৈতিক, প্রশাসন বিষয়। পাকিস্তানিরা যদি আমাদের শত্রু হয়, তাহলে ভারতের হিন্দিভাষীরাও একই রকম চরম শত্রু আমাদের। চারপাশের কোনো দেশই আমাদের বন্ধু দেশ নেই, যারা আমাদের রাজনৈতিক-সামরিক হুমকির সময় পাশে এসে দাঁড়াবে।
চার.
৩৬ জুলাই যারা দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলেছে, তারা বয়সে তরুণ। এদের গড় বয়স ৩৭ থেকে ৪০-এর মধ্যে। এরাই আমাদের জনশক্তির প্রধান নিয়ামক বা প্রবাহ। এদের বঞ্চিত করে পরাজিত ও পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার পালক রাজনৈতিক পুত্রপুত্রীদের সেই দখলি ভূমিতে বসিয়েছিল। কেননা তারা ছিল আওয়ামী লীগের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর একটি অংশ। তাদের জন্যই মুক্তিযোদ্ধার নামে কোটা, উপজাতি নৃগোষ্ঠীর জন্য কোটা, পিছিয়ে পরা জনপদের নামে কোটা রেখে আওয়ামী-ছাত্রলীগকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। যে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ২০১৬-এর সময়, তা অব্যাহত থাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর মহলে বছরের পর বছর ধরে। আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপিই প্রথম প্রতিবাদ তোলে। তাদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী দুঃশাসনের শিকড় উৎপাটন। কিন্তু রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির কারণে আওয়ামী লীগ বাল্ক অব দুর্নীতি, দুঃশাসন, গুম, খুন ও অর্থবিত্ত লুটপাটের পরও বিএনপি বুঝতেই পারেনি যে এই রাজনৈতিক পথে স্বৈরাচার উৎখাত সম্ভব নয়। এই দেশের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টি সব সময় ঢাকা পড়ে থাকে। বিশেষ করে বিএনপির ভেতরে যারা অথর্ব রাজনীতিক, তাদের দিয়ে আর যাই হোক জগদ্দল স্বৈরাচার হাসিনার ভারতীয় শিকড় উৎখাত করা যাবে না। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতি ও ঘুষখোর প্রশাসনের হাতে দেশ কখনোই সামনে এগোতে পারবে না। সংস্কারের লক্ষ্যে ৩১ দফা দেওয়ার পর দেশবাসী বুঝল যে একমাত্র তারেক রহমানকে কেন পঙ্গু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।
যখন তারেক রহমান এটা বুঝলেন যে, তাকে নতুন করে সাজাতে হবে রাজনৈতিক যুদ্ধের ময়দান, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার রাজনৈতিক সাথিরা যে দুর্নীতিগ্রস্ত, এক একজন বিভিন্ন এলাকার ঠেক বা শাসক হিসেবে বহাল, তাই হাসিনার প্রকৃত শুভাকাক্সক্ষীরাই বিপ্লবের মাধ্যমে হাসিনার ভারতীয় শিকড় রক্ষা করেছিল।
বিষয়টি বোঝার পর রাজনীতিতে নতুন নতুন পথ নির্মাণ করতে হবে তা বুঝেছিলেন তারেক রহমান। চিন্তাশীল, প্রজ্ঞাবান মানুষের উপস্থিতি প্রয়োজন পড়ে। তারেক রহমানের চারপাশে আজকে দু-চারজন প্রজ্ঞাবানকে দেখা গেলেও তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিক ক্ষমতার প্র্যাকটিস আমরা দেখিনি। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের শারীরিক ভাষা, মানসিক স্থিরতার যে রূপ আমরা দেখতে চাই, তা ৯৭-৯৮ জনের মধ্যে নেই। কিন্তু তাদের আছে বিপুল জনগণের সমর্থন এবং এরা বয়সে তরুণ। এদের বয়সের গড় ২০ থেকে ৫০-এর মধ্যে, যারা চিন্তা করার অধিকারী, যারা কর্মক্ষম, যারা প্রাযুক্তিক বিদ্যায় প্রাগ্রসর হতে চায়। এবং এদের একটি বড় অংশ বিভিন্নভাবে দেশে ও বিদেশে প্রযুক্তি কর্মে নিয়োজিত। এদের অ্যাড্রেস করা জরুরি।
পাঁচ.
কারো কারো মনে হতে পারে, আমার কথাগুলো বিএনপির জন্য তৈরি। আসলে জ্ঞানজগৎ ও প্রযুক্তিজগতের তরুণেরা নিজের স্কিল ও মান নিয়ে যেমন ভাবে, তেমনি দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা অপরিসীম। তারা কমিটেড।
আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে যারা ভাবনাশীল ও নিজেকে নবায়ন করতে আগ্রহী তারা রাজনীতিক। আর যারা পদ আর পদবি নিয়ে বসে আছেন, তারা কথাবার্তায় পুরোনো ধারারই কলাকৌশলের যাত্রী।
রাজনীতি যে পাল্টে গেছে, চিন্তারাজ্যের দখল যে তরুণেরা নিয়ে গেছে, পাকা চুল, পাকা গোঁফ-দাড়িওয়ালারা তা জানতে ও বুঝতে পারেননি।
গোলাপবাগ ময়দানের জমায়েত ঠেকাতে পারেননি শেখ হাসিনা, ১০ লাখেরও বেশি মানুষ ঢাকায় এসে হাসিনার পতনকে দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের দো-নছলা চরিত্রের কারণে দিল্লির দাসি আরো কিছুদিন ক্ষমতায় থেকে যায়। আর তরুণেরা কোটা আন্দোলনকে কী করে ১৯-২০ দিনের মধ্যে কতগুলো স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট থেকে মোচড় মেরে এর গতিকে হাসিনার শিকড় উৎপাটনমুখী উন্মাতাল জনস্রোতে পরিণত করেছিল, সেটা খেয়াল করুন। এবং ভাবুন কেন, কারা সেই চেতনার মৌল চিন্তাশক্তি।
ছয়.
জিওপলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট অব ভিউ থেকে যদি বাংলাদেশের অবস্থানকে বিবেচনা করি, তাহলে কি দেখি? আমাদের এই উর্বর ভূমির দেশটি পৃথিবীর উর্বর ভূমিগুলোর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত।
দ্বিতীয়ত, এই সুজল-সুফলা শস্য-শ্যামলা দেশের চারদিকেই আছে অমুসলিম দেশ। আমি ইচ্ছা করেই হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, কনফুসিয়াস ইত্যাদি ধর্মভিত্তিক শব্দ এড়িয়ে মানুষ হিসেবে তাদের গণ্য করছি। কিন্তু আজকের পৃথিবী যতটা না মানুষের, তারও চেয়ে ওই সব ধর্মগোষ্ঠীর। এ কারণেই ইহুদিদের হত্যাযজ্ঞ ফিলিস্তিনিদের ওপর নাজিল হয়েছে।
এই বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে উর্বর ভূমির নিরাপত্তার স্বার্থে ‘জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্য’ খুব জরুরি। এই ব্যাপারে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সচেতন ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদিতার ব্যাপারে। তবে আওয়ামী অন্ধ লেসপেনসারা নন। তারা লেজুড়বৃত্তি করে যা কামাই করতে চান, চেয়েছেন ১৬ বছরে তা করেছেন। এদের অধিকাংশই পলায়ন করে ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন হাসিনার মতো।
১৯৪৭-উত্তর বাংলাদেশকে কলে-বলে-কলে-কৌশলে নিজেদের বগলের নিচের লোমের মতো করে গ্রাস করার কলা তারা নিয়তই চালিয়ে আসছে।
পৃথিবীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তার বিশ্লেষক প্রফেসর স্যামুয়েল হান্টিংটনের একটি বই ‘দ্য ক্লাস অব টু সিভিলাইজেশন’-এ তিনি দেখিয়েছেন যে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে মূল সংঘাত হবে ইসলামিক সিভিলাইজেশনের। কে না জানে যে সাংস্কৃতিক প্রবাহের স্ট্র্যাকচার বা ফল দেখা দেয় বিভিন্ন অকারণ ও বিশ্বাসের ভেতর দিয়ে। বিশ্বাস ও কালচারাল স্থাপনার ডিজাইনেই তার প্রতিফলন ঘটে।
কারণ ইসলামিক সিভিলাইজেশনের প্রবৃদ্ধির হার এখন দ্রুতগতির। ইউরোপ-আমেরিকার কালচার হচ্ছে খ্রিষ্টবাদী, কিন্তু বিশ্বাসহীন। তারা রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে পরধন লুণ্ঠনের প্রতি আসক্ত। গোটা উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা দখল, ভোগ ও লুটপাটের পর তারা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে পাঠায় সম্পদ লোটার জন্য। ভারত লুণ্ঠনের পর তারা ইউরোপের উসমানিয়া সাম্রাজ্যকে খণ্ডবিখণ্ড করে দেয় মুসলিম ক্ষমতা-লিপ্সুদের সহযোগিতায়। ফলে ইসলামিক কালচার ও তার আকরণ বা স্ট্র্যাকচারগুলো ধ্বংসের মুখে পড়ে। ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়া মসজিদ কতবার বিভিন্ন ধর্মীয় শাসকের হাতে সংস্কৃত হয়েছে, এটাই তার একটি মাত্র প্রমাণ। হান্টিংটন অনুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ইসলামই হচ্ছে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৯০ সালে এই নামে তিনি একটি পেপার উপস্থাপন করেছিলেন এক সেমিনারে। পরে তা বড় করে বই হিসেবে প্রকাশ করেন ১৯৯৪-৯৫ সালে।
যদি মন ও মানসিকতা বিক্ষিপ্ত না থাকে, তাহলে ১৯৮০ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমেরিকার আগ্রাসি নীতি ও মুসলিম দেশগুলো ধ্বংস করার যুদ্ধগুলোর নির্মমতা নিশ্চয়ই মনে পড়বে। ইরাক বা সাদ্দাম হোসেনকে প্ররোচিত করে ইরান আক্রমণ, এটা ৮০-এর দশকের ঘটনা। অস্ত্র নির্মাতাদের চাপের কাছে পরাজিত মানুষের রাজনৈতিক ইচ্ছা। ইরানের সামরিক ক্ষমতা আর আমেরিকান বন্দিদের উদ্ধার অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর তারা ইরাককে প্ররোচিত করে কুয়েত দখল এবং তেল সম্পদ নিঃস্ব করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র পাকায়। এরপর ইরাককে সামরিক টার্গেটে পরিণত করে সাদ্দাম হোসেনকেই কেবল মেরে ফেলেনি আমেরিকা, গোটা দেশ ও জনগণকে ধ্বংস করেছে। তারপর আফগানিস্তানকে গ্রাস করেও গিলতে ব্যর্থ আমেরিকা প্রত্যাবর্তনের লজ্জা নিয়ে ফিরে যায়। এবার তার টার্গেট সিরিয়া। সেখানকার তাদেরই শিখণ্ডি হাফিজ আল আসাদ ও ওই দেশের মানুষকে এমন এক অর্থনৈতিক দুরবস্থায় নিয়ে যায়, যাতে তাদের রাজনৈতিক কোমর শক্ত না থাকতে পারে। দেশটিকে মিসমার করে আসাদকে উৎখাত করে নিজেদের এজেন্টকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে আমেরিকা। এখন ফিলিস্তিনকে ভূমিধসের মতো করে সে দেশের মানুষকে হত্যা করে চলেছে ইসরায়েল, আমেরিকান অস্ত্র তার প্রধান শক্তি। এরপর ইরানকে ধ্বংস করে পাকিস্তানকে শায়েস্তার প্ল্যান স্যামুয়েল হান্টিংটনের ইঙ্গিতপূর্ণ সংঘাতকেই নির্দেশ করে।
এ কারণেই বাংলাদেশকে নতুন জমানার তরুণদের হাতে সৃষ্টি করতে হবে। তারাই বলবে, কিভাবে আমরা চারপাশের রাজনৈতিক ও সামরিক শত্রুদের ঠেকাব। কিভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। কিভাবে আমাদের ভূ-রাজনৈতিক উত্থানকে নতুন ডাইমেনশনে নিয়ে যাব।
৩৬ জুলাইকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি। তবে তাদের জানতে ও বুঝতে হবে, কেন তারা হাসিনার ফেলে যাওয়া ব্রিটিশ পরিত্যক্ত একটি ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে ঢুকে গেল। তারা যে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে, সেই জনআকাক্সক্ষার প্রতি তারা কমিটেড ছিল না। তাদের আরো জানতে ও বুঝতে হবে। বিপ্লব কখনো একটি ঔপনিবেশিক টানেলে মাথা ঢুকিয়ে দেয় না। যে নতুন সংবিধান ও প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য ২৭ হাজার মানুষ হতাহত হলো, যারা জান দিয়ে, আহত হয়ে যে ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে, তাদের সেই আশার রূপই তো তরুণেরা বুঝতে পারেনি, এখনো পারছে না। এখন একটি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ভেতরে যে সংস্কারকাজ চলছে, তা যে লাউ, সেই কদুই হতে দেখছি আমরা।
বাংলাদেশ আমার কাছে প্রধান ও প্রথম শর্ত। কারণ এই বাংলাদেশ নির্মাণে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি ও আমরা কারো এজেন্ট হিসেবে কাজ করব না, করতে পারি না। অর্থাৎ আমাদের হতে হবে মোহমুক্ত দেশপ্রেমিক। মনে রাখতে বলি আবারও আমাদের চারপাশে কোনো বন্ধু দেশ নেই, যারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে দুর্দিনে।