Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ফ্যাসিবাদের দরজা ও গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতি

Icon

কবীর আলমগীর

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫, ১২:৩৩

ফ্যাসিবাদের দরজা ও গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতি

দীর্ঘদিন ধরে থাকা রাষ্ট্রীয় অনিয়ম, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়ন ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিস্ফোরণ থেকেই ২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত। এই পরিণতির ফলে পুরোনো ক্ষমতাকাঠামো ভেঙে পড়ে এবং অন্তর্বর্তী একটি সরকার গণদাবির ভিত্তিতে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক রূপরেখা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয়। প্রশ্ন আসে এই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত? কী ধরনের রাজনৈতিক চর্চা ও পরিবেশ তৈরি হওয়া জরুরি, ভবিষ্যতে যেন ফ্যাসিবাদ আর ফিরে না আসে কিংবা পুনর্বাসিত না হয়। দেশে জাতীয় নির্বাচন হবে, কোনো না কোনো দল ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ বিকশিত যে হবে না, তার নিশ্চয়তা কি এখনো পেয়েছি আমরা?

গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত অর্জন তখনই নিশ্চিত হবে, যখন রাজনীতি হবে গণমুখী, অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অতীতে এমন এক রূপ ধারণ করেছিল, যেখানে ভোট বলতে কিছু ছিল না। ভোটের নামে জনগণের সঙ্গে তামাশা করেছিল হাসিনা সরকার। দিনের ভোট রাতে করা, ইভিএম কারচুপি, ডামি নির্বাচন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সবকিছুই করা হয়েছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে শক্তপোক্ত করতে। গণ-অভ্যুত্থানের পরে এই ধারাকে বদলাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে। কণ্ঠরোধ নয়, বরং মতপার্থক্য ও সমালোচনাকে লালন করতে হবে।

রাজনীতির চর্চাকে পেশিশক্তি ও পুঁজির দখল থেকে মুক্ত করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির অভ্যন্তরে যে গোষ্ঠীবাদ, পরিবারতন্ত্র গড়ে উঠেছে তা ভেঙে ফেলার সময় এখন। দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এক রাজনৈতিক শ্রেণি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থরক্ষায়। ফলে রাজনীতি হয়ে উঠেছিল ধনিক ও সুবিধাভোগী শ্রেণির নিয়ন্ত্রিত এক কৌশল। সেখানে আদর্শ, ত্যাগ বা জনসেবার জায়গা ছিল না। গণ-অভ্যুত্থান সেই কৌশলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। ভবিষ্যতের রাজনীতি হতে হবে নীতিনিষ্ঠ, আদর্শভিত্তিক এবং জনমানুষের বাস্তব প্রয়োজন ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। তরুণদের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমেই এই রূপান্তর সম্ভব।

রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা ও সমালোচনাকে সম্মান করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরোধী দলকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা প্রবল। ক্ষমতায় থাকলে প্রতিপক্ষকে দেশবিরোধী, ষড়যন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে দমন করা হয়েছে। আবার বিরোধী দলে থাকলে সবকিছুতে ষড়যন্ত্র খোঁজার একটি নৈরাজ্যিক মানসিকতা তৈরি হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের পরে এই রাজনৈতিক মেরুকরণ ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি বদলাতে না পারলে দেশে কোনো সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে উঠবে না। ভবিষ্যতের রাজনীতিতে ভিন্নমতকে দমন নয়, যুক্তির মাধ্যমে তাদের অংশীদারি স্বীকার করে নিতে হবে।

প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারি নিশ্চিত না করা গেলে রাজনৈতিক সংস্কার ব্যর্থ হবে। অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে প্রশাসনে দলীয়করণ হয়েছে, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে পুলিশ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সবখানেই দলীয় আনুগত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর ফলে জনগণের আস্থা হারিয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। গণ-অভ্যুত্থানের পরে এই ভাঙন পুনর্গঠনের দায়ভার রাজনৈতিক নেতৃত্বের। প্রতিটি নিয়োগ ও পদোন্নতিতে মেধা, দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতাকে প্রধান বিবেচনায় আনতে হবে। 

রাজনীতির চর্চায় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশীলনও অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। দলীয় প্রপাগান্ডা ও ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নির্ভর বক্তৃতা দিয়ে রাজনীতিকে আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। প্রয়োজন গভীর পাঠ ও বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক পরিকল্পনার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনীতির জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে পুনরায় গড়ে তুলতে হবে, যেখানে তরুণরা ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে নতুন নেতৃত্ব গঠনে নিজেদের প্রস্তুত করবে। একইভাবে নাগরিক সমাজের সংগঠন ও স্বতন্ত্র বুদ্ধিজীবীদের মতামতকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনীতির পরিবেশকে শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ করে তুলতে গণমাধ্যমের ভূমিকাও বিশেষভাবে বিবেচ্য। অতীতে রাষ্ট্র ও করপোরেট স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম জনমতের বিকৃতি ঘটিয়েছে, মিথ্যা প্রচারণায় মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে এবং রাজনৈতিক বিভাজনকে উসকে দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমকে তথ্যভিত্তিক, নিরপেক্ষ ও সাহসী হতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে আইনি ও সামাজিকভাবে। 

অবশেষে রাজনীতি হতে হবে মানবিক ও ন্যায়নিষ্ঠ। যে রাজনীতি গরিব, শ্রমজীবী, সংখ্যালঘু, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের পরিবর্তন আনে না, সে রাজনীতি জনগণের নয়। 

২০২৪-এ ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থান একটি মূল্যবোধগত জাগরণ। দেশের মানুষ একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে চায়। জনগণ চায় না আর দলান্ধতা, ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা শাসকের দম্ভ। তারা চায় এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে মানুষ কথা বলতে পারে, ভোট দিতে পারে, সংগঠিত হতে পারে এবং রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে ভয় ছাড়াই।

এই রাজনীতি বাস্তবায়ন করাই এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ। যদি রাজনৈতিক নেতারা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দেয় তাহলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।

গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা একটি নতুন পথের সম্ভাবনা তৈরি করলেও প্রশ্ন রয়ে গেছে, আমরা কি সত্যিই ফ্যাসিবাদের ঘূর্ণিপাক থেকে বের হতে পেরেছি? নাকি আবারও সেই দমন-পীড়নের চক্রে ফিরে যাব? কারণ ফ্যাসিবাদ কেবল দমনমূলক সরকার নয়, বরং একটি দমনচিন্তা; যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে, বিরোধী মতকে শত্রু মনে করা হয়, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বৈধতা পায় এবং জনগণের অংশগ্রহণ প্রহসনে পরিণত হয়।

এই পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি তৈরি হয় যখন রাজনৈতিক সংস্কারের নামে দলীয় কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে আপস করা হয়। তবে ফ্যাসিবাদের দরজা চিরতরে বন্ধ করবার পথও আমাদের সামনে রয়েছে। প্রথমত, সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি মজবুত করতে হবে। সংবিধানকে দলীয় স্বার্থের বাইরে এনে জন-ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে, যেন রাজনৈতিক ক্ষমতা পালাবদলের সুযোগ তৈরি হয়। তৃতীয়ত, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

সবচেয়ে জরুরি, জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও সক্রিয়তা ধরে রাখা, যা ছিল গণ-অভ্যুত্থানের প্রাণ। যদি সেই জাগরণ আত্মসমালোচনাহীন আত্মতুষ্টিতে পরিণত হয়, তবে ফ্যাসিবাদ আবারও ফিরে আসবে। যদি আমরা সুযোগ তৈরি করে দিই ফ্যাসিবাদ ফিরবে আরো জোরালো হয়ে, মুখোশ পরে। কিন্তু যদি জনগণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়ত অংশ নেয়, সংগঠিত হয়, মত প্রকাশে সোচ্চার থাকে, তবে ফ্যাসিবাদ শুধু প্রতিহতই নয়, পরাজিতও হবে। সুতরাং বাংলাদেশের সামনে এখন রয়েছে সংকট ও সম্ভাবনার দ্বিমুখী পথ। এই সংকটকে উতরে যেতে হবে, পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। রাজনীতির আপসমুখী দরজা দিয়ে ফ্যাসিবাদ যেন কোনো দিনও এই জনপদে ফিরে না আসে, সে ব্যাপারে সোচ্চার থাকতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫