
আমি গানের কোনো বোদ্ধা সমঝদার নই, তবে গান শুনতে ভীষণ ভালো লাগে। সারাক্ষণ শুনি। কাজের মাঝে শুনি, ফাঁক পেলে শুনি, উঠে শুনি, শুতে যাবার আগে শুনি। সব রকম গান। পুরান-নতুন সব। ৭৩+ বয়স হওয়ার এটাই সুবিধা। অনেক আগেকার থেকে, এখনকার সময়ের গান পর্যন্ত সব শুনতে ভালো লাগে।
আমি কিছুটা ত্রিভাষি-বাংলা, উর্দু/হিন্দি ও ইংরেজি। আর না বুঝলেও আরো দুই-তিনটি ভাষায় গান শুনি, উপভোগ করি। ঘুম থেকে উঠে মাথায় কোনো না কোনো গান গুন গুন করে। সেটা না শোনা পর্যন্ত গুন গুন থামে না। ধ্রুপদি গান অধিক ভালো লাগে। অর্থাৎ কথা নয় সুর। একসময় একটু শিখেছি বলে নয়। তবে কান একটু তো তৈরি হয়েছে বটেই। জীবনে প্রথম যে গানটি শিখি, গাই সেটা রেডিও থেকে শোনা একটি রবীন্দ্রসংগীত, ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি’। কণিকার গাওয়া। অনেক দিন শুনি না রবীন্দ্রসংগীত, কিন্তু ইদানীং হঠাৎ করে শুনতে শুরু করেছি-আমার সকল দুঃখের প্রদীপ...
দুই
আমার টিভি নাই, রেডিও নাই, আছে কম্পিউটার; তাতে শুনি। প্রিয় গানগুলো ফেরত আসে যন্ত্রের মাধ্যমে...কত হারিয়ে যাওয়া ভুলে যাওয়া মুখ, কণ্ঠ ফিরে আসে। কিন্তু প্রতিদিন নতুন শিল্পী আসে, পুরাতনরা একটু সরে যায়, অন্য কেউ পরিসরটা পায়। আবার সেও একদিন এই ভাবে হারাবে, মেলাবে। সবার ভাগ্য বাড়ে গোলাম আলী খানের মতো, না যে আজকের শ্রেয়া ঘোষাল বা জগজিৎ সিং তাকে মহাগুরু বলে সম্মান জানাবে। আমাদের দেশেও অনেক গায়ক, অনেক গান আজ আর কেউ শোনে না। কিন্তু তারা বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, গানগুলোও তেমনি, কিন্তু আজ তারা স্মৃতিতে মলিন, শ্রোতাহীন হয়ে পড়ে আছেন কোনায়। তাদের অনেক গান তো হারিয়েই গেছে, কেউ মনে রাখেনি, একটি অথবা দুইটাই। অবধারিত ...।
তিন
একসময় খুব জনপ্রিয় ছিলেন, আর কী ভালো লাগত আমার আনোয়ার উদ্দিন খানের গান। একটা গান তো রীতিমতো হিট ছিল, যেটা ফেরদৌসী বেগম, সাবিনা ইয়াসমিন এবং আরো অনেকে গেয়েছিল, ‘লোকে বলে প্রেম আর আমি বলি জ্বালা...’ মনে আছে একটু বয়স্কদের, শুনছেন তারুণ্য? কিন্তু খুব একটা কারো শোনা হয় না ওই গান বা তার অন্য গান। তাই লিংক তা দিলাম। https://www.youtube.com/watch?v=mbw98fiEId4I
কিন্তু লোকটা কে, উনি কী করতেন? পেশা কী? পরিবার কই? অনেক সন্ধান করেছি ডিজিটাল দুনিয়ায়, পাইনি কিছু। কেউ তো নিশ্চয় জানেন, কিন্তু তারা তো ফেসবুক ঘোরান না, তাই আমাদের জানা হয় না। এভাবেই হারিয়ে যাওয়া শুরু হয় এবং এক দিন আর কেউ তাদের খোঁজ রাখে না। এভাবেই তাদের বিস্মৃতি শুরু হয়।
কেউ কি জানেন তার জীবনবৃত্তান্ত? আমি যতদূর জানতাম তিনি শিল্প ব্যাংকে কাজ করতেন। আমাদের বাসায় এসেছিলেন কয়েকবার গানের সুবাদে। মা-বাবার সঙ্গে আলাপের পর শুনেছিলাম।
চার
কিন্তু গায়ক কেবল নয়, গানও হারিয়ে যায়-যেমন ঘটেছে আমার ক্ষেত্রে। আমার গানের ওস্তাদ ছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংগীত সাধক খান পরিবারের সদস্য। অর্থাৎ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানও আত্মীয়, সেই সুবাদে তারাও যারা বাংলাদেশে মাঝে মাঝে তাদের কথা বলতেন, সেই সূত্রে আমার জানা। আমাদের বয়সের ওনার অনেক সাগরেদ আছে। গান যেমন গাইতেন, তবলাও বাজাতেন। আলাউদ্দিন খান যখন ঢাকায় আসেন ষাটের দশকে, তখন আমার ওস্তাদজি তবলায় ছিলেন।
তিনি গান শুনে সাগরেদ হিসেবে আমাকে নেন ১৯৫৭ সালে। তারপর সারগাম শেখানোর আগে বলেন, কান পাকাতে হবে। এই পর্যায়ে আমি তিনটি গান শুনি, যা আজও প্রিয় হয়ে আছে।
প্রথমটি হচ্ছে, ‘গোধূলি লগনে কে এলে চুপি চুপি রাঙা পায়’, রাগপ্রধান বাংলা গান। দ্বিতীয়টি ছিল, ‘তুম জাগো মোহন প্রিয়া’। এটি ভজন গান, অনেকে গেয়েছেন, খুব পরিচিত। তৃতীয়টি, ‘আল্লাহ হু আল্লাহ, তুমি জাললে জালালু’, ভৈরবী সুরে।
পাঁচ
প্রথম গানটি আজও পাইনি, অনেক খুঁজেছি। গানের সুর ও ঢং থেকে মনে হয় নজরুল গীতি। কিন্তু ইউটিউবে বহু খুঁজেও কিছু পাইনি, জানি না পাব কি না, হয়তো না।
কিন্তু শেষ বা তৃতীয় গানটি কীভাবে পাই? একদিন সানাই বাদক মহা গুরু বিসমিল্লাহ খানের ওপর একটা ডকু ভিডিও দেখছিলাম। অনেকেই জানেন তিনি গানও গাইতেন। এই সময় কথা বলতে বলতে তিনি একটি গান গেয়ে শোনান, উনার একটি প্রিয় গান। আর এটি ছিল আমার সেই প্রিয় তৃতীয় গান, ‘আল্লাহু আল্লাহ’।
আমি তো বহু সার্চ করলাম ওনার নাম ও গান দিয়ে কিচ্ছু পেলাম না। বাংলাদেশে তো নেই, ইন্ডিয়ায়ও না। খুব খারাপ লাগছিল, কারণ ঐটুকু শুনে, শোনার ইচ্ছা আরো বেড়ে যায়। এমন সময় আমার ফিডে গানটা আপনা থেকেই ভেসে উঠল একদিন। গায়ক অজয় চক্রবর্তী, কৌশিকী চক্রবর্তীর বাবা। https://www.youtube.com/h?v=iP0fHqBNKzw&list=RDiP0fHqBNKzw&start_radio=1
আমার ‘বিশ্বাস হয় না’ মুডেই লিংক ক্লিক করলাম, আর তারপর এলো গানটি। তিনি প্রথম গানের পরিচিতি দিলেন, তারপর গান গাইলেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম বলাই বাহুল্য। আমি তো কেবল গান শুনছিলাম না, আমার শৈশবকাল শুনছিলাম-গানটি যার অংশ। আর ভাবছিলাম, চেষ্টা করলে কি না পাওয়া যায়। মানে অনেকটাই। দুটির মধ্যে একটি ৫০ শতাংশের কম নয়। এমনিতেও বহু সন্ধান তো বিফলে যায়, এটা বিরাট পাওয়া।
বহুবার শুনেছি, তারিফ করেছি মনে মনে। আমি একটু বেশি কারুকাজ করা কেলাওয়াতি ঢঙের ভার্সান শিখেছিলাম, অর্থাৎ গানের গায়কীর ঘরানা আলাদা ছিল। কিন্তু গান, সুর, রাগ এক। অতি, অতি সুন্দর।
ধন্যবাদ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, ধন্যবাদ আমার ওস্তাদজি। ধন্যবাদ গানের দুনিয়া আর ধন্যবাদ ইউটিউব।