
জাতীয় নির্বাচনে একক প্রার্থী ঠেকাতে ‘না’ ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু যেভাবে বিধানটি প্রয়োগের কথা বলা হচ্ছে, তাতে আখেরে কোনো লাভ হবে না; বরং ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে রকম বিধান ছিল, সেভাবে ফিরিয়ে আনা উচিত।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আরপিওর ৩১ ধারায় সংশোধনী এনে বিধান করা হয়েছিল, প্রতিটি ব্যালট পেপার বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (EVM) প্রার্থীদের নামের তালিকার শেষে একটি পৃথক ঘর থাকবে, যেখানে লেখা থাকবে ‘না ভোট’। অর্থাৎ ভোটার যদি তালিকাভুক্ত কোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে না চান, তাহলে তিনি এই ‘না ভোট’ ঘরে চিহ্ন দিতে পারবেন।
নির্বাচন কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, যে বছর ‘না’ ভোটের বিধানটি করা হয়, সে বছরই অর্থাৎ ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ‘না’ ভোট পড়েছিল তিন লাখ ৮১ হাজার ৯২৪ ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের ০.৫৫ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, ওই নির্বাচনে ৩৮টি দল অংশগ্রহণ করলেও মাত্র ছয়টি দল ‘না’ ভোটের শতাংশের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল।
কিন্তু নবম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে এই বিধানটি বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আদালত ‘না’ ভোটের বিধান বাতিল করলেও তা আবার চালু করতে নির্বাচন কমিশন সুপারিশ করবে। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও তখন না ভোট নিয়ে নানা রকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। সিইসির ওই মন্তব্যটি নিয়ে ২০১১ সালের ১৪ জুলাই আমার একটি ফেসবুক পোস্টের নিচে অনেকেই মন্তব্য করেন।
জাহিদ হাসান নামের একজন লিখেছিলেন : “আমরা ‘না’ ভোট চাই। ‘না’ ভোট জনগণের দাবি। দেশে প্রথম বারের মতো ‘না’ ভোটের বিধান থাকায় আমি ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘না’ ভোট দিয়ে আমার ভোটার অধিকার সংরক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ‘না’ ভোট দিতে পেরে গণতান্ত্রিক অধিকারের সুখও অনুভব করেছিলাম। দেশের আদালত কোন যুক্তিতে ‘না’ ভোটের বিধান বাতিল করছে বোধগম্য নয়। ভোট দেওয়া যদি গণতান্ত্রিক অধিকার হয়, তবে ভোট ‘না’ দেওয়ার অধিকারও গণতান্ত্রিক। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘না’ ভোট দেওয়ার ইচ্ছা জনগণের মধ্যে আরো প্রকট আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমি সন্দিহান, দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল ‘না’ ভোট বিধানের বিপক্ষে। কিন্তু তারা কোনোভাবেই জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। তাই সিইসিকে শক্ত হাতে আগামী নির্বাচনে ‘না’ ভোট রাখার বিধান বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নিতে হবে।”
আব্দুল হালিম মিয়া লিখেছিলেন : ‘টাকা খেয়ে দুর্নীতিবাজকে প্রার্থী করবে আর আমাকে গাঁটের পয়সা খরচ করে তাদের ভোট দিতে হবে, এটা হতে পারে না । না ভোট মানে জুতার বাড়ি। না ভোট চাই। ধন্যবাদ সিইসি।’
আওয়ামী লীগ সরকার কেন ‘না’ ভোট বাতিল করেছিল, তা সহজেই অনুমেয়। বস্তুত নির্বাচনমুখী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক যেকোনো বড় দলই না ভোটের বিপক্ষে। কারণ না ভোট তাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ এবং প্রার্থীদের জন্য হুমকি। কোনো একটি আসনে অনেক বেশি ‘না’ ভোট ওই আসনের সব প্রার্থীর জন্য অসম্মানের। তাতে প্রমাণ হবে যে ওই আসনের কোনো প্রার্থীই যোগ্য নন বা বিরাট অংশের মানুষ তাদের যোগ্য মনে করে না। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো ‘না’ ভোটের পক্ষে অবস্থান নিতে চায় না। তাদের আরেকটি ভয়, যদি কোনো আসনে অধিকাংশ ভোটই ‘না’ হয়, তাহলে ওই আসনের ভোট বাতিল হয়ে যাবে এবং পুনরায় নির্বাচন হবে, এ রকম বিধান ছিল। কিন্তু গত ১১ আগস্ট নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যদি কোথাও একজন প্রার্থী হন, যিনি বিনা ভোটে নির্বাচিত হবেন, এ ক্ষেত্রে ‘না’ ভোট থাকবে। যদি ‘না’ ভোট বেশি হয়, তাহলে ফের নির্বাচন হবে। পরের নির্বাচনেও যদি একক প্রার্থী থাকে, তবে আর ভোট হবে না। ওই প্রার্থীই নির্বাচিত হবেন।
তার মানে আগে যে রকম সব আসনেই ‘না’ ভোট ছিল, অর্থাৎ ব্যালট পেপারে উল্লিখিত কোনো প্রতীক বা প্রার্থী পছন্দ না হলে ভোটার যেমন না ভোট দিতে পারতেন, এবার সেই সুযোগ থাকবে না। বরং যেসব আসনে একজন প্রার্থী থাকবেন, তার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে এবার ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। কারণ বিএনপিসহ অন্য সব বিরোধী দল ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। মাঠে ছিল শুধু আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা। নিজেদের মধ্যে যাতে লড়াই না হয়, সে জন্য ১৫৩টি আসনে একক প্রার্থী ছিল, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর রাজনীতি ও নির্বাচনী ইতিহাসে একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। এ রকম ঘটনা প্রতিহত করতে এবার ‘না’ ভোটের বিধান চালু করা হচ্ছে, এটা মন্দের ভালো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যদি আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে ওই নির্বাচনে কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং ‘না’ ভোটের প্রয়োগ হবে না। কিন্তু এই বিধানটি যদি আগের মতো সব আসনেই রাখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে কত শতাংশ মানুষ কোনো দলের প্রতীক বা কোনো প্রার্থীকেই পছন্দ করছেন না।
এবার এই বিধানটি না রাখার পেছনে একটি কারণ হতে পারে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আগামী নির্বাচনের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির মূল অংশ হয়তো নির্বাচন করতে পারবে না বা তাদের নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। যদি তাই হয় এবং অতীতে অনুষ্ঠিত তুলনামূলক ভালো নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মিলে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট থাকে এবং ওই ৪০ শতাংশ ভোটারই যদি তাদের প্রতীক না থাকায় ‘না’ ভোট দেন, তাহলে এটি পুরো নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সারা বিশ্ব দেখবে যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীদের ওপর দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের আস্থা নেই।
এটা ভোটে অংশগ্রহণকারী দল তো বটেই, সরকারের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশন এবার শুধু একক প্রার্থী যেসব আসনে থাকবেন, সেখানেই ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করতে চায় কি না, এই প্রশ্ন জনমনে আছে। যদি তাই হয়, তাহলে এটি হবে ‘নিরর্থক না ভোট’। কেননা আগামী নির্বাচনে কোনো আসনেই হয়তো একক প্রার্থী থাকবেন না। আবার একক প্রার্থীর আসনে দ্বিতীয়বার ভোটেও যদি একক প্রার্থী থাকেন, তবে আর ভোট হবে না, এই বিধানটিও কার্যত একক প্রার্থীকেই সুবিধা দেবে। জনগণের মতামতের কোনো প্রতিফলন ঘটবে না। এটি কোনো যুক্তিতেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়। ২০ কোটি মানুষের দেশে কোনো একটি আসনে একজনের বেশি প্রার্থী থাকবেন না, এটি হতে পারে না। বরং যে বাস্তবতায় এতদিন অনেক আসনে একজন করে প্রার্থী ছিলেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন্য প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই বাস্তবতা বা নির্বাচনের নামে এমন রসিকতা ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন কী করছে, সেটিই বড় প্রশ্ন।
প্রসঙ্গত, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম, যেখানে ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ‘না’ ভোটের এই অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘একটি নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের অধিকার রয়েছে তার এলাকার কোনো প্রার্থী পছন্দ না হলে ‘না ভোটের’ মাধ্যমে সবাইকে প্রত্যাখ্যান করার।
পাকিস্তানেও না ভোট চালুর দাবি আছে। থাইল্যান্ডে এই বিধান আছে। ইউরোপের অনেক দেশেই না ভোট আছে। যেমন-সুইডেন, ইউক্রেন, স্পেন ও ফ্রান্স। রাশিয়ায়ও এই বিধান আছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় না ভোট আছে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহি ও চাপের মধ্যে রাখতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে শুধু একক প্রার্থী ঠেকানোই নয়, বরং সব আসনেই ‘না’ ভোট থাকা প্রয়োজন, যাতে তারা প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকে। যাতে তারা পয়সা খেয়ে যাকে-তাকে প্রার্থী না বানায়। যাতে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরই মনোনয়ন দেয়। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে রাজনীতি ও নির্বাচনী সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্যই ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোট থাকা প্রয়োজন।