Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

উপেক্ষিত দন্ত চিকিৎসা : সংকট কাটাতে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ

Icon

হাসান হামিদ

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:১৪

উপেক্ষিত দন্ত চিকিৎসা : সংকট কাটাতে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ

আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে দাঁতের ডাক্তার মানে ডেন্টাল সার্জন খুব একটা নেই। আর নেই বলেই বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না-এ কথা প্রবাদ পর্যন্ত হয়ে গেছে! একবার দাঁতের সমস্যা নিয়ে এক রোগী গেছে হাসপাতালে। কিন্তু একই সমস্যার রোগী কয়েক শ, ডেন্টাল সার্জন একজন। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে রোগী সার্জন সাহেবের সহকারীকে জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার সাহেবের সিরিয়াল কবে পাব?

উনি নির্লিপ্ত হয়ে বললেন, এক মাস পর।

রোগী চিন্তায় পড়ে বলল, এক মাস! ততদিনে দাঁত সব নাই হয়ে যাবে তো!

সহকারী জানাল, আহা, চিন্তা নেই মাড়িরও চিকিৎসা করেন আমাদের স্যার। 

আমাদের দেশ নানা খাতে এগিয়ে গেলেও ডেন্টাল সেবা এখনো অনেক পিছিয়ে। শহরাঞ্চলে কিছুটা উন্নত ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামাঞ্চলে ডেন্টাল সেবা কার্যত নেই বললেই চলে। উপজেলা পর্যায়ে ডেন্টাল সার্জনের সংখ্যা খুবই সীমিত, ফলে সাধারণ মানুষ প্রাথমিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়। অনেক সময় রোগীদের বিভাগীয় হাসপাতালে যেতে হয়। সেখানে চিকিৎসা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ফলে অজ্ঞতা ও দারিদ্র্যের কারণে গ্রামীণ জনগণ হাতুড়ে বা অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের কাছে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়। এতে দাঁতে ভয়াবহ জটিলতা দেখা দেয়। দাঁতের স্বাস্থ্য আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, আত্মবিশ্বাস ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ডেন্টাল সার্জনদের ইতিহাস দীর্ঘ হলেও বাংলাদেশে এই পেশা ভয়ানক চ্যালেঞ্জের মুখে এখনো। কিন্তু কেন?

বাংলাদেশে আধুনিক অর্থে দাঁতের চিকিৎসা এবং ডেন্টাল সার্জনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে। আগে গ্রামের মানুষ দাঁতের ব্যথা বা ক্ষয় সমস্যার জন্য স্থানীয় বা অশিক্ষিত দন্তচিকিৎসকের ওপর নির্ভর করতেন। তারা মূলত দাঁত তোলা বা সামান্য ব্যথা উপশমের কাজ করতেন। তবে তখনকার চিকিৎসা ছিল সীমিত এবং অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। ১৯৫০-৬০-এর দশকে পাকিস্তান সরকারের সময় ঢাকায় প্রথম ডেন্টাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হয়। এখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজন চিকিৎসক আধুনিক দন্তচিকিৎসার কার্যক্রম শুরু করেন। এই সময় থেকেই দেশে ডেন্টাল সার্জন পেশার ভিত্তি তৈরি হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাত আরো গতিশীল হতে শুরু করে। বিশেষ করে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ডেন্টাল ইউনিট খোলার মাধ্যমে পেশাটির বিস্তার ও মানোন্নয়ন ঘটে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট স্থাপন করা হয়। এই ইউনিটগুলো শুধু রোগী সেবা প্রদান করাই নয়, নতুন ডেন্টাল গ্র্যাজুয়েটদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরপর ১৯৯০-এর দশক থেকে বেসরকারি ডেন্টাল কলেজগুলো চালু হতে শুরু করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক মান অনুসারে শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দেশের ডেন্টাল সার্জনের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। তবে গ্রামীণ এবং উপ-উপজেলা পর্যায়ে এখন পর্যাপ্ত ডেন্টাল সার্জন নেই। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পদোন্নতির কারণে উপজেলা পর্যায়ে প্রায় ৮০টিরও বেশি ডেন্টাল সার্জনের পদ শূন্য হয়ে যাবে। যেহেতু ৩৯তম বিসিএসের পর বড় আকারে আর কোনো ডেন্টাল সার্জন নিয়োগ হয়নি, তাই চলমান ৪৮তম বিশেষ বিসিএস (স্বাস্থ্য) লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্য থেকে অধিকসংখ্যক প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি উপজেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত নতুন পদ সৃষ্টি, পদোন্নয়ন এবং ক্যাডার পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে এই সংকট দূর করা সম্ভব। নতুন বিসিএসের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত ডেন্টাল সার্জনদের নিয়োগ দ্রুত না হলে প্রাথমিক দাঁতের চিকিৎসা কার্যত অচল হয়ে পড়বে। ডেন্টাল সার্জনের ভূমিকা শুধু চিকিৎসা নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। বিভাগীয় হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে নতুন প্রজন্মের ডেন্টাল চিকিৎসককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া জনগণকে দাঁতের সঠিক যত্ন সম্পর্কে সচেতন করা, হাতুড়ে চিকিৎসকদের প্রভাবে পড়া রোগীকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা, সবই ডেন্টাল সার্জনের দায়িত্বের অংশ।

আমরা দেখেছি, সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে প্রভাষক পদে প্রায়ই এমবিবিএস ডাক্তারদের নিয়োগ দেওয়া হয়, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিসিএস নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও বৈষম্য লক্ষ করা যায়। ৩৯তম বিশেষ বিসিএস (স্বাস্থ্য) পরীক্ষার মাধ্যমে এমবিবিএস ও বিডিএস ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হলেও ৪২তম বিশেষ বিসিএসে কোনো বিডিএস ডাক্তার নিয়োগ করা হয়নি। এমনকি ৪০ থেকে ৪৬তম সাধারণ বিসিএসে বিপুলসংখ্যক এমবিবিএস ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হলেও বিডিএস ডাক্তারদের পদ সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। এই বৈষম্যের কারণে উপজেলা পর্যায়ে ডেন্টাল সার্জনের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নতুন সরকারি ডেন্টাল ইউনিটগুলোতেও প্রভাষক (ডেন্টাল) পদে শূন্যতা রয়ে গেছে, যা শিক্ষার গুণগত মানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতেও পর্যাপ্তসংখ্যক ডেন্টাল সার্জনের পদ নেই। একটি উপজেলায় কয়েক হাজার মানুষের দাঁতের চিকিৎসার প্রয়োজন থাকলেও সেখানে একজন ডেন্টাল সার্জনও নেই, এই চিত্র এখন বাস্তবতা। ফলে সাধারণ দাঁতের ব্যথা, মাড়ির সংক্রমণ বা মুখের ছোট ক্ষত নিয়ে আসা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাই দেওয়া সম্ভব হয় না; বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করতে হয়। আবার উপজেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালে রোগীদের ক্রমানুসারে চিকিৎসা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক ডেন্টাল সার্জন না থাকায় একজন ডাক্তার দিনে সীমিত সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারছেন। ফলে একজন রোগীকে দাঁতের সমস্যার চিকিৎসা পেতে দুই থেকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এই বিলম্বের কারণে প্রাথমিকভাবে সাধারণ দাঁতের ব্যথা বা মুখের ঘা নিয়ে আসা অনেক রোগীর অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করছে, সাধারণ সমস্যাগুলো পরিণত হচ্ছে এবসেস, সিস্ট, টিউমার কিংবা ক্যানসারের মতো জটিল রোগে, যেগুলো প্রাথমিক চিকিৎসায় সহজেই সেরে উঠতে পারত।

আরেকটি ভয়াবহ ব্যাপার, বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেন্টাল চেয়ারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকলেও সেখানে কোনো ডেন্টাল সার্জন নেই। ফলে অবকাঠামো থাকলেও সেবাহীন অবস্থায় পড়ে আছে পুরো বিভাগ। অবশ্য জনবল ঘাটতি বা কাঠামোগত দুর্বলতার দায় এককভাবে ডাক্তারদের নয়; মূল দায় নীতিনির্ধারকদের। স্বাস্থ্য খাতের বাজেটে দাঁতের স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দ বরাবরই নগণ্য। নীতি প্রণয়নে ডেন্টাল সেবাকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য অধিকার হিসেবে বিবেচনা না করায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রাথমিক সেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যখন উপজেলা হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত একজন ডেন্টাল সার্জন নিয়োগের দাবি বারবার তোলা হয়, তখন সেটি উপেক্ষিত থাকে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, যা মূলত দাঁতের প্রাথমিক যত্নের অভাবের সরাসরি ফল।

বিগত সরকারের শাসনামলে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে নতুন করে ডেন্টাল ইউনিট চালু হলেও সেই অনুপাতে ডেন্টাল সার্জন ও প্রভাষক (ডেন্টাল) নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি ডেন্টাল ইউনিটের ৫০ থেকে ৬০টি প্রভাষক (ডেন্টাল) পদে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক নিযুক্ত রয়েছেন, যা ডেন্টাল শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নের পথে বড় বাধা। এসব পদে বিডিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের নিয়োগই একমাত্র সমাধান। সরকারের উচিত উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত পদ সৃষ্টি, জনবল বৃদ্ধি এবং সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা, যাতে দেশব্যাপী সমানভাবে দাঁতের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।

দাঁতের চিকিৎসা শুধু সৌন্দর্য বা স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয় নয়, এটি একটি মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার। তাই সমাজ ও নীতিনির্ধারক উভয়ের দায়িত্ব, যাতে দেশে প্রতিটি মানুষ তার মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার অনুযায়ী দাঁতের সেবা পায়। ডেন্টাল সার্জনদের প্রতি প্রধান বৈষম্য হলো সরকারি চাকরির সীমিত সুযোগ, যা তাদের পেশাগত ও সামাজিক অবমূল্যায়নের কারণ হচ্ছে। দেশে ডেন্টাল সার্জনদের যথাযথ নিয়োগ, অবকাঠামো ও স্বীকৃতির অভাব এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে, যা জনগণের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ না নিলে এই সংকট আরো গভীর হবে, যার দায় আমাদের সবার ওপরই বর্তাবে।


লেখক : কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ (বাংলাদেশ), ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর হিউম্যান 
রাইটস, জার্মানি

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫