Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ওয়াদা এবং ভরসা

Icon

রাজেকুজ্জামান রতন

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩১

ওয়াদা এবং ভরসা

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তিনি ওয়াদা করিয়েছেন যেন কেউ নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব না করেন। কথাটা শুনতে ভালো লাগার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। নির্বাচন কমিশনার তো তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও ভবিষ্যৎ। এই দায় নিয়েই তো তারা কমিশনার হয়েছেন। ওয়াদা করাতে হবে কেন? তাহলে কার ওপর ভরসা করব? 

সাধারণ মানুষ কী করে সারা জীবন? আশায় বুক বাঁধে, ভরসায় অপেক্ষা করে আর আশা-ভরসা পূরণ না হলে ক্ষোভ ঝাড়ে। ব্যর্থ হলে নিজেকে দায়ী করে, কপালকে দোষারোপ করে, দোষ চাপানোর জন্য কাউকে খোঁজে আর শেষে হতাশ হয়ে বসে থাকে।

কিন্তু জীবন বড় গতিময়। নিত্যনতুন প্রয়োজন এসে হাজির হয়, হতাশ হয়ে বসে থাকার উপায় নেই। ফলে আবার নেমে পড়ে জীবনের ঘানি টানার কাজে। আর তাদের রাগ-ক্ষোভ, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সব যেন সরকারের বিপক্ষে উগরে দেয়। সরকারের চারপাশে যারা থাকে, আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো তাদের আকস্মিক সম্পদ বৃদ্ধির ঘটনায় অবাক হয়। মানতে পারে না এই বিপুল পরিবর্তন। তাদের বিত্তবৈভব দেখে, ক্ষমতা দেখে তুলনা করে কিছুদিন আগে কি ছিল তাদের অবস্থা, আর এখন কি হয়েছে?

এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো, হচ্ছে কি এসব? অভ্যুত্থান শুধু প্রতিবাদ প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত তৈরি করেনি একটা আশাবাদ তৈরি করেছিল। দেশটা এবার আমাদের হবে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকবে, মানুষ থাকবে স্বস্তিতে এবং বাঁচবে মর্যাদা নিয়ে। এই চাওয়া আন্দোলিত করছিল দেশের মানুষকে। কিন্তু মানুষের আশা যেন ধাক্কা খেয়েছে বাস্তবতার কাছে। বিশৃঙ্খলা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মাজার ভাঙ্গা, বাউলদের চুল কেটে দেওয়া, অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে বাড়িঘর ভাঙা যেমন চলছে, তেমনি গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও বন্ধ হয়নি। ফলে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার হাত থেকে মানুষের মুক্তি মেলেনি।

একটা দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পরিচালিত জরিপে প্রকাশিত হয়েছে সমাজের নানা আর্থিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক উদ্বেগের কারণে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা হারিয়েছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এত কথা আলোচনা হচ্ছে, ঘুষ নেওয়া নাকি আগের থেকে কমেছে, কিন্তু কাজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার মানুষ বলছেন, ৭৪ শতাংশ ক্ষেত্রে টাকা ছাড়া কিছু হয় না। একসময় এটাকে ঘুষ না বলে স্পিড মানি বলা হয়েছিল। এই মানির স্পিড এত বেশি ছিল যে টাকাগুলো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করতে গিয়েছিল। বিদেশের ব্যাংকে আমানত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এর কি পরিবর্তন হচ্ছে?

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ‘পরিবার পর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান’ শীর্ষক এক আলোচনায় সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। জরিপের পারিবারিক মনস্তত্ত্ব অংশের ফলাফল তুলে ধরে তারা বলেন, প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ আর্থিক সংকটের মধ্যে আছে। এদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় এবং ২৭ শতাংশ ঋণ পরিশোধ নিয়ে সংকটে আছেন। ঘুষের বিষয়ে বলা হয়, সরকারি কার্যালয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা কমেছে। কিন্তু তারা বলেছে হয়রানি চলছে। হয়রানির শিকার ৭৪ শতাংশ মানুষ বলছেন, টাকা না দিলে কিছুই হয় না। সরকারি সেবা নিতে হয়রানির শিকার হন ২১ শতাংশ মানুষ। স্বাস্থ্যসেবা নিতে হয়রানির হার প্রায় ৪৯ শতাংশ।

মানুষ কেন উদ্বিগ্ন? মানুষ কি শুধু রাজনৈতিক ঘটনায় উদ্বিগ্ন? মানুষের উদ্বেগের আরো কারণ তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। সন্তানের শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ৬৫ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া কিশোর অপরাধ ও মাদক নিয়ে উদ্বিগ্ন যথাক্রমে ৫৫ ও ৫৬ শতাংশ মানুষ। 

মানুষ কেমন জীবন চান? ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষার বিষয়ে মানুষ ৫৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক সম্মান নিয়ে বাঁচার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি চান তারা। রাজনৈতিক বিষয়ে ৫৬ শতাংশ মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধ করা উচিত বলেছেন। দুর্নীতি শুধু অর্থনীতিকে ধ্বংস করে তা-ই নয়, ধ্বংস করে মানুষের সাধারণ নৈতিকতার ভিত্তি।

জরিপ বলছে, সার্বিকভাবে নানা সংকট ও উদ্বেগের কারণে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নন। কী হবে দেশটার, এই হাহাকার শুনতে পাওয়া যায় চারপাশেই। জরিপের ফল দেখে এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, এত রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পরও ৪৬ শতাংশ মানুষ কেন সরকার ও সমাজের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। প্রতিদিন পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয় তাতে এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সমাজে প্রতিনিয়ত সংঘাতমূলক মনোভাব ছড়াচ্ছে। একদিকে দেশে কর্মসংস্থান নেই, অন্যদিকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগও কমছে, ফলে আতঙ্ক কর্মপ্রত্যাশীদের মধ্যে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি বলে যে প্রবণতা বিশ্বব্যাপী, বাংলাদেশ তার উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যুক্তি ও সহনশীলতার জায়গা দখল করেছে উগ্রতা। বাংলাদেশে উগ্রতা বাড়লে তার প্রভাব কী হতে পারে, দেশে ও বিদেশে-এ নিয়ে ভাবনা কী আছে? দেশের দেড় কোটি মানুষ দেশের বাইরে থাকেন, যাদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি, তারা যেসব দেশে কাজ করেন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সেসব দেশেও প্রভাব ফেলে কি না, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি করে কিনা, উগ্রতার সময় এই ভাবনা কাজ করে না। কিন্তু ফল ভোগ করতে হয় দেশের সব মানুষকে। 

একটা দেশের মানুষের বড় অংশ আশাবাদী নয়, এটা উদ্বেগজনক। কেন এত দ্রুত মানুষের একটি বড় অংশ আশা হারিয়ে ফেলল, সেটা গভীরভাবে চিন্তা করে ভূমিকা পালন না করলে সমাজে অস্থিরতা বাড়বে।

মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর আয় বাড়ানোর পথ তৈরি হচ্ছে না। ঘুষ বা অনৈতিক পথে আয় করতে পারে দেশের কত শতাংশ মানুষ আর তাদের আয় বাড়ানোর বোঝা বহন করতে হয় কত মানুষকে? দুর্নীতি করতে পারে না সবাই, কিন্তু দুর্নীতির সংস্কৃতি আচ্ছন্ন করে প্রায় সব মানুষকেই। সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এই যুক্তি যে সবাই দুর্নীতিবাজ। কেউ ৫০ টাকার দুর্নীতি করে, কেউ করে ৫০ কোটি টাকার। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দুর্নীতি করে না, দুর্নীতির শিকার হয়, কিন্তু তারাই আবার দুর্নীতিকে স্বীকৃতি দেয়, সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। দুর্নীতি করাকে যোগ্যতা বলে তারিফ করে আবার বলতে থাকে, কাকে বিশ্বাস করব ভাই? দুর্নীতির যে রাজনীতি আছে তা অনেকে মনে করে না। কিন্তু ভাবতে না চাইলেও এর হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। 

যাদের ওপর দেশের ভার, তারা কি শুধু নিজেদেরটাই দেখবেন? নিজের আত্মীয়, নিজের অঞ্চল, নিজের দলের স্বার্থে দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা বরাদ্দ করবে? সৎ মানুষও যদি স্বজনপ্রীতি করে তাহলে তা কি দুর্নীতি নয়? দুর্নীতিবাজ হলেও তিনি আমার এলাকার লোক, পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে আমাদের এলাকায় বরাদ্দ বেশি করেছেন, অতএব তিনি আমাদের প্রিয়। এই মানসিকতা সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করবে না। ভোটের সময় নগদ টাকা, শাড়ি, লুঙ্গি দিয়ে দরিদ্র মানুষের ভোট নেওয়া সবাই দেখে, কিন্তু এতে মানুষের নৈতিক অধঃপতন কতটা ঘটে তা বিচার করতে চায় না অনেকেই। কে কত বেশি দুর্নীতি করতে পারে, তা দিয়ে সক্ষমতার বিচার, আর কে কম দুর্নীতি করে তা দিয়ে সততার বিচার করলে মানুষ ভরসা পাবে কীভাবে?

ভরসার ভিত্তি ব্যক্তিতে নয়, ব্যবস্থায়। শোষণ-লুণ্ঠন চলবে, ক্ষমতার দাপটে কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করবে না, সত্যতা যাচাই না করে মানুষের জীবন, সম্মান কেড়ে নেওয়া যাবেÑএ রকম পরিস্থিতি বজায় রেখে কোনো ব্যক্তির ওপর ভরসা করে কি সমাজে শান্তি ও স্বস্তি আনা যাবে? ফলে শুধু ভরসা করা নয়, ভরসার ভিত্তি নির্মাণ করতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫