Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

পরবর্তী প্রজন্ম নদীর ফিরে আসা দেখতে পাবে

Icon

ম. ইনামুল হক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:২৮

পরবর্তী প্রজন্ম নদীর ফিরে আসা দেখতে পাবে

নদী নিয়ে একটি কাজই শুধু করতে হবে, আর কিছুই করার দরকার নেই। সেটি হলো নদীকে রক্ষা করা। দখল ও দূষণের হাত থেকে নদীকে বাঁচাতে হবে। ক্রমাগত দখলের মুখে নদীগুলোর গতিপথ ক্ষীণ হয়ে আসছে, যা দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। নদী রক্ষা বলতে আমি বুঝি, নদীকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দেওয়া। যেমন-শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি কমবে আর বর্ষা মৌসুমে পানিতে ভরে যাবে এবং ধীরে ধীরে সমুদ্রে চলে যাবে-এই যাত্রা পথটুকুর মাঝে কোনো বাধা থাকবে না।

নদীদূষণের প্রধান কারণ শিল্পবর্জ্য, এর পরই রয়েছে শহুরে বাড়ির পয়ঃবর্জ্য। ঢাকার পুরোনো বাড়িগুলোর নিচে সেপটিক ট্যাংক রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে বাড়িগুলো হচ্ছে বা হয়েছে সেগুলোতে সেপটিক ট্যাংক নেই। শিল্প-কারখানাতেও সেপটিক ট্যাংক রাখা হচ্ছে না। প্রতিটি বাড়ি ও কারখানায় সেপটিক ট্যাংক তৈরি করা দরকার এবং তা ভবন নির্মাণের পরও বেসমেন্টে করা সম্ভব। শিল্প-কারখানার নিচের বেসমেন্টে সেপটিক ট্যাংক তৈরি করা সম্ভব না হলে ভবনের দুই পাশ দিয়ে লম্বালম্বিভাবে সেপটিক ট্যাংক তৈরি করতে হবে। কারখানা বা বাড়ির সব তরল বর্জ্য সেপটিক ট্যাংকের মাধ্যমে গেলে অনেক দূষণ বায়ুবদ্ধ প্রকোষ্ঠে থিতিয়ে যাবে, 

ফলে সেখান থেকে বের হওয়া তরল বর্জ্য সুয়ারেজ লাইন হয়ে নদীতে গেলে তেমন দূষণ হবে না। বর্জ্য যে সময়টুকু বায়ুবদ্ধ সেপটিক ট্যাংকে থাকে, তাতে এটার দূষণ অনেক কমে যায়। বাকি দূষণটা নদী সয়ে নিতে পারে। বর্জ্য সরাসরি নদীতে গেলেই সমস্যা। 

নদী ভরাট দুই রকমের হয়ে থাকে। একটা হলো আবর্জনা ফেলে নদী ভরাট করা, আরেকটি হলো নদীর তলদেশের মাটি তুলে তীরে ফেলে ঢাল উঁচু করে দোকানপাট ও বাড়িঘর নির্মাণ করা। এগুলো খাসজমি। এসব জমি দখল করা বেআইনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। জেলা প্রশাসন থেকে লিজ নিয়ে অনেকেই দেদার স্থাপনা নির্মাণ করছে। ফলে নদীর গতিপথ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এই লিজ দেওয়া বেআাইনি। তবে এ কথাও সত্যি, নদী দখলের বেশির ভাগ হয়ে থাকে রাজনৈতিক প্রভাবে। 

নদীর পাশাপাশি আমাদের জলাভূমিও রক্ষা করতে হবে। জলাভূমি নদীরই একটি অংশ। বিশেষ করে ভাসান পানির জলাভূমি। ভাসান পানির জলাশয় বলতে বোঝায়, যে জলাশয়গুলোর পানি প্রবাহমান, এক দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে অন্যদিকে যায়। এগুলো নদীর সঙ্গে যুক্ত থাকে। হাওর অঞ্চলে প্রচুর ভাসান পানির জলাশয় রয়েছে। এই ভাসান পানিই হলো মুক্ত জলাশয়। এই জলাশয়গুলো লিজ দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু অসাধুচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে জেলা প্রশাসক এই মুক্ত জলাশয়গুলোকে বদ্ধ জলাশয় হিসেবে দেখিয়ে লিজ দিয়ে দেয়। এটাও বেআইনি। ভাসান পানি লিজ দেওয়ার ফলে আরো যে সমস্যা দেখা দেয় তাহলো হলো, বর্ষা মৌসুমে ভাসান পানির তোড়ে আশপাশের মানুষের জমি যখন তলিয়ে যায়, তখন লিজ নেওয়া ওই ব্যক্তি আশপাশের মানুষের জমির মাছগুলোকেও তার জলাশয়ের মাছ বলে দাবি করে। এটা তো অন্যায়, তারা এটা করতে পারে না। নদী জলাশয়ের মাছগুলো কারো একক নয়, সবার সম্পদ। আমাদের এসব রক্ষা করতে হবে, প্রকৃতিকে তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। 

দেশের ভেতরে যে নদী এবং খালের উৎসমুখ রয়েছে, সেগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে যে নদীগুলোর উৎস দেশের বাইরে, সেগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতার সাহায্য নিতে হবে। উজানে যে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সে বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নদীর স্বাভাবিক এবং ন্যূনতম যে প্রবাহ সেটি যেন নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে উভয় দেশকেই নজর দিতে হবে। ন্যূনতম প্রবাহ বলতে নদীগুলোর শুষ্ক মৌসুমে ঐতিহাসিক প্রবাহ। সেই প্রবাহ কমে যেন নদী শুকিয়ে না যায়, তা যতটা সম্ভব নিশ্চিত করতে হবে। পানি কমে গেলে নদীতে যে জলজ প্রাণীগুলো রয়েছে তাদের বাঁচা কষ্টকর হয়ে যায়। শুধু জলজ প্রাণীই নয়, আশপাশের মানুষও নদীর ওপর নির্ভরশীল। চাষাবাদ, যাতায়াত, গৃহস্থালির কাজ ইত্যাদি মিলিয়ে আবহমানকাল থেকে মানুষ নদীর ওপরই নির্ভরশীল। সেটি বিঘ্নিত হয়। এটা প্রকৃতির ওপর একটা আঘাত। 

তিস্তা নদীতে গজলডোবা ও গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা ব্যারাজের ফলে নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারাচ্ছে। আমাদের এসব বিষয়ে কথা বলা উচিত। তার চেয়েও বড় কাজ, এ বিষয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া। যৌক্তিক পথে এগিয়ে যাওয়া। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। পানি নিয়ে যেসব দ্বন্দ্ব রয়েছে সে বিষয়গুলো মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। সমস্যা হলো আমাদের দেশে পানি ও নদীর দায়িত্বে যেসব সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন, তারা এই আইনগুলো বোঝেন না। সেসব কর্মকর্তার মাথায় থাকে, ‘যতদিন দায়িত্বে আছি নিজের আখের গুছিয়ে নিই’। নদী নিয়ে ভাববার কোনো আগ্রহ তাদের নেই। এর ফলে বছরের পর বছর অমীমাংসিতই রয়ে গেছে আমাদের নদী ও পানির সমস্যা। সরকারি কর্মকর্তারা মূলত জনসেবক। আমিও জনসেবক হিসেবেই কর্মরত ছিলাম। আমার দায়িত্বকালে আমি প্রায়ই বলতাম, ‘আমরা জনসেবক, প্রশাসক নই।’ কর্মকর্তাদের রুমের বাইরে নেমপ্লেটে লেখা থাকে প্রশাসক। ফলে তারা আর জনসেবক হয়ে উঠতে পারেন না। আর এই তথাকথিত প্রশাসকরা ওপরের ফোনকল ছাড়া নড়েচড়ে না। এমন হলে আমরা কিভাবে আশা করব, তারা নদী রক্ষা করবেন?

বছরে ৩৬৫ দিন। হিসাব করে দেখলে প্রতিদিন কোনো না কোনো দিবস পালিত হয়। বিশ্ব নদী দিবসও ঠিক তেমন, শুধুই কাগজে-কলমে পালিত হয়। ফান্ড বরাদ্দ হলে সরকারি কর্মকর্তারা লোকদেখানো কিছু কর্মসূচি পালন করেন, কখনো কখনো নদী ভ্রমণ করেন। বিষয়টি অনেকটা পিকনিকের মতো। ঘোরাঘুরিও হলো, খাওয়াদাওয়াও হলো আবার নদীরক্ষা করতে নিজেদের নাম প্রচার করাও হলো। দখল মুক্ত করা, দূষণের হাত থেকে নদী রক্ষা করা নিয়ে কোনো কথা নেই, কাজ নেই। এভাবেই যাচ্ছে। 

তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। কিন্তু তারা কি এর প্রকৃত কারণটি খুঁজে দেখেছেন? তিস্তার মূল সমস্যাটা পশ্চিমবঙ্গে নয়। এটা সিকিমে রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি ড্যাম তৈরি হয়েছে তিস্তার পানি ধরে রাখতে। ড্যাম যদি ঠিকঠাক পরিচালনা করা যায়, তবে সেটি সমস্যা হয়ে ওঠে না। সমস্যা হয় তখন, যখন বর্ষায় সম্পূর্ণ পানি ছেড়ে দেওয়া হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে সব পানি ধরে রাখা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক আইনে বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। বর্ষায় পানি যতটা সম্ভব ধরে রাখতে হবে আর শুষ্ক মৌসুমে ঐতিহাসিক প্রবাহ ছাড়তে হবে। এখন সিকিমে যারা ড্যাম করল, তারা তো আইন মানছে না। এটার একটা সমাধান আছে। তিস্তা সিকিম থেকে বয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় গিয়ে আমাদের সিকিমে যেতে হবে, যেখানে ড্যামগুলো করা হয়েছে। ওদের কাগজপত্রগুলো পড়ে দেখতে হবে এবং মিলিয়ে দেখতে হবে তারা ড্যামের পানি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ছাড়ছে কি না। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারা তা করছে না। 

পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মিলে যদি বাংলাদেশ কাজটি করতে পারে তাহলে এই সমস্যার একেবারেই সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশের পানি স্বার্থরক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা সমাধানে উভয়েরই একে অপরকে প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশকে একটি সমঝোতায় আসতে হবে। চুক্তি হবে এ রকম-‘ফারাক্কা ও গজলডোবা ব্যারাজে উজান থেকে যে পানি আসবে তার ‘৭০ শতাংশ পানি বাংলাদেশ পাবে আর ৩০ শতাংশ পাবে পশ্চিমবঙ্গ’। তাদের ৩০ শতাংশের বেশি পানির প্রয়োজন পড়ে না। আমরা ভাটির দেশ অববাহিকার এলাকা বড়, তাই  আমাদের বেশি দিতে হবে। এই চুক্তির পর যখন দেখা যাবে উজান থেকে পানি কম আসছে, তখন উভয়ে মিলে উজানের দিকে গিয়ে দেখতে হবে পানি কোথায় আটকাচ্ছে এবং কিভাবে আটকাচ্ছে। সমস্যাটা তখন দুজনেরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর সমাধান দুজনকেই করতে হবে। এ ছাড়া তিস্তা নদী বাঁচানো এবং ন্যায্য পানি আদায় সম্ভব নয়। এ ধরনের সমঝোতা গঙ্গার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

যাই হোক, পরিশেষে একটা কথা বলি। আমি প্রকৃতিবাদী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি প্রকৃতি একটা আঘাত হানবে। অর্থাৎ প্রতিশোধ নেবে। এর মাধ্যমেই সে তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবে। নদীগুলোকে প্রকৃতিই মুক্ত করবে। প্রাণ ফেরাবে। দিনটি খুব বেশি দূরে নয়। ৫০ বছরের মধ্যেই নদী আবারও পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে। আমরা হয়তো দেখতে পাব না, তবে পরবর্তী প্রজন্ম নদীর ফিরে আসা দেখতে পাবে।


অনুলিখন : বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫