Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

রিকশাকে টেক্কা দিল টেসলা : কেন, কীভাবে

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৭

রিকশাকে টেক্কা দিল টেসলা : কেন, কীভাবে

বাংলাদেশের না হোক ঢাকার অবস্থার সূচক বুঝতে রিকশা থেকে টেসলার টেক ওভারটা দেখতে পারেন। খুব সাধারণ একটি বিষয়। যদিও পণ্ডিত বা মিডিয়ার লোকেরা একে পাত্তা দেন না, কিন্তু একবার ভাবুন, জন্ম থেকে কমবেশি যত ধরনের রিকশা চলাচল করেছে ঢাকায়, তা মাত্র মাস ছয়ের মধ্যে চাপা পড়ে গেছে নয়া বাহন টেসলার নিচে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দেশি-বিদেশি পণ্ডিতরা ভাবেন না। কিন্তু এক বছরেই আমাদের রাস্তা আর ফুটপাতকেন্দ্রিক যে অর্থনীতি তাতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে এই দুনিয়া এখন আর সে দুনিয়া নাই। 

দুই

বড় পরিবর্তনটা হয় গত সরকার পতনের পর। যারা পলিটিক্যাল চাঁদাবাজ তারা সরে পড়ে। ফলে রিকশার দৈনিক জমা কমে যায়। এতে অনেক নতুন রিকশা মার্কেটে আসে, কিন্তু দেখা যায় যাত্রী বাড়েনি, ফলে ইনকাম কমে যায়। কিন্তু প্রথম ছয় মাস অস্থিরতা ছিল, চলাচল কমে আর বাজারে ইনফরমাল লগ্নি পুঁজিও কমে। এরই মধ্যে পাড়াগুলোতে নয়া চাঁদাবাজ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। কিন্তু তত দিনে রিকশার সংখ্যা কোনো কোনো এলাকায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে আগের মতো রুজি আর থাকেনি তাতে। এমন সময় টেসলার দাপট হঠাৎ করে বেড়ে যায় রাস্তায়, সংখ্যায়। কেন?

তিন

রিকশার দুনিয়া হচ্ছে ইনফরমাল অর্থনীতির জগৎ, সরকারি অর্থনৈতিক জগৎ নয়। সেখানকার নিয়মনীতিও আলাদা। সরকারি দুনিয়ার লিখিত নিয়ম আছে, খবরদারি আর ঘুষ আছে, সেমিনার, রাউন্ড টেবিল আছে। কিন্তু ইনফরমাল অর্থনীতি চলে শুধু চাহিদা আর পূরণের ওপর, ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই। এমনিতে ব্যবসার বাজার গত এক বছরে যেকোনো কারণে অতটা চাঙা নেই, বিনিয়োগের সুযোগ ও আমদানি কম। নয়া চাঁদাবাজরা লোককে হুমকি-ধমকি দিয়ে বেশি রুজি করছে, ব্যবসার ভাগ থেকে কম। ফলে ইনফরমাল অর্থনীতির খুদে পুঁজিবাদীরা বিনিয়োগের পরিসর খুঁজছিলেন। 

যেহেতু দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ রোজগার করে এই ইনফরমাল খাত থেকে, তাই তাদের অদৃশ্য জাল ও উপস্থিতি বিরাট। আর তারা এত বিরাট যে তাদের চাইলেও কেউ থামাতে পারে না। যখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যেকোনো সরকারেরই ক্ষমতা নেই এই ইনফরমাল বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করার, আইন দিয়ে রিকশা নামানো-ওঠানোর, তখনই রিকশার বাজারে এই নীরব টেসলা বিপ্লব হয়ে গেল। জন্মের পর প্রথমবার মানুষের টানা রিকশা কমে গেল ব্যাপকহারে, আর তার বদলে এলো টেসলা বা মোটর রিকশা।

চার

আগে সবাই একে বলত মোটর রিকশা এবং খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না, কারণ গতি নিয়ন্ত্রণ সহজ ছিল না। সবাই টানা রিকশাই পছন্দ করত। হয়তো ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছিল এই মোটর রিকশা। কিন্তু আজ পরিস্থিতি প্রায় উল্টো, বড়জোর ২৫ শতাংশ রিকশা টানা, বাকি সবই মোটর রিকশা। আর এখন এটা সবার কাছে পরিচিত টেসলা বলে।

রিকশা মার্কেটে কয়েকটি নতুন ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে একটা হচ্ছে এখানে বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিত হয়েছে, এই সরকারের নিজস্ব চাঁদাবাজ নাই, কিন্তু ইনফরমাল মার্কেটের কাছে অসহায়। তাই এখানে পুঁজি নিয়োগ করলে বিপদ নেই। 

তা ছাড়া সরকার রিকশা নিয়ে কম ভাবে, তারা আছে ব্যাংক নিয়ে, ফর্মাল সেক্টরের বিষয়, তাই শহরের এই আর্থিক জগতের বাসিন্দারা কিছুটা আশ্বস্ত এবং সে কারণেই টেসলা নেমেছে নতুন বিনিয়োগের হাত ধরে।

অন্য আর একটা কারণ হচ্ছে টানা রিকশা ২০ থেকে ২৫ হাজারেই নামানো যায় আর সেটা করার ক্ষমতা অনেকের আছে আজকের বাংলাদেশ। কিন্তু টেসলা বানাতে লাগে কম করে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার। তাই সীমিত ইনভেস্ট ও কম্পিটিশান কম। ফলে টেসলায় সয়লাব হবে না। রিকশার বাজারও সেই দিক থেকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বিনিয়োগ, কম্পিটিশানও কম।

পাঁচ

অনেক ব্যবসা কমে গেছে, যেমন জমি, আবাসন কেনা-বেচায়। তবে আরো ছোট পুঁজির ব্যবসা নতুন করে চালু হয়েছে। এই ব্যবসার পুঁজির সূত্র ব্যাংক নয়, অর্থাৎ রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান নয়, সমাজ বা গৃহ সঞ্চয়। এই পুঁজি ঘোরে হাতে হাতে, হিসাব হয় মুখে মুখে আর জমা হয় পকেটে, আলমারিতে। এটির ওপর সরকারি খবরদারি সীমিত বা নেই। তবে দেখা হয় একে অন্যের সঙ্গে মাঝে মাঝে। যেমন-ফ্ল্যাট কিনতে গেলে টাকার উৎস দেখতে হয়। তাই অনেকেই এই সরকারি ফরমানের দুনিয়ার বাইরে থাকেন। রাষ্ট্রের কাঠামো চালু থাকার একটি বড় বিষয় ‘উৎকোচ’। কিন্তু সেটার খবর পাওয়া যায় না রেজিস্ট্রেশন না করলে। মাঝে মাঝে তারা অবশ্য যায় আর দাবি করে। পায়, কিন্তু নিয়মিত বা বড় অঙ্কের নয়। আর রিকশা ব্যবসা এত ছোট আর বিস্তৃত যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় সরকারের, পোষায় না। 

ছয়

কিন্তু পুঁজির বা অর্থনীতির চরিত্র যে কিছুটা পাল্টেছে সেটাও মনে হয়। কারণ একেবারে ক্ষুদ্র পুঁজি মানে টানা রিকশার মালিক শ্রেণি উঠে গেছে, সঙ্গে গেছে অনেক পুরাতন রিকশাওয়ালারা। ২০২৪-এর জুলাইয়ের পর কিছু নতুন রিকশাওয়ালা নেমেছিল, বেশির ভাগ অন্য পেশা থেকে, যেটা দুর্বল হয়ে গেছে। তবে এরা ছিল একেবারে নিম্নবর্গীয়। কিন্তু রিকশা টেনে ৯-১০ হাজার টাকা কামানোর সুযোগ আছে। কিন্তু তারা আহত হয়, কারণ এত রিকশা নামে যে গোটা রিকশা বাজার ধাক্কা খায়। ফলে পেশা পাল্টে লাভ হয়নি তাদের। কিন্তু এদের পেছনে ফেলে এক নয়া শ্রেণির রিকশা মালিক ও শ্রমিকের প্রবেশ ঘটে।

সাত

কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও একটি এনজিওর ছোটখাটো জরিপ থেকে যেটুকু জানা যাচ্ছে তাতে দেখা যায়, এই নয়া রিকশা গাড়ি টেসলারের অনেক ড্রাইভার মাঝারি শিক্ষিত, দু-একজন কলেজে পড়া ছিল, পরে ছেড়ে দিয়েছে। এদের কেউ কেউ ছিল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করা, সেগুলো বন্ধ হয়েছে নানা কারণে। রাজনৈতিক নেতার অফিসের লোকও আছে নাকি দু-একজন। টেসলার মালিকরা এদের পছন্দ করেন, কিন্তু এখনো অর্ধশিক্ষিত নিম্নবিত্ত শ্রমিক প্রধান। তবে টেসলার ইনকাম ভালো, গরিবানা কমেছে একটু এদের, ঝামেলা কম, পরিশ্রম কম যদিও রোদ-বৃষ্টিতে ঘোরা আছে। তবে কিছু কিশোরও টেসলা চালাচ্ছে, কারণ দেহের শ্রম লাগে না এই রিকশা টানতে। 

আট

একদিকে এটা যেমন কিছু মানুষকে অতি দরিদ্র জীবন থেকে রক্ষা করেছে, নিচের শ্রেণিতে নেমে এই কাজ করে, বেশ কিছু টানা রিকশাচালক বেকার হয়েছে টেসলার জন্য। একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে ও হচ্ছে পুরানা ও নতুন রিকশার চালকদের মধ্যে। পরিস্থিতি কিছুটা অস্থির, তবে এই গোটা সেক্টরের কেউ সরকারের দিকে তাকিয়ে নেই। নিজের কপাল নিজেই গড়ব না হলে নিজেই পুড়বে-এমন একটা ভাব। নগরে দারিদ্র্য বাড়ছে। তবে করোনার অভিজ্ঞতা যা বলে-সরকার থাকে নিজেকে নিয়েই, নাগরিক নিজের পথ নিজে খুঁজে নেয়। এবার দেখা যাক কি হয়, কারণ টেসলা এখন বাস্তবতা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫