Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

অকৃত্রিম কৃষক নেতা মওলানা ভাসানী

Icon

ড. মাহবুবব উল্লাহ্‌

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৫২

অকৃত্রিম কৃষক নেতা মওলানা ভাসানী

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন চিরবিদ্রোহী। তিনি জানতেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সংগত। তার এই বিদ্রোহী মনোভাব কৈশোরেই প্রকাশ পেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা দরকার। একবার মওলানা ভাসানীর চাচা বাড়িতে জেয়াফতের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে সমাজের গণ্যমান্যদের বিশেষ আসনে বসানোর আয়োজন করা হয়। কিন্তু যারা দরিদ্র সাধারণ মানুষ, তাদের মাটিতে বসিয়ে কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করা হয়। সহজাত সাম্যের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ভাসানী এই বৈষম্যের প্রতিবাদ করলেন।

এতে তার চাচা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে চপেটাঘাত করেছিলেন। এর পরও মওলানা ভাসানী সেদিন দমে যাননি। সেদিনের সেই অদম্য মওলানা ভাসানী সারাজীবন অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। মওলানা ভাসানী প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ খুব একটা পাননি, মাদ্রাসায় দুয়াম পর্যন্ত পড়েছিলেন। এরপর তিনি আসামের জলেশ্বরে সৈয়দ নাসির উদ্দিন আহমদ বোগদাদী (রহ.)-এর সংস্পর্শে আসেন।সৈয়দ নাসির উদ্দিন আহমদ বোগদাদী (রহ.) ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ। তার কাছে মওলানা ভাসানী আধ্যাত্মিকতাবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেন। 

নাসির উদ্দিন বোগদাদী তাকে দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। মওলানা ভাসানী দেওবন্দে ধর্মীয় ও জাগতিক বিষয়ে দুই বছর শিক্ষা লাভ করেন। এটি একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হলেও শিক্ষার্থীদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হতো। দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকেই মওলানা ভাসানী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়ার দীক্ষা নিয়েছিলেন।

তিনি মওলানা আজাদ সুবহানির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে সামগ্রিকভাবে মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। তিনি বাংলা, উর্দু, ফার্সি ও আরবি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। ইংরেজি ভাষাটাও ভালো বুঝতেন।তিনি যে ইংরেজি ভাষা ভালো বুঝতেন, সে দক্ষতা লক্ষ করেছি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ইংরেজি শিক্ষিত ডাকসাইটে নেতারা যখন ইংরেজিতে খসড়া করা সংবাদ সম্মেলনের বিবৃতি নিয়ে তার কাছে আসতেন। তারা সেই বিবৃতি মওলানা ভাসানীকে পড়ে শোনাতেন, তিনি তখন দু-একটি শব্দ পরিবর্তনের পরামর্শ দিতেন। দেখা গেছে, তার পরামর্শ মতো বিবৃতিটি চূড়ান্ত করা হলে বিবৃতির ব্যঞ্জনা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠত।

মওলানা ভাসানী জীবনে অনেক রাজনৈতিক দল করেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু যখন উপলব্ধি করলেন সন্ত্রাসবাদ সঠিক পথ নয়, তখন তিনি এর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করলেন। এরপর খেলাফত আন্দোলন, কংগ্রেস ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টিতেও কাজ করেছেন। মওলানা ভাসানী দেশবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতেন। কারণ দেশবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও অত্যন্ত উদার নেতা। দেশবন্ধুর সাহচর্য তার রাজনৈতিক মতাদর্শ পুনর্গঠনে বিশালভাবে সহায়তা করে।

মওলানা ভাসানী ছিলেন আজীবন কৃষক সংগ্রামী। তিনি ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলায় বেশ কিছু কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এসব সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কৃষকদের শ্রেণিচেতনা ধারালো হয়ে ওঠে। তার জমিদারবিরোধী আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের পছন্দনীয় ছিল না। ব্রিটিশ সরকার তাকে পূর্ববঙ্গ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর আসামে ঘাঁটি গাড়লেন। তিনি আসাম মুসলিম লীগের সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। মওলানা ভাসানীর আসাম জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। তিনি আসামে পূর্ববঙ্গ থেকে হিজরত করা ভূমিহীন মানুষের একমাত্র ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছিলেন।

পূর্ববঙ্গের ভূমিহীন কৃষকরা আসামে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। এসব সহায়-সম্বলহীন কৃষক আসামের বন-জঙ্গল সাফ করে, বন্য হিংস্র পশুদের সঙ্গে লড়াই করে আসামকে শস্য-শ্যামল করে গড়ে তুলেছিলেন। এতে আসামের সম্পদ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আসামের কিছু সংকীর্ণমনা রাজনীতিক বাঙালি কৃষকদের বসতি স্থাপন সহ্য করতে পারেননি। তারা ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। স্যার সাদুল্লাহ যখন আসামের প্রধানমন্ত্রী তখন আসামে ভৌগোলিকভাবে  লাইন টেনে বলা হয়েছিল, বাঙালি কৃষকরা এই লাইন অতিক্রম করে বসতি স্থাপন করতে পারবেন না।

মওলানা ভাসানী এ ঘটনার তীব্র বিরোধিতা করেন। আসামের ভাসান চরে কৃষকদের নিয়ে সম্মেলন করে তিনি প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনই ‘লাইন প্রথা বিরোধী’ হিসেবে পরিচিতি পায়। লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনের কারণে স্যার সাদুল্লাহর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর তীব্র মতবিরোধ হয়। অথচ স্যার সাদুল্লাহও ছিলেন আসাম থেকে নির্বাচিত মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী! যখন পাকিস্তান সৃষ্টি হচ্ছিল তখন প্রশ্ন উঠেছিল, সিলেট জেলা পাকিস্তানে নাকি ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ওই সময় সিলেট ছিল আসামের একটি জেলা।

ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, গণভোটের মাধ্যমে সিলেটবাসীই সিদ্ধান্ত নেবে। এই গণভোট যখন আয়োজিত হয় তখন মওলানা ভাসানী সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে জনমত গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত সিলেট পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলায় পরিণত হয়। তবে সিলেটের করিমগঞ্জ মহকুমাটি ভারতেই থেকে যায়। করিমগঞ্জকে ভারতে যুক্ত করার কারণ, পার্বত্য ত্রিপুরা যাতে ভারতের মূল ভূ-খণ্ডরে সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে পারে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি জিন্নাহ সাহেবের কাছে পূর্ববঙ্গের কৃষকদের দারিদ্র্য ও নিঃস্ব অবস্থা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। এই বিবরণ দিতে গিয়ে মওলানা ভাসানী হু হু করে কেঁদে ফেলেন। জিন্নাহ সাহেব মন্তব্য করলেন, এত আবেগপ্রবণ মানুষ দিয়ে বাস্তব রাজনীতি হয় না। তবে আবেগ না থাকলে গরিব মানুষের ভালোবাসা যায় না। তাদের সংগ্রামের সাথি হওয়া সম্ভব হয় না।

যে মওলানা পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছেন, কারাভোগ করেছেন-সেই মওলানা দেখলেন, পাকিস্তান আর কৃষকদের কল্পস্বর্গ হয়ে উঠতে পারছে না। কারণ পাকিস্তানের সামন্ত শ্রেণিভুক্ত নেতারা কৃষকদের  স্বার্থ সংরক্ষণে আদৌ প্রস্তত নন। তাদের আচরণ প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীলও বটে। পূর্ববঙ্গের কৃষকরা পাকিস্তান সমর্থন করেছিল বর্ণ হিন্দু, জমিদার ও কলকাতাকেন্দ্রিক ভদ্রলোকদের শোষণ ও আধিপত্য থেকে মুক্তির আশায়। সেই সময় অন্য কোনো মুসলিম প্রধান প্রদেশে পাকিস্তানের প্রতি এত স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দেখা যায়নি। মূলত পূর্ববঙ্গের শোষিত-বঞ্চিত কৃষকরাই পাকিস্তান আন্দোলনের মূল শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।

তখনকার মুসলিম লীগ সরকার পূর্ববঙ্গে জমিদারি উচ্ছেদ আইন পাস করলেও কৃষকদের দুর্ভিক্ষ ও অনাহার থেকে রক্ষা করতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের বাধার ফলে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে প্রগতিশীল নেতারা আসতে পারছিলেন না। এমনই এক অবস্থায় মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগ নেতাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খান ভিন্নমত পোষণকারীদের প্রতি উক্তি করেছিলেন, ‘শির কুচাল দেঙ্গে’ অর্থাৎ ‘মাথা কেটে ফেলব’।

মুসলিম লীগ নেতৃত্বের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার জন্য মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে দলটি পূর্ব বঙ্গের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মূল শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও গণতন্ত্রী দলকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গড়ে ওঠে। এই ফ্রন্টের প্রতি কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন জ্ঞাপন করে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ববঙ্গ থেকে মুসলিম লীগ প্রায় সমূলে উৎপাটিত হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রাদেশিকতার অভিযোগ আনা হয়। ১৯৫৪ সালেই পূর্ববঙ্গে ৯২ (ক) ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শাসন প্রবর্তিত হয়। প্রদেশব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়।

মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব বঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ওই সময় মওলানা ভাসানী ছিলেন ব্রিটেনে স্টকহল্ম্ শান্তি সম্মেলনের পথে। ইস্কান্দার মির্জা ঘোষণা করলেন, মওলানা ভাসানী দেশে ফিরলে এমন সুদক্ষ বন্দুকচালককে দিয়ে তাকে গুলি করা হবে যাতে গুলির নিশানা ব্যর্থ না হয়। এমন পরিস্থিতিতেই মওলানা ভাসানী স্টকহোল্ম শান্তি সম্মেলনে যোগ দিয়ে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান।

পূর্ব বঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠলে মওলানা ভাসানী কলকাতা হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান কৃষ্টি সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে পৃথিবীর বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতাদের নামে অনেক তোরণ নির্মাণ করা হয়। এই সম্মেলন থেকে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে আস্সালামুয়ালাইকুম জানান। স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিরও দাবি জানান তিনি। এ নিয়ে তার সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর তীব্র মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়।

এই সময় সোহরাওয়ার্দী পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ‘০+০+০=০’ তত্ত্ব উপস্থাপন করে পাকিস্তানকে পাশ্চাত্য জোটভুক্ত করার পক্ষে তার মতবাদ তুলে ধরেন। স্বাধীনচেতা মওলানা ভাসানী এটা মানতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দী আরো দাবি করেছিলেন, পূর্ববঙ্গকে ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে। বাকি দুই অংশের জিম্মাদার তিনি। এই বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগের মূল ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে এসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। এই পার্টির মূল নীতি ছিল, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরোধিতা এবং পকিস্তানের প্রদেশগুলোর জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। একই বছর ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জার কাছ থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা কেড়ে নেন। সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হলো।

এই পর্যায়ে মওলানা ভাসানী পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচ বছর কারা ভোগ করেন। মওলানা ভাসানীর মুখে শুনেছি, তিনি তার জীবনে ৩৩ বছর কারান্তরালে কাটিয়েছেন। ১৯৬৩ সালে কারা মুক্ত হয়ে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতি সক্রিয় করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পূর্ব বঙ্গব্যাপী জনসভা করে বেড়ান। এই সময় পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে গার্ড অব অনার দেয়।

১৯৬৪ সালে তিনি চীন সরকারের আমন্ত্রণে চীন সফর করেন। এই সফরের সময় তিনি ‘মাও সেতুং, জো এন লাইসহ প্রথম সারির চীনা নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সে সফরে তিনি চীনের কয়েকটি গ্রাম ও শহরে পরিভ্রমণ করেন। চীন থেকে ফিরে সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘মাও সেতুং-এর দেশে’ শিরোনামে একটি বই লেখেন। বইটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয় হয়।

১৯৬৬ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ তার চিরাচরিত স্বায়ত্তশাসনবিরোধী অবস্থান পরিবর্তন করে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা কর্মসূচি হাজির করে। এই কর্মসূচির মূল নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফার পক্ষে বেশ কিছু জনসভা করার পর শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১ নম্বর আসামি করা হয়। আয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহর মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভ করলে জনমনে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়। নির্বাচনটি হয়েছিল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে।

কিছুতেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা যাচ্ছিল না। এই তীব্র হতাশার মধ্যে মওলানা ভাসানী ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরের ৭ তারিখ ঢাকায় হরতালের ডাক দেন। বস্তুত কোনো প্রস্তুতি ছাড়া এক দিনের আহ্বানে এই হরতাল সফল হয়, যা ছিল কল্পনাতীত। এই হরতালে পুলিশের গুলিতে আব্দুল মজিদ ও আবু নামে দুই ব্যক্তি নিহত হন। এরপর ২৯ ডিসেম্বর গ্রাম বাংলায় আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হাট হরতালের ডাক দেন। নরসিংদীর হাতিরদিয়ায় হাট হরতাল ব্যর্থ করতে পুলিশ গুলি চালায়। এতে তিনজন নিহত হন। এই আন্দোলনটি পরিচালনা করেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান। গুলি ও নিহতের খবর কোনো পত্রিকায় আসেনি।

আসাদুজ্জামান ঢাকায় এসে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে এ ঘটনাটি জানান। এরপর আসাদুজ্জামান ঢাকায় গণ-অভ্যুত্থানে যোগ দেন এবং শহীদ হন। সেদিনের হাট হরতালে যশোরের গোবরাতেও পুলিশের সঙ্গে জনগণের সংঘর্ষ হয়। মওলানা ভাসানী এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনহীনতার জড়তা ভেঙে দেন। ফলে ছাত্রসমাজের ১১ দফা ভিত্তিক বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা সম্ভব হয়। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন, বাস্তিল দুর্গের যেভাবে পতন ঘটানো হয়েছিল, ঠিক সেভাবে ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করা হবে।

এর আগের দিন ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকিস্তানি শান্ত্রিরা গুলি করে হত্যা করে। ফলে জনগণের ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্র হয়ে ওঠে। পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর বক্তব্যের পর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আগুন জলে ওঠে। আইয়ুব খান বুঝতে পারেন তার সময় শেষ হয়ে এসেছে।

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। শেখ মুজিব আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিলেও মওলানা ভাসানী বিরত থাকেন। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টুও গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেননি। পতন অনিবার্য হলে আইয়ুব খান ২৪ মার্চ প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানব্যাপী ‘এক লোক এক ভোট নীতি’র ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়। এর মাঝেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে। এর দুই-চার দিনের মধ্যে মওলানা ভাসানীর সন্তোষের বাড়ি পাকিস্তানি আর্মি জালিয়ে দেয়। মওলানা ভাসানী নৌকায় যমুনা নদী হয়ে ভারত সীমান্তে পৌঁছান। সেখানে বিএসএফ খবর পেয়ে তাকে আসামে নিয়ে যায়। এই সময় তার সঙ্গী ছিলেন সিরাজগঞ্জের মোজাফফর ন্যাপ নেতা সাইফুল হক। আসামে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তার পুরোনো সহচর ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর দেখা হয়।

এর পরের কাহিনি দুঃখময়। মওলানা ভাসানীকে বন্দি করে সুদূর দেরাদুনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে রাজনৈতিক সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয়নি। গৃহবন্দি অবস্থায়ই মওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেওয়ার জন্য বিশ্বনেতাদের  কাছে টেলিগ্রাম ও চিঠি পাঠান। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয় তাতে মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় তিনি কোনো রকম আপস না করে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে মওলানা ভাসানীকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়। তিনি সন্তোষে আসেন। নিজস্ব ঘরবাড়িহীন মওলানা সন্তোষের পুরোনো জমিদারবাড়ির একটি কক্ষের মেঝেতে বিছানা পাতেন। তার আগমনের খবর পেয়ে আমি ও আমার কিছু সঙ্গী সন্তোষে ছুটে যাই। তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে শুধু একটি প্রশ্নই একাধিকবার আমরা করেছিলাম। প্রশ্নটি ছিল, ‘ভারতে তিনি কী অবস্থায় ছিলেন?’ প্রতিবার তিনি বললেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী তাকে প্রচুর আদরযত্ন করেছেন।’ অনেক পীড়াপিড়ির পর তিনি বলে ফেললেন, ‘বোঝোই তো, আমি ভিন্নপন্থি, আমাকে সেভাবেই দেখেছে।’

বাংলাদেশ-উত্তরকালে আওয়ামী লীগের ‘নিখিল বাংলাদেশ লুটপাট সমিতি’ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ব্যাপক জনমত গড়ে তোলেন। সে সময় ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছিলেন তিনি। পত্রিকাটি বিপুল জননন্দিত হয়। কিন্তু মুজিব সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়।

১৯৭৪ সালে মওলানা ভাসানীকে সন্তোষে গৃহবন্দি করে মুজিব সরকার। তার এই বন্দিদশায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট মুজিব সরকারের পতন ঘটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পটপরিবর্তন ঘটে। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রাদপ্রদীপের নিচে এসে দাঁড়ালে মওলানা ভাসানী তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।

১৯৭৬ সালে গঙ্গার পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে মওলানা ভাসানী ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চ করেন। এতে ব্যাপকভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পানিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল।

পরবর্তী সময়ে কোনো চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল না। ফারাক্কা লং মার্চের পর মওলানা ভাসানী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আর তিনি সেরে ওঠেননি। মওলানা ভাসানী কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে ১৯৫৬ সালে কৃষক সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষকের ভাষায় অত্যন্ত দক্ষভাবে কথা বলতে পারতেন।

কৃষকদের সচেতন করতে তিনি ধর্মীয় উপাখ্যান থেকে কিছু গল্পকাহিনি পরিবেশন করতেন। ধর্মের সাম্যের সঙ্গে তিনি কৃষকের শ্রেণি চেতনাকে সার্থকভাবে সমন্বিত করতে পেরেছিলেন। উপমহাদেশে যত কৃষক আন্দোলন হয়েছে, যেসব আন্দোলনে ধর্মীয় চেতনা ও শ্রেণি চেতনা সমন্বিত হয়েছিল-সেই ধারার শেষ প্রতিনিধি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এমন একজন ভাসানী আমাদের সমাজে আর আসবে না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫