কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ

অলোক আচার্য
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:০৯

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের ব্যবহার যেখানে বেশি হবে সেটা যুদ্ধক্ষেত্র। ছবি: সংগৃহীত
সুদর্শনা রোবট মানবী সোফিয়ার কথা আমরা সবাই জানি। সামনাসামনি দাঁড়ালে অনেকেই বুঝতেই পারবে না সে মানবী না রোবট, বেশ কথাও বলে। বিজ্ঞান আশ্চর্যের এই সৃষ্টি করেছে। এই সোফিয়ার জনক হলেন ডেভিড হ্যানসন।
গণমাধ্যমে জানা যায়, তার আরও দুটি বোন রয়েছে। তারা হলো গ্রেস আর ডেসডিমোনা। তিনজনই মানবিক রোবট। তিনজনের মধ্যেই ঢোকানো হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বিজ্ঞানের সর্বশেষ প্রচেষ্টা।
একটি যন্ত্রকে বিজ্ঞানীরা বুদ্ধিমত্তা প্রদান করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করতে চাইছেন। সোফিয়াকে সৌদি আরবের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছে। একসময় হয়তো দেখা যাবে মানুষ ও রোবট পাশাপাশি হাঁটছে; কিন্তু কোনটা মানুষ আর কোনটা রোবট আমরা বুঝতে পারব না। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ শুধু এটুকু বলেই থেমে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
বিজ্ঞানের সাথে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এক হয়ে একটি বিশাল বিজ্ঞানভাণ্ডার তৈরি হয়েছে। তার মানে এই সময় যেমন বিজ্ঞানের তেমনই তথ্যেরও। বিজ্ঞান ও তথ্য। বিজ্ঞান সবসময়ই গতিশীল। মানুষের কল্পনার সাথে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা স্বপ্নজয় করতে সাহায্য করছে। অর্থাৎ মানুষ যদি পাখি দেখে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন না দেখত তাহলে আকাশে ওড়া স্বপ্নই থেকে যেত।
আমরা পাখির গতিকে পরাজিত করে, শব্দের গতিতে ছুটছি। আজকের পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডেই নতুন নতুন তথ্যের যোগ হচ্ছে। মানুষ তা ব্যবহার করছে। আর এসব যে যন্ত্রটি নিখুঁতভাবে ধরে রাখছে সেটি কম্পিউটার। শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলো কম্পিউটার। তবে কম্পিউটারের কোনো নিজস্ব বুদ্ধি নেই।
নিজস্ব প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করে। এজন্য একবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধমত্তা। যাকে ইংরেজিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে। মানুষ তার স্বভাবজাত কারণেই চিন্তা করতে পারে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারে। অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধি আছে। দু-একটি প্রাণীরও একটু-আধটু বুদ্ধি আছে বলে প্রমাণিত; কিন্তু একটি যন্ত্র তা পারে না।
কারণ মানুষ প্রথমটায় যন্ত্রকে বুদ্ধি দিতে পারেনি। এই যে যন্ত্র তা পারে না সেই যন্ত্রকেই কৃত্রিম বুদ্ধমত্তা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রচেষ্টা বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে চেষ্টা করছে।
সেই প্রচেষ্টায় অগ্রগতিও হয়েছে। বিজ্ঞানীরা যন্ত্রকে সেই দক্ষতা দিতে চাইছে যাতে সেগুলো মানুষের মস্তিষ্কের মতো চিন্তা করার ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে গেছে রোবট। খেলাধুলার সঙ্গী রোবট, বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নিঁখুতভাবে করছে রোবট, জমিতে ফসল ফলাতে রোবট, হোটেলে কাস্টমারদের সেবা দিচ্ছে রোবট, হাসপাতালে ডাক্তারের সাথে কাজ করছে রোবট।
রোবট মানে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র যা একটি নির্দিষ্ট তথ্য ও প্রোগ্রামের ভিত্তিতে কাজ করে। মাটি থেকে মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে রোবট। অন্য গ্রহের অবস্থা জানতে রোবট পাঠানো হচ্ছে। তবে রোবট নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেয় না। যদি নিতে পারে তখন সেটাকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলা যাবে। বর্তমান কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা এটি।
এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দটি ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির জন ম্যাকার্থী সর্বপ্রথম এই শব্দটির উল্লেখ করেন। তাকেই অধিকাংশের মতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জনক হিসেবে অভিহিত করেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রগুলো হলো মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, স্পিচ রিকগনিশন, রোবটিক্স, ভিশন, এক্সপার্ট সিস্টেম।
অবশ্য এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে আরেকজন রয়েছেন। তিনি হলেন বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অ্যালান টুরিং। তার গবেষণা ‘চার্চ-টুরিং থিসিস’ নামে বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করার জন্য তিনি ‘টুরিং পরীক্ষা’ নামের একটি বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন। এই পরীক্ষাটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি তৈরি করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার নিয়ে রচিত সায়েন্স ফিকশনগুলো বেশ জনপ্রিয়।
মানুষ বহু আগেই তার লেখায় রোবটকে বুদ্ধি দিয়ে গল্প লিখেছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক দাবি করেছেন, আগামী ১২০ বছরের মধ্যে মানুষ তাদের সব কাজ বুদ্ধিমান মেশিনের সাহায্যে করবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যাই বলি, এটা তো মেশিন ছাড়া আর কিছু নয়। তাহলে একটি মেশিন যদি নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে এর ভালো এবং মন্দ দিকগুলো কী হবে?
প্রযুক্তি আমাদের যেমন সুযোগ সুবিধা দিয়েছে ঠিক বিপরীতে আমাদের ক্ষতিও করেছে। প্রযুক্তি যেমন পৃথিবীর অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করেছে। সেভাবেই প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের মুখোমুখি। একই রকমভাবে কৃত্রিম বুদ্ধি সম্পন্ন কোনো যন্ত্র যে ভবিষ্যতে মানবজাতির জন্য বিপজ্জনক হবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের ব্যবহার যেখানে বেশি হবে সেটা যুদ্ধক্ষেত্র।
এটা শুরুও হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের ব্যবহার মানুষের প্রাণহানি কমাবে। যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের দরকার হয়, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এসব রোবটের ব্যবহার মানুষের প্রাণ রক্ষা করবে। বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং যুদ্ধপরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম চালনা করাও এসব রোবটের কাজ হবে।
এখন যেখানে পেছন থেকে এসব যন্ত্রকে চালনা করা হচ্ছে তখন হতে পারে যন্ত্র নিজেই নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে এসব কাজ করবে, কোনো কমান্ডের দরকার হবে না; কিন্তু যন্ত্রকে এই ক্ষমতা দিলে মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ কী হবে সে প্রশ্নও উঠেছে।
রোবটিক সভ্যতা বিস্তারে এখন যা হচ্ছে তা হলো মানুষের কাজের জায়গা এরা দখল করে নিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম জানিয়েছিল, গত ২০২২ সালের মধ্যে রোবটের কারণে বিশ্বজুড়ে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। আর সময়ের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং জানিয়েছিলেন- এরা একসময় আমাদের অতিক্রম করে যাবে।
রোবট এখন নাচ দেখাচ্ছে, ফুল সাজাচ্ছে, সামাজিক আচরণ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, শিক্ষা সহযোগী হয়েছে, রেস্তোরাঁয় কাস্টমারদের সেবা দিচ্ছে। আরও বহু কাজ করছে রোবট। সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব কাজ করছে। অর্থাৎ মানুষের জায়গা অনায়াসে দখল করে নিয়েছে রোবট। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সম্ভাবনা ও শঙ্কা দুই-ই রয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
যন্ত্রকে বুদ্ধিমত্তা দিলে তা মানবজাতির জন্য হুমকিও হয়ে উঠতে পারে। আর তা হতে পারে ভয়ঙ্কর। সায়েন্স ফিকশনে যেমনটা মানুষের সাথে রোবটের লড়াই হয় অনেকটা সেরকম। নিজের আবিষ্কারের সাথে নিজের। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্র নিয়ে নীতিমালা করার পরামর্শ দিয়েছেন গুগলের সাবেক চেয়ারম্যান এরিক স্মিড।
বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, রোবট ২০৫০ সালের মধ্যে সমস্ত মানবিক কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে রোবট। অর্থাৎ রোবট আর মানুষ পাশাপাশি কাজ করবে, বসবাস করবে এবং তা শুরুও হয়েছে। অবসরের সঙ্গী হয়েছে রোবট।
বিনোদন দিচ্ছে রোবট; কিন্তু পুরোমাত্রায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফল কার্যক্রম শুরু হলে তা মানব জাতির জন্য কতটা সুখকর হবে বা তা নিয়ন্ত্রণে কতটা সফল হবে সেটা সময়ের ওপর নির্ভর করছে। তবে বিজ্ঞান থেমে থাকবে না। একদিন মানুষ সবক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে পুরো সফল হবে। শুরু হবে নতুন জয়যাত্রা।