আধুনিক যোগাযোগ ডিভাইস কি তবে নব্য মারণাস্ত্র

তৌসিফ আহমেদ
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২৯

আধুনিক যোগাযোগ ডিভাইস পেজার। ছবি: সংগৃহীত
গত কয়েকদিনে লেবানন ও সিরিয়ায় একের পর এক পেজার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৩৭ জনের মৃত্যু এবং প্রায় তিন হাজারের মতো মানুষ আহত হয়েছেন। আধুনিক প্রযুক্তির শুরুর দিকের এই যোগাযোগ ডিভাইসের সাম্প্রতিক সময়ের ঘটা বিস্ফোরণ-কাণ্ডের পর এটি সম্পর্কে জানতে মানুষের যেমন কৌতূহল বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ভয়। মানুষ জানতে উৎসুক- পেজার কী আর আধুনিক যোগাযোগ ডিভাইসের সঙ্গে এর সম্পর্কটা কী? শুধু কি এই একটি ডিভাইস দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, নাকি আমরা নিজের অজান্তেই দূর-নিয়ন্ত্রিত কোনো মারণাস্ত্র সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি? এই লেখায় এসব প্রশ্নের কিছু উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
পেজার কী
পেজার বর্তমান প্রজন্মের কাছে নতুন শব্দ। তবে স্মার্টফোন আসার আগে এটি বেশ জনপ্রিয় ছোট্ট ইলেক্ট্রনিকস ডিভাইস ছিল, যা ছোট বার্তা আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হতো। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যালের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা পেজার হলো পোর্টেবল কমিউনিকেশন ডিভাইস।
জানা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ডেট্রয়েট পুলিশ ডিপার্টমেন্ট প্রথমবার পেজারের মতো ডিভাইস ব্যবহার করে। তবে ওই ডিভাইসের উন্নততর ভার্সন ‘পেজার’ নামটি মোটোরোলার দেওয়া। মোটোরোলা প্রথম নিজস্ব পেজার তৈরি করে ১৯৬৪ সালে। তখনতার পেজার এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না। প্রযুক্তির উদ্ভাবনীর সঙ্গে পেজার আরও উন্নত হয়েছে। ১৯৮০ সালের পর পেজার আরও উন্নত হয়।
যখন বাজারে মোবাইল ফোন আসেনি, তখন পেজারের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। নব্বই দশকের আগেও হাসপাতালে চিকিৎসক, সাংবাদিক, টেকনিশিয়ানদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল এই ডিভাইস। তবে মোবাইল ফোন এলেও এখনো বেশ কয়েকটি সেক্টরে পেজার ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা গোপন কোড বা সাংকেতিক ভাষায় নিজেদের বার্তা আদান-প্রদান করতে চান। বিভিন্ন গোষ্ঠী এখনো এই পেজার ব্যবহার করে; দলের কথা-বার্তা, পরিকল্পনা গোপনে আদান-প্রদান করার জন্য। তবে মোবাইল এসে পেজারের গুরুত্ব অনেকটাই কমে গেছে। এর ব্যবহারও অনেক সীমিত হয়েছে।
কীভাবে পেজার বিস্ফোরিত হয়েছে?
পেজার বিস্ফোরণের ভিডিওগুলোয় দেখা যায় যে, ডিভাইসগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে ভিকটিমরা তাদের পকেটে হাত দেয়। জাতিসংঘে লেবাননের মিশনের একটি চিঠি অনুসারে, লেবানন কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ডিভাইসগুলোয় একটি ‘ইলেক্ট্রনিক বার্তা’ পাঠানোর কারণে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়। ওই বার্তা ডিভাইসগুলোকে ট্রিগার করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে লেবানন ও সিরিয়ায় কীভাবে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে প্রযুক্তিমহলে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে- পেজারগুলো এক জটিল সাইবার হামলা বা হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছিল, যার কারণে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়। এই তত্ত্বটি উড়িয়ে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এই পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি করার জন্য, সম্ভবত ব্যবহারকারীর কাছে যাওয়ার আগেই ওইসব যন্ত্রে বিস্ফোরক সংযুক্ত করে রাখা হয়েছিল।
অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমেও কি নাশকতা হতে পারে
লেবাননের ঘটনায় এখন অনেকেই মনেই প্রশ্ন, অন্যান্য ডিভাইস যেমন- ক্যামেরা, ফোন বা ল্যাপটপ ইত্যাদির মাধ্যমেও কি নাশকতা হতে পারে? এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারা বলছেন, স্মার্টফোন বা বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা অন্যান্য প্রযুক্তিতে ঝুঁকি আছে- এমন কোনো আলামত মেলেনি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব পেজার বিস্ফোরিত হয়েছে সেগুলো আগে থেকে মডিফাই করা ছিল; কিন্তু আক্রমকারীরা ঠিক কীভাবে এসব পেজার মডিফাই করেছে, তা না জানলে অন্যান্য গ্রাহক ডিভাইস নিরাপদ কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। ব্রিটিশ কম্পিউটার সোসাইটির (বিসিএস) চার্টার্ড ইনস্টিটিউট ফর আইটিতে কর্মরত ড্যানিয়েল কার্ড বলেন, কোনো সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ঘটানো ‘প্লাস্টিক’ বিস্ফোরকের সাপ্লাই চেইন আক্রমণ নিয়ে একজন সাধারণ ব্যক্তির চিন্তার কোনো কারণ নেই। তার মতে, এমন ঘটনা অস্বস্তিকর হলেও তা দৈনন্দিন জীবনে পরিচিত কোনো হুমকি নয়।
এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস সাধারণত খুবই নিরাপদ। আর এমন বিস্ফোরকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অত্যন্ত বিরল, যা কেবল জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে বিবেচিত বৈশ্বিক জনসংখ্যার খুবই ছোট অংশের ওপর বর্তায়।