
চীনা বিদ্যুৎচালিত গাড়ি। ছবি: সংগৃহীত
সাশ্রয়ী মূল্য আর বৈচিত্র্যপূর্ণ ডিজাইনের জন্য চীনা বিদ্যুৎচালিত গাড়ির (ইভি) ব্যাপক চাহিদা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দিন যত যাচ্ছে, চীনা গাড়িতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে মার্কিন গাড়ির বাজার। এ ঢেউ ঠেকাতে চীন থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎচালিত গাড়ির ওপর ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শতভাগ শুল্ক প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গাড়ির ওপর শুল্কের পাশাপাশি ইভি ব্যাটারি এবং মূল খনিজগুলোর ওপর নতুন শুল্ক বৃদ্ধিসহ চীনা আমদানির ওপর চড়া শুল্ক বৃদ্ধি করেছে দেশটি। তা সত্ত্বেও চীন থেকে আসা কিছু মডেলের দাম স্থানীয় গাড়ির তুলনায় মার্কিন বাজারে সস্তা থাকবে।
পশ্চিমাদের দাবি, ইভি শিল্পের বিকাশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনে গাড়ি কোম্পানিগুলো বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে। এতে চীনে তৈরি গাড়ির দাম প্রতিযোগীদের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী। তাই স্থানীয় শিল্প রক্ষায় অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) কার্যালয় বলছে, চীনের শিল্পনীতি ইভি খাতে মার্কিন বিনিয়োগকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাই এ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া ১০ শতাংশ গাড়ি ছিল ইভি। অন্যদিকে চীনের এ অনুপাত ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ২০ শতাংশের বেশি বলে জানিয়েছে বাজার গবেষণা সংস্থা মার্কলাইনস। যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রি তুলনামূলক কম হওয়ার প্রধান কারণ হলো, ইভি মডেলগুলো সাধারণের ক্রয়সীমার বাইরে। কিন্তু বিওয়াইডির মতো বড় চীনা নির্মাতারা ২৫ হাজার ডলার বা এর কম মূল্যের ইভি দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে এ খাতে শীর্ষে থাকা টেসলাও ৩০ হাজার ডলারের নিচে নামতে পারেনি।
মার্কিন অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিবিদদের আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘সিগাল’ নামের একটি ছোটখাটো, সাশ্রয়ী মূল্যের চীনা ইলেকট্রিক গাড়ি। গত বছর চীনের অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি এই গাড়ি বাজারে আনে। গাড়িটির দুটি মডেল চীনে ১০ ও ১২ হাজার ডলারে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গাড়ির ফিচার এবং নির্ভরযোগ্যতা এর চেয়ে তিন গুণেরও বেশি দামে বিক্রি হওয়া মার্কিন গাড়ির চেয়ে ভালো। লাতিন আমেরিকা ‘ডলফিন’ নামে বিক্রি হচ্ছে বিওয়াইডি সিগাল। আমদানি করা হলে যে শুল্ক দিতে হবে, তাতেও সম-ফিচারের মার্কিন গাড়ি থেকে সিগাল সাশ্রয়ী হবে। ফলে আমদানি হলে দেদার বিকোতে পারে সিগাল।
ফিলাডেলফিয়া ভিত্তিক অটোফোরকাস্ট সলিউশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যাম ফিওরানি বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ওদের (চীনা নির্মাতা) দিকে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান মনোযোগ না দেয়, তাহলে তারা যখন বাজারে আসবে, তখন সেসব প্রতিষ্ঠান নির্মূল হয়ে যাবে। বিওয়াইডি মার্কিন বাজারে প্রবেশ করবে কিনা, সেটা প্রশ্ন নয়। কবে করবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।’
জেনারেল মোটর্সের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও কেয়ারসফটের প্রেসিডেন্ট টেরি ওয়েচৌস্কি বলেন, ‘এই গাড়িটি যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন শিল্পকে ঘুম থেকে জেগে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছে। স্বল্প খরচের ইভি নির্মাণের দিক দিয়ে চীনের চেয়ে বহু বছর পিছিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। সিগালের ডিজাইনে তেমন কোনো চাকচিক্য না থাকলেও এটি মানসম্পন্ন। দরজাগুলো খুব সহজে খোলে ও বন্ধ হয়। ছাই বর্ণের কৃত্রিম চামড়ার সিটগুলো রুচিশীল। এ ধরনের সিট সাধারণত আরও বিলাসবহুল গাড়িতে দেখা যায়। এই গাড়িতে ছয়টি এয়ার ব্যাগ, পেছনের চাকার ডিস্ক ব্রেক ও ইলেক্ট্রনিক স্ট্যাবিলিটি কন্ট্রোল ফিচার রয়েছে। গাড়িটি প্রায় নিঃশব্দে চলে এবং মোড় ঘুরতে বা উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়েও এটি বেশ স্থিতিশীল ও সাবলীল থাকে, যা সাধারণত আরও দামি গাড়ির ফিচার। সিগালের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার, যা একে মহাসড়কে চলার উপযোগিতা দিয়েছে।’
সস্তায় ইভি সরবরাহের জন্য আরও একটি কৌশল নিয়েছে চীনা কোম্পানিগুলো। শিগগিরই মেক্সিকোয় কারখানা খুলতে যাচ্ছে বিওয়াইডি। ওয়াশিংটনের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, ব্যাটারির জন্য চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোয় মন্থরগতি। কারণ ইভি নির্মাণে ৩০ শতাংশ খরচ হয় এতে। এ বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) চীন থেকে ৬২০ কোটি ডলারের ব্যাটারি আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালে এ খাতে আমদানি খরচ ছিল এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ ও তিন বছরের মধ্যে ছয় গুণ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে উচ্চ শুল্ক থেকে চীনা ইভি ব্যাটারিকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি এসেছে। সম্প্রতি ইভির সরবরাহ চেইন তৈরিতে অগ্রগতির অভাব কিছু মার্কিন কোম্পানিকে বিনিয়োগ পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করেছে। যেমন জেনারেল মোটরস ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে ব্যাটারি কারখানায় উৎপাদন শুরু প্রায় এক বছরের জন্য স্থগিত রেখেছে।