Logo
×

Follow Us

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মানব ‘প্রেম’ কি পরাজিত হবে রোবটের কাছে

Icon

তৌসিফ আহমেদ

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬

মানব ‘প্রেম’ কি পরাজিত হবে রোবটের কাছে

কৃত্রিম মানবের সাথে প্রেম। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় দুইশ বছর আগের ঘটনা। ইংরেজ সাহিত্যিক মেরি শেলী একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখেন। নাম ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। বইটির উপজীব্য ছিল ‘কৃত্রিম মানব’ সৃষ্টি ও তার স্রষ্টার করুণ পরিণতি। সারা বিশ্বে বইটি দারুণ সাড়া ফেলে এবং বিশ্ব সাহিত্যে ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা পায়। 

এরপর কেটে যায় আরও একশ বছর। ১৯২০ সালে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চেকোস্লোভাকিয়ান লেখক ক্যারেল চ্যাপেক মানুষের ইচ্ছায় চলে এমন ‘যন্ত্রমানব’ নিয়ে ‘আর-ইউ-আর’ নামের কল্পকাহিনি-নির্ভর একটি নাটক লেখেন। যার পূর্ণাঙ্গ অর্থ- রোসামস ইউনিভার্সাল রোবটস। চেক ভাষায় রোবট অর্থ ‘যন্ত্রমানব’। 

এরপর থেকে রোবট সম্পর্কীয় কল্পকাহিনির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এসব কাহিনির প্রায় প্রতিটিতেই রোবটকে ভয়ঙ্কর কিংবা খুনে চরিত্রে দেখানো হতো। রোবট নিয়ে মানুষ আতঙ্কে ভুগতে থাকে। ঠিক এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আইজ্যাক আসিমভ নামের এক তরুণ লেখক কিছুটা ভিন্নভাবে ভাবলেন। তিনি বললেন, রোবট নিয়ে মানুষের আতঙ্ক ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কমপ্লেক্স’ ছাড়া কিছুই নয়। রোবটকে তিনি নিরীহ আর উপকারী, এমনকি ভালোবাসার যোগ্য চরিত্র হিসেবে গল্পে তুলে ধরতে শুরু করেন। এরপর আরও অনেক কল্পকাহিনি লেখক সেকেলে ধাঁচের রোবটের গল্প লেখা বন্ধ করে দেন। তারা রোবটের ‘মানবীয়’ দিক নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করেন। এসব কল্পলেখকের কাহিনি পরে বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীদের উৎসাহ জোগায়। রোবোটিক্সের যাত্রা শুরু হয়। একুশ শতকে ফিরে আসা যাক। গত ২০ বছরে প্রযুক্তির বিস্ময়কর উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে মানুষের জীবনে।

বিংশ শতাব্দীতে যা কল্পনায় ছিল তা এখন বাস্তবতায় ধরা দিয়েছে। এখন খাবার পরিবেশন থেকে থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা, সবখানেই রোবটের ব্যবহার অতিসাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন ভয়ঙ্কর তথ্য। অন্য সবকিছু তো থাকবেই, এমনকি মানুষ রোবটের সঙ্গে ‘লাভ মেকিং’ বা অন্তরঙ্গতায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তাদের মতে, নিকট ভবিষ্যতে প্রাথমিকভাবে যান্ত্রিক মানবের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি পরিলক্ষিত হবে। 

যৌন মনস্তত্ত্ববিদরা বলছেন, গত ২০ বছরে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রকট হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমের বহুল প্রচলনের ফলে ভার্চুয়াল সম্পর্কের বিস্তার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মানুষের মধ্যকার আন্তঃযোগাযোগ  হ্রাসের ফলে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতা ও হতাশা রোবটের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির প্রতি মানুষকে চালিত করবে। এ প্রসঙ্গে মনোবিদ ডা. হেলেন ড্রিসকোল বলেন, অনলাইন গেম এবং ভার্চুয়াল জগতে অনেকটা সময় কাটানোর মাধ্যমে অ্যানড্রয়েড প্রযুক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে নতুন মিথস্ক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানব জাতি অ্যানড্রয়েড প্রযুক্তির মেশিনকেই সঙ্গী হিসেবে আলিঙ্গন করতে পারে বলেও অশুভ ইঙ্গিত দেন হেলেন। 

আর এ বিষয়টিকেই বলা হচ্ছে ‘রোবোফিলিয়া’। ‘রোবোফিলিয়া’ মানে রোবটের প্রতি যৌন আকর্ষণ, যা আমাদের কাছে এখন অদ্ভুত মনে হলেও প্রযুক্তির প্রতি আসক্তির ফলে এটাই একসময় সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘হাফিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক ব্লগে ডা. ড্রিসকোল বলেন, যৌনতার জন্য পুতুলের অস্তিত্ব ইতিমধ্যেই বিদ্যমান এবং প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রযাত্রা এসব যৌনতার কৃত্রিম সঙ্গীকে আরও বাস্তবধর্মী করে তুলবে। কেউ কেউ যৌনতার জন্য খুঁতযুক্ত মানুষের চেয়ে নিখুঁত রোবটকেই পছন্দ করবে।

এদিকে এমনটা আগামী এক দশকের মধ্যে নারীরাও নিজেদের যৌনতা পূরণে পুরুষের পরিবর্তে রোবটকে বেছে নেবে- এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন ড. ইয়ান পিয়ারসন। তিনি বলেন, ২০২৫ সালে বিশ্বের ধনী পরিবারগুলোতে কয়েক প্রকার যৌন তৃপ্তিদায়ক রোবট জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। ২০৩০ সাল নাগাদ মানুষ ভার্চুয়াল যৌনতা নিয়মিতভাবে উপভোগ করবে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে যৌনতার পুতুলগুলো ভার্চুয়ালি যুক্ত হবে।

‘আমার ভবিষ্যদ্বাণী উড়িয়ে দেওয়ার আগে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা নিন’, বলেন ড. পিয়ারসন। ‘আমরা এখনই এই ভবিষ্যতের খুব কাছাকাছি আছি। মনে পড়ে, ভাইব্রেটর একসময় ট্যাবু ছিল? কিন্তু এখন নারী সম্পর্কিত ম্যাগাজিনগুলোতে এ নিয়ে ভরপুর আলোচনা হয়!’ তিনি দাবি করেন, ‘রোবটের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা শিগগিরই পর্নো দেখার চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।’ 

ড. পিয়ারসন মনে করেন, ‘আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে এটি মানব যৌনসম্পর্ককে সম্পূর্ণরূপে ছাপিয়ে যাবে। প্রথমে অনেকেই হয়তো রোবটের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে দ্বিধা বোধ করবেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) উন্নত হবে, এবং তারা শক্তিশালী আবেগের বন্ধন তৈরি করতে শুরু করবে, তখন সেই অস্বস্তিও ধীরে ধীরে কেটে যাবে।’

আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- মানুষ ও রোবটের যৌন মিথস্ক্রিয়া কিন্তু অনেক আগে থেকে পপ কালচার, বিশেষত ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় চর্চা হয়ে আসছে। সত্তর দশকে ডিজনির ‘স্টার ওয়ারস’ ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে শুরু করে হালের নেটফ্লিক্স অ্যানিমেশন ‘লাভ ডেথ প্লাস রোবট’ কিংবা বলিউডের ‘তেরি বাতো মে এইস্যা উলঝা জিয়া’- সবখানে হিউম্যানয়েড রোবটের প্রেম কাহিনির জয়জয়কার দেখা যায়। এসবও মানুষের এই ধরনের প্রকৃতিবিরুদ্ধ ফ্যান্টাসিকে জাগ্রত করতে নীরবে অনুঘটকের কাজ করে যাচ্ছে। 

সবকিছু দেখে প্রশ্ন জাগে, তবে কি প্রোগ্রাম-চালিত রোবটে মানবীয় গুণাবলি যুক্ত করে সামাজিক ও শারীরিকভাবে একে অপর থেকে দূরে সরে যাবে মানুষ? কী হবে তাহলে মানব জাতির ভবিষ্যৎ?- এর উত্তর হয়তো জমা আছে ভবিষ্যতের ঝুলিতে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫