Logo
×

Follow Us

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জেমিনিডস উল্কাবৃষ্টি

Icon

পারভেজ মনন আশরাফ

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:২০

জেমিনিডস উল্কাবৃষ্টি

প্রতীকী ছবি

আমরা অনেক সময় দেখতে পাই রাতের আকাশ থেকে হঠাৎ একটি আলোক বিন্দু যেন ছুটে নেমে আসে, চলার পথে এক ঝলক আলোর রেখা তৈরি হয়ে একসময় নিভে যায়; সাধারণ কথায় যে ঘটনাটিকে বলা হয় তারা খসা বা উল্কাপাত। অবশ্য পৃথিবীর বুকে প্রতিদিনই এ রকম অনেক উল্কা পড়তে পারে। এদের কিছু হয়তো এতই ছোট যে, বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষজনিত শক্তি (আলো বা তাপ) বিকিরণ খুব সামান্য। সে ক্ষেত্রে এগুলো তেমন উজ্জ্বল হয় না; তবে আকাশে রাতের বেলা যেকোনো সময়ে আকস্মিক উল্কাপাত অতি স্বাভাবিক ঘটনা। 

আজকাল যদিও আলোকদূষণ বা লাইট পলিউশনের কারণে ছোটখাটো উল্কাপাত আর আগের মতো দেখা যায় না। ইদানীং কিছু বড় আকারের উল্কাপাতের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে 

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। সেসব উল্কার পতন দৃশ্য ছিল যেমন অনবদ্য তেমনি ভীতিকর, ক্ষেত্রবিশেষে এর তাপ অনেক দূর থেকে অনুভূত হয়েছে আর শক ওয়েভের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু স্থাপনা! এ ধরনের অতি উজ্জ্বল অনিয়মিত একক উল্কাপাত ছাড়া কিছু নিয়মিত ‘দলগত’ উল্কাপাতের ঘটনা আছে, যেগুলো প্রতি বছরই একটা নির্দিষ্ট মাসে একাধিক রাতে দেখা যায়। চরম পর্যায়ে (পিক) আকাশের যেকোনো অংশে অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক উল্কাপাত দেখা যায়। এটাকেই বলা হয় উল্কাবৃষ্টি বা ‘মিটিওর শাওয়ার’। হঠাৎ অন্ধকার আকাশের পটে এক ফোঁটা আলোর বৃষ্টির মতোই ছুটে যেতে দেখা যায়, উল্কাবৃষ্টির উল্কাগুলোকে। 

উল্কাবৃষ্টি 

পুরনোকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের পর্যবেক্ষণে বেশ আকর্ষণীয় বর্ণনা দিয়েছেন উল্কাবৃষ্টির। এগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে নিয়মিত আবির্ভূত হয়। ধারণা মতে, যখন পৃথিবী সৌরজগতে তার কক্ষ পরিক্রমণের সময় কোনো বিশেষ উল্কাঝাঁকের কাছ দিয়ে যায় তখন উল্কাবৃষ্টি দেখা যায়। পৃথিবীর আকাশে একটা নির্দিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলী (‘রেডিয়েন্ট’) থেকে উল্কাগুলো আসছে বলে মনে হয়। সেই নক্ষত্রমণ্ডলীর নামের ওপর ভিত্তি করে সেই বিশেষ উল্কাবৃষ্টির নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন : ‘পারসিডস’ (পারসিউস নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে), ‘লিওনিডস’ (লিও বা সিংহ নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে), ‘জেমিনিডস’ (জেমিনি বা মিথুন নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে)। এ ছাড়া আছে ‘কোয়াড্রানটিডস’, ‘লাইরিডস’, ‘ইটা অ্যাকুয়ারিডস’, ‘ড্রাকোনিডস’, ‘ওরায়োনিডস’, ‘টরিডস’ ইত্যাদি। পারসিডস দেখা যায় আগস্ট মাসে, লিওনিডস নভেম্বরে, আর জেমিনিডস ডিসেম্বরে।

জেমিনিডস

নিয়মিত উল্কাবৃষ্টির মধ্যে ডিসেম্বরের জেমিনিডস হচ্ছে আকাশের বিশেষভাবে দর্শনীয় এবং উজ্জ্বল উল্কাবৃষ্টি জেমিনিডস উল্কাগুলো ডিসেম্বরের ৪ থেকে আর ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকে। তবে সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে ডিসেম্বর ১৩-১৪। মোটামুটি কাছাকাছি তারিখগুলোতে রাত ১২টার পর থেকে উল্কা পর্যবেক্ষণ করা উচিত, এ ক্ষেত্রে রাত যত বাড়বে তত ভালো, ভোররাত পর্যন্ত। তবে এ সময়গুলোতে আকাশে যদি চাঁদ থাকে, তবে চাঁদের আলোর কারণে অনুজ্জ্বল উল্কাগুলো দেখতে অসুবিধা হবে। আর চাঁদ ডুবে গেলে হবে সবচেয়ে ভালো সময়। ‘পিক আওয়ারে’ ঘণ্টায় ১০০-এর বেশি উল্কা দেখা যেতে পারে। বেশি রাতের দিকেই উল্কাপাতের হার ক্রমে বেড়ে যায়, যখন এর রেডিয়েন্ট নক্ষত্রমণ্ডল মিথুন আকাশগোলকে সবচেয়ে ওপরের অবস্থানে থাকে। শহর অঞ্চলে আলোকদূষণ বা লাইট পলিউশন এখন শৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আকাশ পর্যবেক্ষণে অন্যতম প্রধান বাধা। তাই এ ধরনের আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য গ্রামাঞ্চল বা আলোকদূষণ নেই সে রকম জায়গায় যেতে পারলে ভালো। জেমিনিডস সংশ্লিষ্ট উল্কাঝাঁকের মধ্যে উল্কার সংখ্যা বেশি, তাই উল্কাপাতের হার বেশি। কিছু সদস্য তুলনামূলকভাবে বড়, তাই সেগুলো বেশ উজ্জ্বলভাবে দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জেমিনিডসের এই উল্কাঝাঁকের জোগান ক্রমেই বাড়ছে। যে জন্য প্রতি বছর উল্কাপাতের হার বেড়ে যাচ্ছে জেমিনিডস উল্কাবর্ষণে।

কোত্থেকে তৈরি হয় উল্কাঝাঁক 

জ্যোতির্বিজ্ঞানের এ যাবৎ তথ্য মতে উল্কাবৃষ্টির উৎস পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পথে বিভিন্ন জায়গায় উল্কাঝাঁক, যারা আপন গতিতে সূর্যকে বা কোনো বড় গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে যায়। তো কারা এসব উল্কাঝাঁকের জোগানদার? এসব উল্কাঝাঁক মূলত কোনো ধূমকেতু অথবা গ্রহাণু থেকে সৃষ্ট।

যেমন পারসিডস-সংশ্লিষ্ট উল্কাঝাঁকের উৎপত্তি ধূমকেতু ‘সুইফট-টাটল’ থেকে খসে যাওয়া বস্তুসমষ্টি থেকে। জেমিনিডসের সঙ্গে জড়িত বস্তুটি একটি গ্রহাণু বা সম্ভবত একটি পাথুরে ধূমকেতু, যার নাম ‘৩২০০ ফেইথন’। ধারণা করা হয়, এসব ধূমকেতু বা গ্রহাণু যতবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে, তার দেহ থেকে অংশবিশেষ বিচ্ছিন্ন হয়ে কক্ষপথের ওপর বা নিকটবর্তী মহাশূন্য অঞ্চলে কোথাও রয়ে গেছে; আর পৃথিবী যখন সেই বস্তুসমষ্টির কাছ দিয়ে যাচ্ছে, তখনই মহাকর্ষের টানে ছুটে আসা সেসব বস্তুকণার সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংঘর্ষের দ্বারা ক্রমাগত প্রজ্বলনের ফলে আমরা উল্কাবৃষ্টিগুলো দেখতে পাচ্ছি।

উল্কাবৃষ্টি পর্যবেক্ষণ

উল্কাবৃষ্টি পর্যবেক্ষণের জন্য আসলে কোনো যন্ত্রপাতি যেমন টেলিস্কোপের দরকার নেই, খালি চোখই যথেষ্ট। দরকার অনেক খানি দেখা যায় এ রকম নিরিবিলি অন্ধকার আকাশ, যা শহর থেকে যতটা সম্ভব দূরে। আলোকদূষণ এড়িয়ে বাড়ির খোলা ছাদে বা মাঠে চেয়ার বা মাদুর পেতে শুয়ে কি বসে ধৈর্য সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ঘণ্টায় কতগুলো উল্কাপাত দেখা গেল সেটা হিসাব রাখা যায়। 

যদিও দেখার সময় যেকোনো জিনিসের আলোক কণা (ফোটন) যখন আমাদের চোখে পৌঁছায় তার ফলাফল রেটিনার পর্দায় ০.১ সেকেন্ডের মতো থাকে, এরপর মুছে যায় (এটা যদি না হতো তাহলে কী হতো? তখন হয়তো বা অন্ধকারে বসে থাকলেও একের পর এক ফোটনের আঘাতে হয়তো রেটিনা পুড়েই যেত, হয়তো চোখটা নষ্ট হয়ে যেত, নাকি?)। কিন্তু ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে আলোর কণার অভিঘাতজনিত ফলাফলগুলো পুঞ্জীভূত হতে থাকে, এক্সপোজারের সঙ্গে সঙ্গে। ফলে  যথেষ্ট দীর্ঘ সময়ের এক্সপোজারে রাতের আকাশ এমনভাবে ফুটে ওঠে, যেমনটি আমাদের চক্ষুযন্ত্রে দেখি না। অনেক অনুজ্জ্বল বস্তুর আলোর প্রতিরূপ থেকে যায়। উল্কাপাতের সময় আগে-পড়ে আসা ছোট-বড় অনেক উল্কার ট্রেস একসঙ্গে দেখা যায়, যেন একই সঙ্গে বৃষ্টির মতই পড়েছিল উল্কাগুলো। এর কিছু হয়তো খালি চোখে দেখার মতো যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল না, অথবা রং সেখানে চোখে ধরা পড়ত না, যেটা অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফিতে ধরা পড়ে। 

অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির আয়োজন থাকুক বা না থাকুক, আকাশ পরিষ্কার থাকলে জেমিনিডস পর্যবেক্ষণ হতে পারে একটি দারুণ অভিজ্ঞতা। উজ্জ্বল উল্কা পতনের সময় নীল, সবুজ, হলুদ, বা কমলা বর্ণের আলো দেখা যেতে পারে।  এ বছরের জন্য এটাই হতে পারে সবচেয়ে দর্শনীয় উল্কাবৃষ্টি।

লেখক : শৌখিন আকাশ পর্যবেক্ষক, তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর, যুক্তরাষ্ট্রে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে কর্মরত

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫