Logo
×

Follow Us

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

Icon

আসিফ

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:০৪

প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

প্রতীকী ছবি

বছরখানেক আগে একটা সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অনেকের মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করেন এমন কয়েকজন ছিলেন। তারা যখন তাদের গবেষণা কর্মকাণ্ডের কথা বলছিলেন; মনে হলো যেন বিজ্ঞানের মর্মার্থ বোঝানোর চেয়ে প্রডাক্ট উৎপাদনের কথা বলাতেই মনোযোগী। মানুষের কিসে সুবিধা হবে, কিসে লাভ হবে তার হিসাব দেখানোতে ব্যস্ত। আমি হতবাক হলাম এই ভেবে, বিজ্ঞানের আলোচনা কেমন করে বাণিজ্যিক আলোচনায় রূপ নিচ্ছে। এটাই কি আমাদের লক্ষ্য ছিল?

গবেষণার উদ্দেশ্য কি শুধু সুবিধা দেওয়া, বিজ্ঞানকে আত্তীকরণ করা নয়? এই প্রাযুক্তিক সুবিধা গত ২৫ বছরে যে পরিমাণ দেওয়া হয়েছে তা বিগত ৩০০ বছরে মানুষ চিন্তায়ও আনতে পারেনি। গড়ে ছয় ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চি আকৃতির মোবাইল নামের ছোট্ট যন্ত্রটি সুবিধার এক মহাসাগরে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে আমরা সবাই হাবুডুবু খাচ্ছি। সেই হাবুডুবুতে আমাদের সঙ্গে আমাদের সন্তানদের এক অচেনা ফারাক তৈরি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে দুটো ভিন্ন প্রজাতি একসঙ্গে বসবাস করছে। এক প্রজন্মেই কেউ কারো ভাষা বুঝতে পারছে না, এক অসহিষ্ণু, অনমনীয়, আক্রমণাত্মক মারাত্মক অভিঘাত তৈরি করেছে, কেমন যেন বহু প্রজন্মের বিভাজন মনে হলো। সহনশীলতা, সহমর্মিতা উধাও হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক পার্থক্য বেড়েই চলেছে।

এদিকে প্রযুক্তির উৎপাদন, আর তার ব্যবহার পরিবেশের যে দূষণ তৈরি করেছে তাতে শারীরিক ও মানসিক সবভাবেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

পরিণামে আমরা একটি কালচারাল ব্যাটল ফিল্ড বা সাংস্কৃতিক সংঘাতের মধ্যে প্রবেশ করেছি। যার সম্ভাবনা ষাটের দশক থেকে করা হচ্ছিল। এর পেছনে সাংস্কৃতিক সমন্বয় ছাড়া প্রাযুক্তিক উল্লম্ফন কাজ করছে। তৈরি করেছে প্রাযুক্তিক বয়সন্ধিকাল বা টেকনোলজিক্যাল অ্যাডলোসেন্স। যেটাকে বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা সবচেয়ে বড় বিপদ বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির চেয়েও বেশি। তারই প্রতিফলন দেখি ছয় মাস আগে ইউএস সিনেটে টেক জায়ান্টদের উপস্থিতির ঘটনাটি। সেখানে চার ঘণ্টা ধরে সিনেটররা টেক জায়ান্টদের জেরা করেছে। প্রযুক্তির এই কর্তাদের সামনে থেকে জেরা করার সুযোগ পাওয়া যে-সে ব্যাপার নয়। পরিস্থিতি কতটুক বিপন্ন অবস্থায় পড়লে এ রকম হয়। প্রাযুক্তিক কর্তাদের উপস্থিতির ঘটনাটিতে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে এ প্রজন্ম ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্বয়ং মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক জাকারবার্গ ক্ষমাও চেয়েছেন। ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের জাকারবার্গ সিনেটে উপস্থিত অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বলেছেন যে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কারো যাওয়া উচিত নয়।

উল্লেখ্য, জাকারবার্গ ও টিকটকের সিইও শাও জিচিউ স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে রাজি হলেও স্ন্যাপ, এক্স (আগের টুইটার) এবং ডিসকর্ডের প্রধানরা প্রাথমিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর সরকার সমনজারির মাধ্যমে তাদের এখানে আসতে বাধ্য করে। সিনেটে উপস্থিত পাঁচ প্রযুক্তি প্রধানের পেছনে বসে থাকা অভিভাবকদের চাপেই তারা এখানে এসেছেন। তাদের পরিবারগুলোর সন্তানরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের এ উদ্যোগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কন্টেন্টের কারণে তাদের সন্তানরা যৌন হয়রানি, প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে আরম্ভ করে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। প্রযুক্তি কর্তারা সিনেট-কক্ষে প্রবেশের সময় পরিবারগুলোকে তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছিল।

এই শুনানিতে, অনলাইনে নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা করার বিষয়টিই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। তবে এটা দুঃখজনক, এর বাইরে সিনেটররা এমন সব প্রশ্ন করেন তাতে মূল বিষয়টি অনেকখানি ফিকে হয়ে যায়। যেমন- বাইটডান্স নামক একটি চীনা কোম্পানির মালিকানাধীন টিকটকের সিইও শাও জি চিউকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ব্যবহারকারীদের তথ্য চীন সরকারকে দেয় কি না? উত্তরে তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক জানালেও  ইউএস সিনেটর টম কটন মি. চিউকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিলেন কি না। এটা থেকে বোঝা যায়, বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী সমাজের প্রতিনিধিরা বুঝে উঠতে পারছেন  না বা চাচ্ছেন না বিপদটার মাত্রা; বুঝলে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতেন না। তবে টিকটকের সিও শাও জি চিউ বলেন, তিনটি ছোট সন্তানের বাবা হিসেবে আমি বুঝতে পারছি যে আমরা আজ যে বিষয়টি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, তা ভয়ংকর এবং অনেক বাবা-মায়ের জন্য দুঃস্বপ্ন।

জোয়ান বোগার্ড নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘অনেক বাবা-মা ভাবতে পারেন যে আজ আমরা যে ক্ষতির কথা বলছি, তা তাদের পরিবারে কখনো প্রভাব ফেলবে না। একসময় আমিও এমনটা ভেবেছিলাম। আমার ছেলেও  টিকটকের একটি দম বন্ধ করে রাখার ট্রেন্ডে অংশগ্রহণ করেছিল। আমার ছেলে ম্যাসন মারা গিয়েছিল ২০১৯ সালের মে মাসে।’ আর্তুরো বেজার, একজন সাবেক সিনিয়র স্টাফ মেম্বার, যিনি ২০২৩ সালের নভেম্বরে কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তিনিও এই শুনানিতে ছিলেন। তার কথা থেকে বোঝা যায় যে কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদ পরিবেশের দায়িত্ব তাদের বাবা-মায়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে মেটা। অথচ তারা একটি বাটনও যুক্ত করেননি, যার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে পারবে। যদিও এই শুনানির সময় মেটা বলেছে, কিশোর-কিশোরীদের অনলাইনে নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার জন্য তারা ৩০টিরও বেশি টুলস এনেছে।

বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ঘটনাটি তুলে ধরলেও এই গ্লোবাল নিউজটিকে এক কলাম ছয় ইঞ্চির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এবং কোনো ফলোআপও ছিল না পরবর্তী দুই মাসে। এর মধ্যে বেশ কিছু গণমাধ্যম বিষয়টি আনেইনি বা হয়তো বুঝতেই পারেনি। কেন এ রকম হচ্ছে? ওপরের মতো ছোট ছোট অভিজ্ঞতা দিয়ে সমস্যা ব্যাপ্তি, মারাত্মক কতটা তা বোঝানো যায়। তাতে বিপদ থেকে একদম পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পৃথিবীব্যাপী সমাজ কাঠামোয় কমবেশি যে বিজ্ঞান সংস্কৃতি বিকাশ ঘটার প্রয়োজন ছিল সেটা হয়নি। 

খুবই আশ্চর্য আমেরিকায় ‘কিডস অনলাইন সেফটি অ্যাক্ট’ এখনো পাস করা হয়নি। আমাদের দেশে তো প্রশ্নই আসে না। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না ভোক্তা হওয়া ছাড়া, কিন্তু আমরা যদি জরিপকার্য চালাই তাহলে ক্ষতির পরিমাণ তাদের চেয়ে বেশি বই কম নয়। ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে প্রযুক্তির এই অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার দায়ী। এর উৎপাদনে প্রচুর খনিজদ্রব্য ব্যবহারে পরিবেশ দূষণ এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শারীরিক ও মানসিক দূষণ তৈরি করছে, তার কোনো হিসাব নেই। বিজ্ঞানের মর্মার্থকে অনুধাবন করতে পারলে পরিবেশ রক্ষায় আমরা অধিকতর সচেতন হতে পারতাম। একটি সাইকেল বা মোটর বাইক চালানোর আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ক্যামেরা চালানোতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কিন্তু মোবাইল চালানোর আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। অথচ কী নেই এর ভেতর, বলতে গেলে আমাদের জীবনটাকেই নিয়ন্ত্রণ করছে এখন। 

এটিতে যেমন ছোটদের কনটেন্ট রয়েছে তেমন বড়দের বিষয় রয়েছে, রয়েছে পর্ণ। কিন্তু মানুষের পরিপক্বতা যাচাই না করে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ না দিয়ে শুধু বাণিজ্যিক লাভে ও লোভে এ ধরনের প্রযুক্তি মানুষের হাতে দেওয়া হয়েছে। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতির কথা ভাবছি, কিন্তু তাদের উন্নতির জন্য কী করা দরকার তা নিয়ে ভাবছি না। 

কিন্তু প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করার অভাব এসব বোঝাপড়াকে এগোতে দিচ্ছে না। বিজ্ঞানের কথাগুলো শিক্ষার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতে পারলে সুস্থ, সম্ভাবনাময়  প্রজন্মের আশা জাগে। শিক্ষা মানে জীবনকে মহাবৈশ্বিক দৃষ্টিতে দেখার প্রণোদনা, শিক্ষা মানে হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের মমতা, শিক্ষা মানে হচ্ছে বৈচিত্র্যময় বিশাল কর্মক্ষেত্র। যেখানে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। তারই প্রতিফলন আজকের পৃথিবীতে দেখার কথা ছিল। কিন্তু শিক্ষায় কখনো এ কথাগুলো সেভাবে বলা হয়নি বা বলতে দেওয়া হয়নি। সবকিছু নেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো অর্থে। বিজ্ঞান সব সময় দেখিয়েছে বিশ্বজগতের সবকিছু কী প্রবলভাবে সম্পর্কযুক্ত। আর আমরা মানুষ নিয়েছি কৌশলগত ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা, অর্থাৎ বিজনেস অ্যান্ড প্রফিট; যা আজকে পৃথিবীর এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিজ্ঞান ও মানবিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে না পারলে এক মর্মান্তিক পৃথিবীর দিকে আমরা যাচ্ছি। 

লেখক : বিজ্ঞান বক্তা, সম্পাদক, মহাবৃত্ত (বিজ্ঞান সাময়িকী)

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫