Logo
×

Follow Us

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মহাজাগতিক ভাষা

Icon

আসিফ

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১৫:০৩

মহাজাগতিক ভাষা

পৃথিবী থেকে বহির্জগতে পাঠানো কিছু বার্তার প্রতিরূপ।

মানুষের মস্তিষ্ক জন্মলগ্ন থেকেই গণিতের জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত থাকে। এদিকে বার্কলের দুজন বিজ্ঞানী জর্জ ল্যাকফ ও রাফায়েল নুনেজ দাবি করেছেন, এমনকি সবচেয়ে বিমূর্ত ধারণাগুলোও জন্ম নেয় নিত্যদিনের সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে। মানবদেহ ও পারিপার্শ্বিক জগতের মিথষ্ক্রিয়ার ধরন-ধারণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এসব বিমূর্ত ধারণা। গণিতের আদিনিবাস মস্তিষ্কের ইনফিরিওর প্যারিটাল কর্টেক্স, যেখানে দেখাশোনা ও ছোঁয়ার অনুভূতিগুলো একত্রিত হয়। মস্তিষ্কের এ অংশটি আবার ভাষাপ্রক্রিয়ার সঙ্গেও জড়িত। গণিতও এক ধরনের ভাষা, যা সংখ্যার সাহায্যে স্থানকে সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপনে সক্ষম। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইনফিরিওর প্যারিটাল কর্টেক্স হাতের দক্ষতার জন্যও দায়ী। গণিতের শুরুটাও হাতের আঙুলের গোনাগুনির মধ্য দিয়ে। ভাষাগত সামর্থ্য বা হাতের নৈপুণ্যের সঙ্গে সঙ্গে সাংখ্যিক ধারণাবলিও জীবনধারণের তাগিদেই মানুষকে ধীরে ধীরে আয়ত্ত করতে হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ল্যাকফ ও রাফায়েল নুনেজ মনে করছেন, মানবদেহ ভৌতজগতের সাংখ্যিক ধারণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির ওপর মানুষের যে দুর্বলতা দেখা যায় তার কারণ হলো হাত ও পায়ের উভয়ের রয়েছে ১০টি করে আঙুল। সংখ্যার এই অন্তর্নিহিত বোধকে মানুষ পারিপার্শ্বিক জগতের ওপর প্রয়োগ করতে শুরু করে। একসময় সে আবিষ্কার করে একেকটি আঙুলের বিকল্প হিসেবে পাথরের টুকরোকেও গণনা করা যেতে পারে। এভাবেই আরো অনেক কিছুতেই এই ধারণা প্রয়োগ করা হয়। 

কিন্তু তার পরও অনেক গণিতবিদের মতে, শুধু বিবর্তনের সাহায্যে গণিতের বিস্ময়কর কার্যকারিতাকে সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। কেন মহাবিশ্বের মৌলিক ধারণাগুলোর ক্ষেত্রে এটা নিখুঁতভাবে কাজ করছে। জৈবিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন তার কারণ দর্শাতে পারে না। এ প্রসঙ্গে অ্যাডেলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল ডেভিস বলেছেন, নিউটনের সমীকরণগুলো দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের দৃষ্টি থেকে তেমন মূল্যবান কিছু নয়। কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের ক্ষেত্রে এ কথা আরো বেশি প্রযোজ্য। অনেকের কাছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অত্যন্ত দুর্বোধ্য বলেই তাদের এটা মনে হয়। অর্থাৎ জীবিকানির্বাহে আপাতদৃষ্টিতে এটা কাজে লাগে না, তাই তারা এটা বুঝতেও অক্ষম। জগতের ব্যাখ্যায় গণিত যে কেমন করে এত নিখুঁত ও কার্যকর হয়ে উঠতে পারল, সেটা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। জাগতিক প্রক্রিয়াগুলোর সঙ্গে মানব মনের যে অপার্থিব ঐকতানের মতো একটা ব্যাপার লক্ষ করা যায়, সেটা প্রকটিত গণিতের ক্ষেত্রে। এ রকমই লিখেছেন তিনি তার ‘দ্য মাইন্ড অব গড’ বইটিতে। কারো কারো মতে, এ রহস্যের চূড়ান্ত সমাধান হবে তখনই যখন ভিনগ্রহের মানুষের মুখোমুখি হবে। গণিত যদি সত্যি শাশ্বত ও সর্বজনীন একটা ব্যাপার হয়, তাহলে ওই বহির্জাগতিকরা আমাদের গাণিতিক ধারণাগুলোকে বুঝতে পারবে। 

পল ডেভিস অবশ্য প্রশ্ন রেখেছেন, আমরা যদি বহির্জাগতিকদের গণিত বুঝতে না পারি, তা হলে কি বলব এটা সর্বজনীন নয়? এমনও হতে পারে বহির্জাগতিকরা গণিতে অনেক বেশি উন্নত হওয়ায় ওটা আমাদের কাছে অবোধ্য মনে হবে। আধুনিক যুগের ক্যালকুলাস, টপোলজির সামনে পড়লে প্রাচীনকালের গণিতবিদদের কিছুটা অসুবিধে হতো। তবে নির্দেশনা ও সময় দিলে তিনি হয়তো ঠিকই বুঝে উঠতেন। 

অন্যদিকে বহির্জাগতিকরা ও মানুষের গণিত একই রকম হলেও প্লেটোবাদীদের কথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হবে না। ডি হ্যানি যেমন বলেছেন, বহির্জাগতিকদের পরিবেশ যদি আমাদের জগতের মতোই হয় তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বহির্জাগতিকদের ধারণাবলি যেভাবে ওদের মস্তিষ্কে গড়ে উঠবে তা আমাদের ধারণার অনুরূপ হবে। ফলে দুই পক্ষের গণিতশাস্ত্রে প্রচুর সাদৃশ্য থাকবে। কিন্তু ওদের জগৎ আমাদের থেকে একেবারেই অন্যরকম হলে গণিতের চেহারাও হবে অন্যরকম। কিন্তু যেহেতু বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো অন্য জায়গায়ও একই রকম আমরা ভাবছি। সে ক্ষেত্রে গণিতের কোনো বিচ্যুতি আমরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাহায্যে ধরতে পারব। ধীরে ধীরে হয়তো তাদের গাণিতিক জগৎ এবং সাংখ্যিক গঠনের প্রকৃতিটা আমরা বুঝতে পারব।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিজ্ঞানীরা বহির্জাগতিকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গণিত ও গাণিতিক যুক্তি এবং বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে কয়েকটি ভাষা ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। এদের একটি হলো অ্যাস্ট্রগোসা (astraglossa)। ১৯৬৩ সালে ল্যান্সেলট হগব্যান এই ভাষা ব্যবস্থাটি উপস্থাপন করেন। এই ব্যবস্থায় পর্যায়ক্রমিকভাবে সংখ্যা এবং চিহ্নের সারি ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে স্বল্প পর্যায় দিয়ে সংখ্যা আর দীর্ঘ পর্যায় দিয়ে গাণিতিক চিহ্ন (+ - গুণ, ভাগ) বোঝানো হয়েছে।

আরেকটি ভাষা ব্যবস্থার লিঙ্গুয়া কসমিকা (Lingua cosmica)। সংক্ষেপে লিনকস (Lincos)। ১৯৬০ সালে হ্যান্স ফ্রডেন্থাল এ ভাষা উদ্ভাবন করেন। এ ভাষা অ্যাস্ট্রগ্লোসার আরেক রূপ। লিনকস তৈরি হয়েছে মহাজাগতিক যোগাযোগ ও আলোচনার জন্য। এতে মৌলিক গণিত আর লজিক সিম্বল ব্যবহার করা হয়েছে। এ ভাষা কার্ল সাগান তার কল্পবিজ্ঞান কন্ট্যাক্ট এবং এর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন।

অ্যাস্ট্রগ্লোসা ও লিনকসের ওপর ভিত্তি করে ১৯৯২ সালে আরেকটা ভাষা ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন কার্ল ডেভিটো ও রিচার্ড অয়ার্ল। তবে এ ব্যবস্থার শব্দগুলোকে সমৃদ্ধ করতে তারা বিজ্ঞানের মূলনীতি এবং পদার্থের ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যবহার করেছেন। 

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫