Logo
×

Follow Us

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বাংলাদেশে স্টারলিংক: স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদানকারীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

Icon

আদিল ইলাহি

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০১

বাংলাদেশে স্টারলিংক: স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদানকারীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

যুক্তরাষ্ট্রের টেলিকম জায়ান্ট স্টারলিংকের লোগো। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সরকার ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরতা ক্রমাগত বাড়ছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে উচ্চগতির, নিরবচ্ছিন্ন এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ এখন আর বিলাসিতা নয়, মৌলিক প্রয়োজনের অংশ হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইলন মাস্কের স্পেস এক্সের ‘স্টারলিংক’ বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে, যা দেশে ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইওউঅ) স্টারলিংককে দেশে কাজ করার অনুমোদন দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এরই মধ্যে স্টারলিংকের বাণিজ্যিক সেবা ৯০ দিনের মধ্যে চালুর নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে যেমন সম্ভাবনার দরজা খুলছে, তেমনি এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে দেশের ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। 

স্টারলিংক: প্রযুক্তির এক নতুন মাত্রা

স্টারলিংক মূলত পৃথিবীর কক্ষপথে হাজারের ওপর স্যাটেলাইট বসিয়ে একটি জালের মতো কাভারেজ তৈরি করেছে, যা সরাসরি গ্রাহকের ঘরে ইনস্টল করা একটি ছোট ডিশের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করে। এটি ভূ-ভিত্তিক ফাইবার অপটিক বা মোবাইল টাওয়ারের ওপর নির্ভরশীল নয়। ফলে দেশের যে এলাকা এখনো ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রাম, চরাঞ্চল, দ্বীপাঞ্চল বা সীমান্তবর্তী গ্রাম, সেখানেও এই সেবা পৌঁছানো সম্ভব হবে। উন্নত দেশগুলোতে স্টারলিংকের কার্যকারিতা প্রমাণিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন বা আফ্রিকার রুক্ষ অঞ্চলগুলোতেও স্টারলিংক নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশে স্টারলিংকের আগমন নিঃসন্দেহে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের বার্তা।

স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদাতাদের কী হবে

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় এক হাজার ২০০-এর বেশি আইএসপি (ISP) কোম্পানি রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক। যারা মোবাইল ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে থাকে, এদের একটি বৃহৎ অংশের ব্যবসা নগরভিত্তিক এবং ইন্টারনেট কাঠামো নির্মাণে ফাইবার অপটিক ও ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। স্টারলিংক যদি সরাসরি গ্রাহকের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়, তাহলে এই মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। বিশেষ করে যারা শুধু ‘ইন্টারনেট সংযোগ’ প্রদান করে, তারা চাপে পড়তে পারে। বড় প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি টিকে থাকতে পারবে এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মুখে?

সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ও টিকে থাকার কৌশল

এমন বাস্তবতায় আতঙ্কে না ভুগে বরং প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা, কৌশলগত পরিবর্তন ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে কয়েকটি সম্ভাব্য পথ খোলা রয়েছে। যেমন-

১. সেবার বৈচিত্র্য আনয়ন

শুধু ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করে টিকে থাকা এখন আর সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ডিজিটাল সার্ভিস প্রোভাইডার’ হিসেবে নিজেদের পুনর্গঠিত করতে হবে। যেমন- আইপি টিভি, ক্লাউড স্টোরেজ, স্মার্ট হোম সল্যুশন, নিরাপত্তা সেবা, গেইমিং প্যাকেজ ইত্যাদি সেবা যুক্ত করতে হবে।

২. গ্রাহকসেবায় নজর দেওয়া

স্থানীয় আইএসপির সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে গ্রাহকের কাছে সরাসরি পৌঁছানোর সুবিধা। দ্রুত সমস্যা সমাধান, স্থানীয় ভাষায় হেল্পলাইন, ডোরস্টেপ সার্ভিস- এই সুবিধাগুলো স্টারলিংক দিতে পারবে না। তাই গ্রাহকসেবায় বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।

৩. মূল্য প্রতিযোগিতা ও বান্ডেল অফার

স্টারলিংকের দাম অনেক বেশি (বর্তমানে বিভিন্ন দেশে মাসে ১০০ থেকে ১২০ ডলার)। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কোম্পানিগুলো তুলনামূলক সাশ্রয়ী ও কাস্টমাইজড প্যাকেজের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।

৪. স্টারলিংকের সঙ্গে সহযোগিতা

প্রতিযোগিতা সব সময় সরাসরি মোকাবিলা নয়, কখনো কখনো সহযোগিতামূলক প্রতিযোগিতাও একটি কৌশল হতে পারে। স্টারলিংকের স্থানীয় পার্টনার বা ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে স্থানীয় কোম্পানিগুলো নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে।

৫. নীতিনির্ধারকদের কাছে সোচ্চার হওয়া

সরকার ও বিটিআরসি যেন দেশের স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সুরক্ষা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে, সে জন্য একটি সম্মিলিত কণ্ঠস্বর জরুরি। প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট রেগুলেশন তৈরি করে স্টারলিংককে স্থানীয় গেটওয়ে বা ওওএ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করাও ভাবা যেতে পারে।

স্টারলিংকের আগমন ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে এই অগ্রগতির ছায়ায় যদি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঝরে পড়ে, তবে তা দেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে। স্থানীয় কোম্পানিগুলো দেশের তরুণ উদ্যোক্তা, কর্মসংস্থান এবং লোকাল ইকোসিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এখন সময় এসেছে ভিন্নভাবে ভাবার। প্রযুক্তির পরিবর্তন যেমন বাস্তবতা, তেমনি টিকে থাকার জন্য নিজেকে বদলানোও বাস্তবতা। স্টারলিংকের এই আগমন যেন হয় একটি নতুন সূচনা। বিনাশ নয়, হোক নবজাগরণ।

লেখক : শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫