মোবাইল নেটওয়ার্কের মানোন্নয়ন আটকে ‘নিলাম জটিলতায়’

ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ১৪:৪৪

বিটিআরসি’র লোগো
বাংলাদেশে মোবাইল নেটওয়ার্কের মানোন্নয়নে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে বিবেচিত ৭০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্যান্ডে নিলামের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি। তবে এই তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক জটিলতা, যা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিলাম আয়োজনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা ও নীতিগত জটিলতা-দুইয়ের সংঘাতে আটকে গেছে নেটওয়ার্ক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ এ ধাপ।
আগামী জুনের মধ্যে এই তরঙ্গ নিলামের পরিকল্পনা রয়েছে বিটিআরসির। ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের বৈশিষ্ট্য হলো এটি কম শক্তি ব্যবহার করে বিস্তৃত এলাকায় কার্যকর নেটওয়ার্ক কাভারেজ দিতে সক্ষম। দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কারণে এই ব্যান্ড ভবনের ভেতরে প্রবেশে সহজ, ফলে শহর ও নগর এলাকায় ঘরের মধ্যে ভালো নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে পারে।
তবে মোবাইল অপারেটররা বলছে, তরঙ্গের উচ্চ মূল্য, সীমিত তরঙ্গ বরাদ্দ এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ এই নিলাম নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। সেজন্য নিলামের শর্ত ও সময়সূচি পুনর্বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা। এর পাশাপাশি তরঙ্গের পরিমাণ, মূল্য নির্ধারণ ও বাজারের বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহর এলাকায় নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধানে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড অত্যন্ত কার্যকর। তাই দ্রুত এই তরঙ্গ বরাদ্দ হওয়া উচিত।
তরঙ্গের উচ্চমূল্য শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের ওপরই চাপ সৃষ্টি করে জানিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের বিনিয়োগকারীরা স্বচ্ছ, যৌক্তিক ও বাজার উপযোগী তরঙ্গমূল্য নির্ধারণ ও তরঙ্গকে একটি জাতীয় সম্পদ হিসেবে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছেন।
বিটিআরসি প্রাথমিকভাবে প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের ভিত্তিমূল্য ২৬৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে, যার ওপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাটসহ মূল্য দাঁড়ায় ২৮৩ কোটি টাকা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তরঙ্গ মূল্য পরিশোধে ১০টি কিস্তির সুবিধা দিচ্ছে।
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক রাশেদ মেহেদী বলেন, “৭০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ নিলামের ভিত্তিমূল্য ২৬৩ কোটি ধরা হয়েছে, যা অনেক ব্যয়বহুল।
“যন্ত্রাংশগুলো বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে আনতে হয়, তাই এটি বিশ্বব্যাপীই ব্যয়বহুল। সেই সঙ্গে আমাদের দেশে ভিত্তিমূল্য অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অপারেটরদের ব্যয় বহনযোগ্য নয়।”
৭০০ মেগাহার্টজের ইকোসিস্টেম অনেক ব্যয়বহুল উল্লেখ করে রাশেদ মেহেদী বলেন, “এই যন্ত্রাংশগুলো বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে আনতে হয়, তাই সারাবিশ্বেই এই মেগাহার্টজ ব্যয়বহুল।”
রাশেদ মেহেদী মনে করেন, যদি আগেই তরঙ্গের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কোয়ালিটি সেবাতে গুরুত্ব দেবে না অপারেটররা। তাই তরঙ্গের দাম অনেক কমানো উচিত।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের কাছে চিঠি দিয়েছে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের মূল বিনিয়োগকারীরা। চিঠির অনুলিপি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিটিআরসি চেয়ারম্যানের কাছেও পাঠানো হয়।
চিঠিতে অপারেটররা বর্তমানে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের মোট ৪৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গের মধ্যে শুধুমাত্র ২৫ মেগাহার্টজ বরাদ্দের পরিকল্পনাকে অপ্রতুল উল্লেখ করে নিলাম পিছিয়ে দিয়ে পুরো ৪৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ একসঙ্গে বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, মূল্যপ্রতি মেগাহার্টজ ২৬৩ কোটি টাকা (৭.৫ শতাংশ ভ্যাটসহ ২৮৩ কোটি টাকা) আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক বেশি।
বিনিয়োগকারীদের মতে, এই মূল্য নেটওয়ার্ক অপারেটরদের জন্য ব্যয় ১৪ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে। অথচ বর্তমানে এই ব্যয় ৯ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত। এটি বাজারের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করতে পারে।
অপারেটররা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র ৫০ শতংশ ফোরজি সক্ষম ডিভাইস ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে কাজ করতে পারে। তাই এই ব্যান্ডের সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।
জটিলতা কোথায়
২০০৭ সালের মার্চে অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি আইএসপিকে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে তরঙ্গ বরাদ্দ দেয় বিটিআরসি। তখন ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশনের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের (আইটিইউ) এই ব্যান্ডের তরঙ্গ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
পরবর্তীতে একই বছরের নভেম্বরে বিশ্ব রেডিও কমিউনিকেশ কনফারেন্সে এই তরঙ্গ ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশনের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিটিআরসি অলওয়েজ অন নেটওয়ার্কের পক্ষে দেওয়া তরঙ্গ বাতিল করে।
বিষয়টি নিয়ে অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক উচ্চ আদালতের মামলা করে। মামলাটিতে হেরে যাওয়ার পর বিটিআরসি রায়ের বিপক্ষে আপিল করে। তখন থেকে মামলাটি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। যার ফলে বিটিআরসি এই মুহূর্তে এই ব্যান্ডের ৪৫ মেগাহার্টজের ২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ নিলাম করা থেকে বিরত রয়েছে। আর সে কারণেই জটিলতা বেড়েছে।