ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন: বিবর্তনের ইতিহাস

আজিজুল হক অভি
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২০, ০৮:৩৯

ছবি: দ্য ফ্যাক্ট সাইট।
ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন, আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি এই ইঞ্জিনের সঙ্গে পরিচিত। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত এই ইঞ্জিন ব্যবহার করে থাকি। যাবতীয় স্থলযান, মহাকাশযান, শক্তি উৎপন্নকারী যন্ত্রসমূহে এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ ভাষায় বলা যায়, ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন হলো এমন একটি তাপীয় ইঞ্জিন, যেখানে দহন- ক্রিয়ার মাধ্যমে একই প্রকোষ্ঠে তাপ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রুপান্তরিত করা হয়। জ্বালানি প্রয়োগে যান্ত্রিক শক্তির উৎপাদনের উদ্দেশ্যেই ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন তৈরি করা হয়।
ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিনকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে বৈপ্লবিক আবিষ্কার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন ব্যবহার করে থাকলেও হয়তো অনেকেই জানি না এর আবিষ্কার এবং বিবর্তনের ইতিহাস। হয়তো জানি না একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক সমৃদ্ধির সঙ্গে যে যন্ত্রটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন কি করে কালক্রমে আজকের এই যন্ত্রের রূপ ধারণ করেছে।
১৮৫৯ সালের আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানের ইতিহাসে সফলজনকভাবে কোনো ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়নি। ১৮৫৯ সালে সর্বপ্রথম বিক্রয়যোগ্য ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়। ওই বছর ফরাসি প্রকৌশলী জে. জে. এটিয়েন লেনর একটি স্পার্ক ইগ্নিশন ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন যা ছিল অনবরত চলনক্ষম একটি ইঞ্জিন, সে সময়ে এতে জ্বালানি হিসেবে বাতাসের সঙ্গে কোল-গ্যাস বা কয়লার বাষ্প ব্যবহার করা হতো। লেনরের আবিষ্কৃত এই ইঞ্জিনটি ছিল ২-স্ট্রোকবিশিষ্ট।
এর তাপীয় দক্ষতা ছিল ৫ শতাংশ। এই ইঞ্জিনটি আবিষ্কারের পর তিনি ১৮৬০-৬৫ সালের মধ্যে ৫ হাজার ইঞ্জিন বিক্রয় করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে ১৮৬৭ সালে জার্মান ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা নিকোলাস এ. অট্টো এবং জার্মান প্রকৌশলী ইউগেন লেনজেন, যৌথভাবে লেনরের ইঞ্জিনটির উন্নয়ন সাধনে তৎপর হন, এবং ইঞ্জিনের তাপীয় দক্ষতা ৫ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশে উন্নীত করেন। এই ইঞ্জিনে তখনকার দিনে অগ্নি প্রজ্বালনের জন্য গ্যাসীয় শিখা ব্যবহার করা হতো। অটো ও লেনজেন কর্তৃক উন্নীত এই ইঞ্জিনটির ৫০০০ পিস সেই সময়ে বিক্রি হয়েছিল।
অন্যদিকে, ১৮৬২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী আলফোনস রোচেস প্রথমবারের মতোন একটি চার স্ট্রোক বিশিষ্ট ইঞ্জিন পেটেন্ট করলেও, পরবর্তীতে তা আর আবিষ্কৃত হয়নি। ১৮৭৬ সালে নিকোলাস অট্টো সার্থকভাবে চার স্ট্রোকবিশিষ্ট একটি ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন। যা ‘অট্টো সাইকেল’ নামে সমাদৃত হয়। কারণ, এই ইঞ্জিনে চার স্ট্রোকবিশিষ্ট প্রতিটি চক্রে মাত্র একবার অগ্নি সংযোগ করা হতো। অট্টো এই ইঞ্জিনের তাপীয় দক্ষতা ১১ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশে উন্নীত করেন, এবং ইঞ্জিনের ওজন ১৮০০ কেজি হতে কমিয়ে ৫৭০ কেজিতে নিয়ে আসেন।
১৮৯০ সালের মধ্যে তিনি প্রায় ৫০,০০০ ইঞ্জিন বিক্রয় করেন। ১৮৭৬ সালে স্যার ডুগ্যালড ক্লার্ক ২- স্ট্রোকবিশিষ্ট ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন যা বর্তমানেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জর্জ ব্যাটন নামক এক আমেরিকান প্রকৌশলীও একই সময়ে ২-স্ট্রোকবিশিষ্ট কেরোসিনচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন, কিন্তু তাঁর আবিষ্কৃত এই ইঞ্জিন বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পায়নি এর বৃহদাকৃতি এবং ধীরগতির জন্যে। বর্তমানে যে গ্যাসোলিন চালিত ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয় এর আদিরূপ আবিষ্কৃত হয় ১৮৮৫ সালে এবং তা আবিষ্কার করেন গটলিব ডেমলার, যা ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন। এ ইঞ্জিনের মধ্যে উলম্বাকৃতির সিলিন্ডার ছিল যাতে কারবুরেটর দ্বারা গ্যাসোলিন প্রবেশ করানো হতো। ১৮৮৯ সালে ডেমলার ৪-স্ট্রোকবিশিষ্ট ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিনের কিছুটা পরিবর্তন সাধন করেন এবং আধুনিককালে যে পেট্রোল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে তার বেশিরভাগই এই ডেমলার ইঞ্জিন।
ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিনের আবিষ্কার আঠারশো শতকের শিল্প ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন কল্পনাতীত। কারণ, প্রতিনিয়ত আমরা যে সকল যন্ত্রাদি ব্যবহার করে থাকি সে সকল যন্ত্র চালনায় যে শক্তি প্রয়োজন, এই ইঞ্জিন জ্বালানির মাধ্যমে সেই সকল শক্তি উৎপন্ন করে থাকে। ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিনের মতো কালজয়ী আবিষ্কার নিশ্চিতরূপে আমাদের যোগাযোগ মাধ্যম, দৈনন্দিন জীবন, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র, শক্তি উৎপন্নকারী প্রতিষ্ঠান, মহাকাশ খাত- এক কথায় সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তাই বর্তমান বিশ্বে যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়গান সেখানে ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিনের অন্য কোন পরিপূরক নেই।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনাল কম্বাশ্চান ইঞ্জিন ফান্ডামেন্টালস, জন বি. হিউড, প্রফেসর অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিরেক্টর অব স্লোন অটো মোটিভ ল্যাবরেটরি, ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি।