২০২০: ডিজিটাল দেশে প্রযুক্তির বৈষম্য

কে এম ওবায়দুল্লাহ
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫২

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাসের ধাক্কায় বদলে গেছে চেনা জগতের অনেক কিছুই। হঠাৎই সভ্যতার মুখে মুখোশ পরিয়ে, অর্থনীতির পায়ে বেড়ি এঁটে ঘরে ঢুকে পড়ে পুরো বিশ্ব। আর আমাদের অভিধানে উজ্জ্বল হয়ে উঠল- লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, অনলাইন ক্লাস, মাস্ক, অক্সিমিটার, স্যানিটাইজারের মতো শব্দগুলো।
যুক্ত হলো কভিড-১৯। জীবনে নেমে এলো বিধিনিষেধ, নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন; যা আমাদের নিজস্ব নয়। ঘরবন্দি মানুষের যোগাযোগ রক্ষায় বেড়ে যায় বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার। উৎপাদন শিল্পসহ বহু ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল বা অনলাইন ব্যবস্থায় চলে সব কাজ। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে শিক্ষার ক্ষেত্রে। ক্লাস থেকে পরীক্ষা- সবই চলছে অনলাইনে।
করোনাভাইরাস-পরবর্তী সময়েও সমাজ ও পেশার ক্ষেত্রে বড় প্রযুক্তিগত রদবদল আসতে চলেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাই আলোচনা চলছে- শারীরিক দূরত্ববিধির এই ‘নতুন স্বাভাবিক’ সময়ে জীবনযাপন ও কাজের ধরন কি পুরোপুরিই ভার্চুয়াল বা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যাবে? তা-ই যদি হয়, কতটুকু প্রস্তুত আমাদের দেশ?
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণাটি বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। সরকারে আসার পর দলটি ‘ভিশন ২০২১’-এর মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ও সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আরো পরে ২০১৮ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অন্যতম কৌশল হিসেবে সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের বিষয়টি উঠে আসে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়।
দীর্ঘ এই সময়ে বেশ কিছু অগ্রগতি ও অর্জন এসেছে। দুর্গম অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবাসহ আধুনিক প্রযুক্তির সব সুবিধা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে উৎক্ষেপণ করা হয় নিজস্ব স্যাটেলাইটও। কিন্তু করোনাভাইরাস যেমন বিভিন্ন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে, একইভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাকেও সামনে এনেছে।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জিকরুল আহসান শাওন বলেন, ‘সীমাবদ্ধতা আছে, সমালোচনাও থাকবে। তারপরও স্বীকার করতে হবে, গত একদশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া সত্যিই গর্বের। তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশ এ অবস্থানে না থাকলে মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা বর্তমানে নিঃসন্দেহে আরো অনেক বেশি কঠিন হতো।’
দীক্ষাহীন শিক্ষা
একদিকে, স্কুল খুললে সংক্রমণের আশঙ্কা। অন্যদিকে, স্কুলে না যাওয়ার একাধিক নেতিবাচক ফল। দুইয়ের মাঝে দোদুল্যমান দেশের অগণিত ছেলেমেয়ের শিক্ষার ভবিষ্যৎ। অভিভাবকরাও এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এমন এক আতঙ্কের আবহে গুছিয়ে ভাববার মতো অবস্থাও থাকে না। তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন- শিক্ষা বড়, না জীবন?
এ পর্যায়ে কোনো ঝুঁকিই নিতে চায়নি সরকার। তাই বছর শেষ হলেও খুলে দেয়া হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আপাতত পড়াশোনা হোক ঘরে থেকেই। সেক্ষেত্রেও উদ্যোগ কম নেওয়া হয়নি। ঢাকার স্কুলে অনলাইনে শিক্ষাদান করা হচ্ছে সরাসরি; কিন্তু রাজধানীর বাইরে যেখানে ইন্টারনেট আছে সেখানে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে রেকর্ড ক্লাস।
এর বাইরে মূলত সংসদ টিভিতে তৃতীয় থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠদান করা হয়। অনেক স্কুল আবার নিজেদের ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিনের ক্লাসগুলো আপলোড করে দিচ্ছে। যদিও এর মধ্যে অল্প একটি অংশই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। আর টিভি দেখার সুযোগ আছে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর। অর্থাৎ, এখনো বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুহাম্মদ মনসুরুল আলমও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি ঠিক যে অনেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। তবে এখানে সামর্থ্যরে বিষয় জড়িত। তাই আমরা অনেকগুলো বিকল্প নিয়ে কাজ করছি।’
বর্তমানে দেশের ৫৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নেই। পাশাপাশি গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৫৯ শতাংশের স্মার্টফোন ও ৪৯ শতাংশের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নেই।
আমরা কোন পথে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূলত দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, যাদের প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস বা সংযোগ নেই বা সেবা গ্রহণের জন্য তথ্য ও দক্ষতা নেই; তারা এই সেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, বর্তমানে দেশের ৫৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নেই। পাশাপাশি গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৫৯ শতাংশের স্মার্টফোন ও ৪৯ শতাংশের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ; একই সঙ্গে সেবাগুলোর সহজীকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতাও প্রয়োজনীয়। এ দুই ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ব্যাপক ঘাটতি। এই গবেষণা থেকেই বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশগম্যতা নিয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। আবার তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে দেশে এলাকা ও লিঙ্গ বিবেচনায়ও বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য উঠে এসেছে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও সানেমের পরিচালিত এক গবেষণায়।
ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে ৭৮ শতাংশ যুবকের বিপরীতে মাত্র ৪২ শতাংশ তরুণীর মোবাইল ফোন আছে। নিম্ন আয়ের তরুণীদের মধ্যে এই হার মাত্র ২৭ শতাংশ, যেখানে যুবকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে ময়মনসিংহ, সিলেট ও রংপুর অঞ্চল সামগ্রিকভাবেই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে অনেকটা পিছিয়ে। আবার গ্লোবাল হাউসহোল্ড ডাটা ইন্ডিকেটর ২০১৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ৬ শতাংশ পরিবারে কম্পিউটার আছে। অথচ ভারতে এই হার ১৭ ও ভিয়েতনামে ৩৩ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশে মাত্র ১৮.২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে; যেখানে ভারতে তা ২৯.৫, শ্রীলঙ্কায় ৩২ ও ভিয়েতনামে ৪৭ শতাংশ।
সাজ দেখেই আওয়াজ
করোনাকালে ই-কমার্স মাধ্যমে কেনাকাটা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সভা, সেমিনারসহ সংবাদ সম্মেলন সবই হতে থাকে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে। প্রথমবারের মতো সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকও হয় অনলাইনে। ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম, টেলিমেডিসিন সেবাসহ বিভিন্ন অনলাইন সেবায় অভ্যস্ত হয় মানুষ। আর এই সময়ে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ৫০ লাখ। এই সব কিছুরই ব্যাকবোন হলো- ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক। বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের এ মেরুদণ্ড কতটুকু শক্তিশালী?
ওকলার স্পিড টেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে শুধু আফগানিস্তান আছে বাংলাদেশের পরে। পাকিস্তান, নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কাও আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে মোবাইল ডাটার ডাউনলোড গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে ১০.৭৬ মেগাবাইট (এমবিপিএস)। যেখানে বিশ্বে গড় গতি ৩৫.২৬ এমবিপিএস। তবে ব্রডব্র্যান্ডের গতির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৫টি দেশের মধ্যে ৯৮তম। এ ক্ষেত্রে অবশ্য নেপাল ও পাকিস্তান আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও, ভারত অনেকটাই এগিয়ে।
তবে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের দাবি, ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নত বিশ্বের চেয়ে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। মহামারির এ সময়ে উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও অনলাইনে সভা, সেমিনার, অফিস, স্কুল-কলেজের ক্লাস সবই চলছে। এ সময়ে অনলাইন নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় ব্যান্ডউইথের চাহিদাও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের কোনো সংকট হয়নি। কারণ ভবিষ্যৎকে বিবেচনায় নিয়ে ২০১৭ সালেই দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।’
তিনি বলেন, ‘সামনে ইন্টারনেটের চাহিদা আরো বাড়বে, এজন্য বাংলাদেশ তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা হয়েছে। ফোরজি প্রযুক্তি চালু হয়েছে। এখন ফাইভজির জন্য প্রস্তুতি চলছে।’