
ছবি: সংগৃহীত
শূন্য কোথা থেকে এলো, তা জানার জন্য কৌতূহল সকলের মধ্যে অত্যন্ত স্বাভাবিক। গণিতে শূন্য ও দশমিক পদ্ধতি আবিষ্কার প্রসঙ্গে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ লাপলাস বলেছেন, দশটি প্রতীকের সাহায্যে গণনা করার এরকম অসাধারণ পদ্ধতি ভারতবর্ষ আমাদের দিয়েছিল; প্রত্যেক প্রতীকে আরোপ করা হয় একটি স্থানীয় মান ও পরম মান। এটি একটি সুদূরপ্রসারী ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, অথচ এই ধারণাটিকে এতটা সহজ মনে হয় যে, প্রকৃত তাৎপর্য লক্ষ্য করা হয় না।
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর প্রথম দিকে শূন্য ও দশমিক পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, কে কোথায়, কীভাবে এ আবিষ্কারটি করেছিলেন তার কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অবশ্য এই দুটি আবিষ্কার যে ভারতীয় হিন্দুরা করেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু এ আবিষ্কারগুলো ঠিক কী ধরনের সমস্যাকে কেন্দ্র করে ঘটেছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা অসম্ভব। তবে প্রাচীন ভারতীয় শিলালিপি, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, প্রাচীন ভারতীয় কাব্য, সাহিত্য, দর্শনের বই থেকে মনে হয় আবিষ্কারটি খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঘটে থাকতে পারার সম্ভাবনা প্রবল। নানারকম সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পাশ্চাত্য গণিতের ঐতিহাসিকরা একে মোটামুটি চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা মনে করেন।
তবে কবে হতে এর প্রচলন তা সম্প্রতি জানা গেছে। সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, শূন্যের বয়স আরও বেড়ে গেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোদলিয়ান লাইব্রেরির গবেষকরা কার্বন ডেটিং পদ্ধতির সাহায্যে জানতে পেরেছেন, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের একটি পা-ুলিপিতে ব্যবহৃত কালো ভরাট বিন্দুই গণিতশাস্ত্রের ব্যবহৃত প্রথম শূন্য। গণিতের হিসাব নিকাশে এই বিন্দুই শূন্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রায় এক হাজার ৮০০ বছর আগে। মূলত এই পাণ্ডুলিপিটি পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরের কাছে বাখশিলা নামে এক গ্রামে পাওয়া গেছে। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে বাখশিলা পাণ্ডুলিপি। ১৮৮১ সালে বাখশিলা গ্রামে মাটির নিচে চাপা পড়া অবস্থায় এটি উদ্ধার করা হয়। ১৯০২ সাল থেকে অক্সফোর্ডের বোদলেয়ান লাইব্রেরিতে এটি সংরক্ষিত আছে।
দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতির উদ্ভাবনের সঙ্গে শূন্যের আবিষ্কার জড়িত বলেই মনে করেন বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকেরা। দশমিক পদ্ধতির কথা প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ, মিসর, ব্যাবিলন ও চীনের মানুষ জানত এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্ভবত স্বাধীনভাবেই এইসব অঞ্চলে এই পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছিল। অনেকের মতে হাতের ও পায়ের দশটি আঙুল দেখে কিংবা এর সাহায্যে গণনা করতে গিয়ে এই দশমিক পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছিল।
প্রাচীন ভারতীয়রা শূন্য সংখ্যা ব্যবহার করে সংখ্যা গণনার যে পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটান, তা পরে আরবদেশীয়রা তাদের গণনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নেন। এটাই তাদের তথাকথিত আরবী চিহ্ন নামে পরিচিত এবং তাদের কাছ থেকে এই সংখ্যা চিহ্নগুলো গ্রহণ করেন অন্যান্য দেশের মানুষ। বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে চীন প্রথম দশমিকের ব্যবহার জানতে পারে। বীজগণিতের ক্ষেত্রে অবশ্য ভারত ও গ্রিসের যৌথ অবদানের কথা স্বীকৃত; কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়ায় গ্রিস থেকে নয়, আরবের থেকে তা প্রসার লাভ করেছিল আর আরবরা পেয়েছিল ভারতের কাছ থেকে। শুধু দশমিক পদ্ধতিতে সংখ্যা লিখনের সুবিধার মধ্যেই ভারতীয়রা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং এর গাণিতিক দিকটির প্রতি দৃষ্টি রেখে একে সংখ্যা হিসেবে গণনা করেছেন।
আর্যভট্ট শূন্যের ব্যবহারিক দিকটি বর্গমূল ও ঘনমূল নির্ণয়-সূত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন; ব্রহ্মগুপ্ত শূন্যের সঙ্গে মৌলিক প্রক্রিয়াগুলো সম্বন্ধের উল্লেখ করেছেন এবং ব্রহ্মগুপ্তের উত্তরসূরিরা মৌলিক প্রক্রিয়াগুলোতে শূন্যের ব্যবহার বিষয়ে আরো সুস্পষ্ট মন্তব্যসহ শূন্যের তাৎপর্য ব্যক্ত করেছেন। এমনকি পাটিগণিত ও বীজগণিতে পৃথক তাৎপর্যের উল্লেখ থেকে মনে হয় তারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন।
এখান থেকেই বোঝা যায় এটা ভারতবর্ষের অর্জন ছিল। তবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির আবিষ্কারটি আরো পোক্ত করল। বর্তমান সভ্যতা দাঁড়িয়েছে কম্পিউটার প্রযুক্তির ওপর। আর এই কম্পিটার প্রযুক্তির বাইনারি কোডের ওপর নির্ভর করে বিকাশ ঘটেছে। যার একটি উপাদান হলো এক আর অপরটি হচ্ছে শূন্য।
লেখক : আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা এবং সম্পাদক-মহাবৃত্ত