কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স (এজিআই) প্রযুক্তি। এজিআই হলো এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা, যা মানুষের চেয়েও উন্নত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এবং মানুষের মতো জটিল কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করতে সক্ষম। তবে এই প্রযুক্তি বাস্তবে কবে নাগাদ আসতে পারে তা নিয়ে চলছে বিশদ গবেষণা ও বিতর্ক।
নতুন এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী এআই সিঙ্গুলারিটির পূর্বাভাসে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এআই সিঙ্গুলারিটি ২০৪০ সালের আগেই ঘটতে পারে, যা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে প্রায় ২০ বছর কম। এআই সিঙ্গুলারিটি বলতে এমন একটি মুহূর্তকে বোঝানো হয় যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে এবং নিজেই নিজেকে উন্নত করার ক্ষমতা অর্জন করবে। এটি এমন এক প্রযুক্তিগত ধাপে পৌঁছানোর ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা মানুষের তুলনায় বহুগুণে বেড়ে যাবে এবং দ্রুতগতিতে নিজেকে উন্নত করতে থাকবে। ফলে প্রযুক্তির অগ্রগতি এতটা দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে যে, মানবসভ্যতার উপর এর প্রভাব অপরিবর্তনীয় হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
সম্প্রতি এআইমাল্টিপল রিসার্চের প্রধান বিশ্লেষক সেম ডিলমেগানি একটি বিশেষ বিশ্লেষণ পরিচালনা করেছেন। এতে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানী, এআই বিশেষজ্ঞ এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের প্রায় আট হাজার ৬০০টি পূর্বাভাস পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল, এজিআই কবে নাগাদ বাস্তবায়িত হতে পারে তা নির্ধারণ করা।
এই বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১০টি জরিপ, যেখানে মোট পাঁচ হাজার ২৮৮ জন এআই গবেষক ও বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০৪০ থেকে ২০৬১ সালের মধ্যে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এআই তৈরির সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ রয়েছে।
সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে এআই সিঙ্গুলারিটি আরো ত্বরান্বিত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালে পরিচালিত এক জরিপে দুই হাজার ৭৭৮ জন বিজ্ঞানী অংশ নেন। তাদের মতে, সর্বোচ্চ ২০৪০ সালের মধ্যে এজিআই বাস্তবায়িত হবে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এটি আরো আগে ঘটতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান
অ্যানথ্রপিকের সিইও ও গবেষক ডারিও আমোডেই ধারণা করছেন, ২০২৬ সালের মধ্যেই এজিআই বাস্তবে রূপ নিতে পারে।
এআই প্রযুক্তির অগ্রগতি
ট্রান্সফরমার-ভিত্তিক লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের (এলএলএম) দ্রুত অগ্রগতির কারণে এজিআই প্রযুক্তির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে। চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি ও ইমেজ জেনারেটর ডাল-ই এই প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলোর অগ্রগতির আগে কিছু বিজ্ঞানী ২০১৯ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এজিআই প্রযুক্তি ২০৬০ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হতে পারে অথবা কখনোই নাও হতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এজিআই বাস্তবায়নের সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি। এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-
কম্পিউটিং সক্ষমতার উন্নতি
মানব বুদ্ধিমত্তার বিপরীতে কম্পিউটিং শক্তি বৃদ্ধির তাত্ত্বিক কোনো সীমা নেই। মুর’স ল অনুযায়ী, প্রতি ১৮ মাসে কম্পিউটিং ক্ষমতা দ্বিগুণ হচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রবণতা কিছুটা মন্থর হয়েছে, তবে সম্ভাবনা এখনো বিদ্যমান।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংকেও এই গবেষণায় বর্তমান প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো একযোগে অনেক গণনা প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে সক্ষম। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের মতো ধারাবাহিক পদ্ধতিতে কাজ করার পরিবর্তে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুসারে দ্রুততর গণনা করতে সক্ষম। এ কারণে ভবিষ্যতের এআই সিস্টেমগুলোকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং আরো শক্তিশালী ও কার্যক্ষম করে তুলতে পারে।
এজিআই নিয়ে ভিন্নমত
সব বিজ্ঞানী অবশ্য এই মতের সঙ্গে একমত নন। ফেসবুকের প্রধান এআই বিজ্ঞানী ইয়ান লেকুন মনে করেন, বর্তমানে ব্যবহৃত ট্রান্সফরমার-ভিত্তিক আর্কিটেকচার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বর্তমান পদ্ধতিগুলো মানব-স্তরের বুদ্ধিমত্তা অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়।
তিনি বিজ্ঞানীদের এজিআইয়ের ধারণা থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি পরামর্শ দেন, এর বহুল ব্যবহৃত সংজ্ঞা ও একজন মানুষ বাস্তবে যা অর্জন করতে পারে, তার মধ্যে একটি বিভ্রান্তি রয়েছে।
উদ্ভাবন ও চ্যালেঞ্জ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত অগ্রগতির ফলে এজিআই প্রযুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হতে পারে। তবে এটি সফল করতে হলে এখনো বহু চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, নিয়ন্ত্রণহীন এজিআই প্রযুক্তি মানবসভ্যতার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এটি যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট বা সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির পাশাপাশি নৈতিকতা ও নিরাপত্তা নীতিমালা তৈরির দিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এজিআইয়ের সম্ভাবনা যেমন উজ্জ্বল, তেমনি এর ঝুঁকিও কম নয়। সূত্র : লাইভ সায়েন্স
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh