Logo
×

Follow Us

ভ্রমণ

ডালহৌসি, এক ভিন্নরকম পাহাড়ি শহরে...

Icon

সজল জাহিদ

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ১৯:২১

ডালহৌসি, এক ভিন্নরকম পাহাড়ি শহরে...

ডালহৌসি। ছবি: লেখক

সিমলা-মানালি পর্ব চুকিয়ে সেবার আমরা বিয়াসের তীরে কয়েকটা দিন কাটাব বলে ঠিক করেছিলাম; কিন্তু হুট করেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আগামী কয়েকদিন টানা বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখে দ্রুতই স্থান পরিবর্তনের কথা ভেবেনিলাম। আর খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী এবং তুলনামূলক কম পরিচিত ডালহৌসিকে খুঁজে পেলাম। সবাই এক প্রস্তাবেই রাজি হয়ে যাওয়াতে ঠিক করে ফেললাম, আমরা এই নতুন শহরে যাচ্ছি, আর সেটা হলো ডালহৌসি। 

চলার পথে বিয়াসের প্রেমে

এটাও একটা প্রেমে পড়ার গল্প! যদিও সবসময় আমি আমার নতুন নতুন প্রেমে পড়ার গল্প বলি সবাইকে; কিন্তু আজকের এই গল্পটা অবশ্য আমার নয়, আমার ছেলেমেয়ের মায়ের প্রেমে পড়ার গল্প! আসলেই তাই, আমরা দুজনেই একই প্রেমে মজেছি! একজন ১০ বছর আগে! আর একজন প্রায় ১০ বছর পরে! আসলেই হয়েছে কি আমি আর তিনি আমরা দুজনেই আগে, পরে এবং এবার আবার একই সঙ্গে বিয়াসের প্রেমে পড়েছি! কেন নয়? 

যে বিয়াসকে দেখেছে, যে বিয়াসের পাশে গেছে, পাশে বসেছে, তাকে ছুঁয়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছে; কিন্তু বিয়াসের প্রেমে পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুর্লভ, খুবই দুর্লভ! যে বা যারা বিয়াসের তীরে গিয়েছে তারা মাত্রই জানেন, যে বিয়াসের কী রোমাঞ্চ! বিয়াসের কি সম্মোহন! বিয়াসের কি অদ্ভুত আকর্ষণ!


আমি প্রথম বিয়াসকে দেখি ২০১৪ সালে, সেবার প্রথম দেখাতেই প্রেমে পরেছিলাম আমি তার! আর সেই প্রেমের আকর্ষণে আবারও ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে ২০১৭ সালে লাদাখ ট্রিপের সময়। আর সেবার পুরো একটা দিন রেখেছিলাম শুধু বিয়াসের জন্যই। বিয়াসের প্রতি আমার এমন সম্মোহন কি শুধুই আমার? নাকি সবারই এমন হয় সেটা নিয়ে আমার নিজের কাছে নিজেরই কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। তাই তো, এবার যখন পরিবার নিয়ে শিমলা আর মানালি যাওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল সেই থেকে মানালি যাওয়ার পথে আর যাওয়ার পরে ছেলেমেয়ের মায়ের বিয়াস দেখে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, সেটা উপলব্ধি করার জন্য ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। 

বিয়াস আর তাকে ঘিরে থাকা অপূর্ব প্রকৃতির প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ছিল বলেই, আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় শুধু বিয়াসের তীরেই তিন-চার দিন কাটাব বলে সেভাবে সবকিছু ভেবে রেখেছিলাম; কিন্তু মানালিতে পৌঁছানোর পরে আবহাওয়া বেঁকে বসলে আমরা পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিলাম। মানালি পৌঁছে দেখা গেল পরের দুই দিন চমৎকার রৌদ্রময় আবহাওয়া হলেও তৃতীয় দিন থেকে নিদারুণ আর অবিরাম ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস! আর ওদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস আমাদের মতো নয়, যা যা বলে, যে সময়ের কথা বলে, ঠিক তাই তাই আর সেই সময়েই তেমন আবহাওয়া পাওয়া যায়! 

যে কারণে মানালিতে তৃতীয় দিন থেকে আমাদের রুট আর প্ল্যান পরিবর্তন করে অন্য লোকেশন বেছে নেই। সেই গল্প পরে হবে। এখন শুধু বিয়াসের প্রেমে পড়ার গল্প হোক। তো, যেহেতু বিয়াসের তীরে থাকার পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে, তাই মানালির তৃতীয় দিন অর্থাৎ যেদিন অন্য লোকেশনে চলে যাব সেদিনের জার্নির প্রায় অর্ধেক দিন বিয়াসের জন্য বরাদ্দ রেখেছিলাম। 

বিয়াসের তীর ধরে যাওয়া, বিয়াসের তীরে বসে সময় কাটানো, বিয়াসের সঙ্গে কথা বলা, বিয়াসের জলের শীতল পরশ নেওয়া। তবে সেটা আমার জন্য দারুণ কাক্সিক্ষত হলেও অন্য সবার জন্য কেমন হবে। আরও বিশেষ করে আমার ছেলেমেয়ের মায়ের কাছে বিয়াস কেমন লাগে, কীভাবে সে তাকে গ্রহণ করে, কতটা উপভোগ করে সেটা দেখার জন্য আমি মুখিয়ে ছিলাম। তবে সেটা একেবারেই নিজের কাছে, নিজের মতো করে, কাউকে কিছু না বলে। 

তো, মানালি থেকে চলতে শুরু করার পর ১০ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি একবার বিয়াসের তীরে থামাল, আমাদের খাবার আর গাড়ির ফুয়েল ভরার জন্য। যেখান থেকে বিয়াস স্পষ্ট দেখা যায়। আমি চুপচাপ তাকিয়ে আছি, আর পুত্র-কন্যার মা তার সঙ্গে সঙ্গীদের বারবার বিয়াসের দিকে দেখার জন্য বলছে! তার মানে সে বিয়াসে কিছুটা হলেও মজেছে বোঝা গেল! 

এরপর গাড়ি ছুটে চলতে শুরু করতেই, সবাই অনুরোধ করতে লাগল, গাড়ি যেন এমন জায়গায় একটু দাঁড়ায়, যেখান থেকে বিয়াসকে একটু ছুঁয়ে দেখা যায়! বিয়াসের পাশে একটু বসা যায়, কয়েকটা ছবি তোলা যায়, কিছু সময় সেখানে কাটানো যায়! তার মানে বিয়াস তাদের আকর্ষিত করেছে! না করে উপায় কি! এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত ছেলেমেয়ের মা। তিনি বিয়াসের তীরে নামার জন্য বারবার তাগাদা দিয়েই যাচ্ছেন। 


অতঃপর, প্রায় আরও ২০ মিনিট গাড়ি চলার পরে। একটা রাফটিং পয়েন্টের কাছাকাছি। একদম পথ আর নদী প্রায় সমতলের কাছাকাছি এমন একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড়াল, অল্প সময়ের জন্য, শুধু কয়েকটা ছবি তোলার জন্য; কিন্তু এরপর বিয়াস তাদের এতটাই আঁকড়ে ধরলও যে বিয়াসের তীরেই কাটিয়ে দিল পুরো দুপুরটা বলতে গেলে। 

কেন নয়? কেনই বা লাগবে না? সবাই বিয়াসকে কাছে পেয়ে এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়ে গিয়েছিল যে কারও আর ওঠার নাম নেই। কেউ ছবি তোলে, কেউ সাজুগুজু করে, কেউ পাথরে পাথরে দৌড়ায়, কেউ পানিতে পা ভেজায়, কেউ অবিরত ক্যামেরায় ক্লিক করে যায়! আমি একদম শেষের জন্য! একটা সময় সবাইকে উঠতেই হলো বিয়াসের তীর ছেড়ে; কিন্তু কেউই তাতে খুব একটা খুশি না সেটা বোঝা গেল! 

কিন্তু উপায় ছিল না। সারা দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। সেখানে টাকাও দেয়া হয়েছে। নইলে হয়তো এই বিয়াসের তীরেই কাটিয়ে দিতাম সেই দিনটা! বিয়াসের ওপারে একটা কটেজ এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল যে সেই কটেজে একবার এসে কয়েকটা দিন কাটাব বলে সেখানেই দুজনে মিলে মনস্থির করে ফেলেছি। আর পুরোটা পথ, অন্য সবার কিছুটা; কিন্তু আমার ছেলেমেয়ের মায়ের কি আক্ষেপ, আফসোস আর মন খারাপ-কেন মানালিতে আরও দুদিন, বিয়াসের তীরে না থেকে চলে যাচ্ছি আমরা! 

সারাটা দিন, গাড়িতে তিনি বিয়াসের জন্য অস্থিরতা প্রকাশ করেছেন অকপটে। আমাকে বার বার দোহাই দিয়েছেন তাকে যেন অবশ্যই একবার কয়েক দিনের জন্য শুধু বিয়াসের তীরে কাটানোর জন্য, থাকার জন্য, শুধু বিয়াসের সঙ্গেই সময় কাটানোর জন্য নিয়ে আসি আমি! যেবার তিনি মানালিতে শুরু বিয়াসের তীরেই কাটিয়ে দিতে চান পুরো ট্রিপের সব দিন! 

হ্যাঁ, বিয়াস এমনই, এতটাই তার আকর্ষণ, তার সম্মোহন, তার মায়ার বন্ধন! তাই তো আমরা ঠিক করেছি, এরপর আমাদের একটা ট্রিপ হবে শুধু মানালি, বিয়াস আর বিয়াসকে ঘিরে থাকা অপূর্ব আকর্ষণীয় প্রকৃতিকে ঘিরে, বিয়াসের তীরে আলসেমিতে কাটাব যে ভ্রমণের সবটুকু সময়। 

যে পথে মুগ্ধতা ছিল প্রতিটি বাঁকে! 

(মানালি থেকে পালামপুর)

পাহাড়ি পথে চলতে আমি চারপাশে আর চলার পথে সব সময়ই চাই নান্দনিক প্রকৃতির এলোমেলো বিচরণ। আলুথালু চারপাশ, অগোছালো বনানী, এলোমেলো পাহাড়ি খাঁজ, ধুলো ওড়া মাটির পথ, এবড়ো-থেবড়ো পাথুরে বাঁক, নিখাঁদ প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপ নিয়েই স্বাগত জানাক আমাকে। যাকে আমার ভালো লাগে তাকে এভাবেই ভালো লাগে, এভাবেই চাই তাকে সবসময়। সাজানো-গোছানো প্রকৃতি আমাকে একদমই টানে না। 


আমার চলার পথটুকুতে থাকুক সবুজের ঘোর লাগা বিস্ময়, মেঘেদের আঁকিবুঁকি, ভয়ানক বাঁক, গভীর গিরিখাদ, নীল জলের টলটলে নদীর আকর্ষণ, মাঝে মাঝে দুই-চারটা ঝরনার শিহরণ, আকাশ ছুঁয়ে ফেলা পাহাড়ের দেয়াল, বুনো অরণ্যের মাঝে নিস্তব্ধ ছুটে চলা, হুটহাট পথের ভাঙা অংশে কষে ব্রেক করে থেমে যাক বুকে কাঁপন ধরানো রোমাঞ্চ! হাড় হিম করা এক একটা বাঁক নিক, নিচের গিরিখাদ দেখে পিলে চমকে যাওয়ার অদ্ভুত শিহরণ তুলে, কখনো কখনো ঘন অরণ্যের মাঝে ছুটে চলুক শুধু শুকনো পাতা ঝরে পুরু হয়ে থাকা পথে আর অজানা পাহাড়ি পাখির কুঞ্জন শুনে! 

কোথাও উঁচু পাহাড়ের সুখ হয়ে ঝরে পরা ঝরনাধারা ছুঁয়ে দিক তার শীতল পরশের আদরে! কোথাও পথের দুপাশের প্রাচীন গাছগুলো হোক এত বড় আর ছায়াময় যেখানে দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে উঠবে কোন আদিমতার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি সেই ভয়ে! কোথাও বুনো পশুর দূর থেকে ভেসে আসা আওয়াজও খাড়া করে দেবে শরীরের রোমগুলোকে! অথবা কোথাও গাড়ি দাঁড়িয়ে যাক, যেখানে পাহাড়ের সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে মেঘেদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে! বা যেখানে আকাশে মাঝে দেয়াল হয়ে দাড়িয়ে আছে নীল রঙে সেজে থাকা কোনো পাহাড় শ্রেণি! 

অদ্ভুত সুখের হয়ে থাকে এমন পথে চলার অনুভূতি, অকারণ সুখে ভরে যায় মনপ্রাণ এই পথে চলতে, অবাক চোখে অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় এক এক সময় এক একদিকে। মনের অজান্তেই পাহাড়ি মেঘের ভেলার সঙ্গে উড়ে যেতে মন চায়, কোনো পাহাড়ের ঢালে অলস বসে থেকে কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় দিনের পর দিন। মনে হয় আহা, গাড়িটা কেন এত জোরে ছুটে চলেছে! আর একটু ধীরে, আর একটু সময় নিয়ে এগোলে কি এমন ক্ষতি হবে! 

আগের দুই বারই শিমলা থেকে মানালি যেতে মাঝে মাঝে এমন পথের দেখা পেয়েছিলাম; কিন্তু এবার শিমলা থেকে মানালি আর মানালি থেকে সোলাং হয়ে অটল টানেল যেতে কোথাও এমন পথ, পাহাড়ি বাঁক, ঘন অরণ্য না পেয়ে সত্যি-ই মন খারাপ লাগছিল, প্রিয় প্রকৃতির এমন হারিয়ে যাওয়া দেখে; কিন্তু ওই যে, প্রকৃতির কাছে আমি চাইব, বিধাতার কাছে প্রার্থনা করব, হতাশ না হয়ে অপেক্ষা করব; কিন্তু এমন কিছু আমি পাব না সে হতেই পারে না! আর তাই তো, ঠিক আমার চাওয়ার মতো করে প্রকৃতির সবকিছুই আমার জন্য উপহার হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন তিনি। মানালি থেকে পালামপুর যাওয়ার এক অবাক, অপূর্ব, মুগ্ধ আর বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাওয়া পথে! 


যদিও মানালি থেকে পালামপুর যাওয়ার কথা ছিল কুল্লু হয়ে মান্ডি গিয়ে, তারপর পালামপুরের সোজা আর সাধারণ পথ ধরে; কিন্তু মান্ডির গরম, পথের সম্ভব্য জ্যাম আর দেরি হতে পারে ভেবে আমাদের শর্মাজি (গাড়ির ড্রাইভার) কুল্লু থেকে ক্যাসল যাওয়ার পথের পার্বতী নদী পার হয়ে একটু এগিয়েই গাড়ি উইটার্ন নিলেন এবং বললেন, মান্ডির জ্যাম আর গরম এড়াতে উনি কিছুটা সরু তুলনামূলক খাড়া আর অরণ্য ঘেরা অচেনা পাহাড়ি পথ ধরে যেতে চান, যদি আমাদের আপত্তি না থাকে! 

আপত্তি থাকার তো কোনো প্রশ্নই নেই। জ্যাম এড়ানো যাবে, গরমে কষ্ট পাব না আর সবচেয়ে বড় পাওনা হবে অচেনা, কোনো যাত্রীবাহী বাহনেই এই পথে চলে না, শুধু স্থানীয় লোকজন ছাড়া এমন পথে চলার মজাই অন্যরকম। একদম নিখাদ পাহাড়ি অরণ্যের মাঝ দিয়ে ছুটবে একদম মান্ডি জেলার শেষ অবধি! আমরা সবাই সায় দিলাম। তবে সমস্যা একটাই ভালো কোনো ধাবা বা খাবার যায়গা পাওয়া যাবে না এই পথে; শুধু স্থানীয় দুই-একটা সাময়িক, গৃহস্থের পারিবারিক ছোট্ট আয়োজন ছাড়া! কোনো সমস্যা নেই আপনি চলুন, শুধু দরকার মতো নিরাপদ জায়গা দেখে বাচ্চাদের খাওয়ানো যাবে এমন কোথাও থামলেই হবে। কারণ বাচ্চাদের খাবার আমাদের সবার সঙ্গেই আছে। এরপর শুরু হলো একদম গাঁয়ের মেঠো পথের মতো, কয়েকটা গৃহস্থবাড়ির প্রায় আঙিনা দিয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটে চলা। ভাঙা, অগোছালো, ধুলো ওড়া পথ-ঠিক যেমনটা মনে মনে চাইছিলাম। 

১৫ থেকে ২০ মিনিট এমন লোকালয় দিয়ে চলার পরেই আমাদের গাড়ি ঘন অরণ্য ঘেরা পাহাড়ি পথে উঠতে শুরু করল! আর সেই সঙ্গে শুরু হলো অদ্ভুত রকম রোমাঞ্চ, শিহরণ আর বাঁকে বাঁকে বিস্ময়! ঠিক, ঠিক যেমনটা বলেছি ওপরের লেখায়! ঠিক তেমনই, নিখাদ পাহাড়ি অরণ্য, পাহাড়ি ধুলো ওড়া মাটির পথ, ভয়ানক এক একটা বাঁক, কখনো ঘন গা ছমছমে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে শুধুমাত্র আমাদের গাড়ির ছুটে চলা! সামনে থেকেও কোনো গাড়ি আসছেন আর পিছন থেকে তো নয়ই! 


কখনো একদম পাহাড়ের খাদ দিয়ে গায়ের রোম খাড়া করে গাড়ির চলে যাওয়া, কখনো পাহাড়ি ঝরনার বিশুদ্ধ জলের জন্য থামা একটু বিশ্রাম নেওয়া, সবার বোতল শীতল জলে ভরে নেওয়া, কখনো পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে নানা রকম ফল ও সবজির জুম ধরে ছুটে চলা। মাঝে মাঝে দুই পাহাড়ের নিচে বিয়াসের ক্ষীণ বয়ে চলা, কোথাও বিয়াসের বুকের ওপর দিয়ে ব্রিজ পার হয়ে অন্য পাহাড়ের পথে এগিয়ে যাওয়া। এক অচেনা পাহাড়ি গাঁয়ের, পাহাড়ের ঝুল বারান্দায় দীর্ঘ বিশ্রামের আগে আমরা পিছনে ফেলে এসেছিলাম অনেক অনেক দিন হৃদয়ের অ্যালবামে সুখস্মৃতি হয়ে যাওয়া একটা অপূর্ব, রোমাঞ্চকর আর প্রাণ জুড়ানো যাত্রা। 

যেখানে একই সঙ্গে ছিল প্রকৃতির সকল কিছুর সাদামাটা, এলোমেলো, আলুথালু, অগোছালো আর সত্যিকারের প্রাণ পাগল করা, অবাক করা আয়োজন। পাহাড়, অরণ্য, মেঘ, গিরিখাদ, পাথুরে নদী, ভয়ানক বাঁক, ঝরনাধারা, পাখির কুঞ্জন, বর্ণিল পাহাড়ি ফুলের সাজ, তুষার মোড়া পাহাড়ের চূড়া আর বিস্ময়ে হা হয়ে চেয়ে থাকা মেঘেদের দল! যা আমাদেরকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছিল বারে বারে, তার আদ্র পরশ দিয়ে! 

বিক্রম বাত্রার পালামপুর

পালামপুর যখন পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও দিনের শেষ আলো আর সন্ধ্যার আঁধারের মাঝেই চোখে পরছিল সমতল পালামপুর শহরের চারদিকই আকাশছোঁয়া পাহাড় দিয়ে ঘেরা! সবচেয়ে বিস্ময় লাগছিল পথ একদম সমতল হলেও দূরের পাহাড় শ্রেণিতে শুভ্রতার বিস্তার! প্রতিটা পাহাড় চূড়াই বরফে মুড়ে আছে! সে এক অদ্ভুত সন্ধ্যা ছিল, দারুণ উপভোগের। কারণ পালামপুর থেকেও যে এমন বরফে মুড়ে থাকা পাহাড়-চূড়া দেখা যাবে সেটা ভাবনাতেই আসেনি। তার ওপর পুরো পালামপুরই একদম সমতল ভূমিই বলা যায়। অন্তত আমাদের চলার পথ পুরোটাই সমতলেই ছিল। 

কিন্তু বরফে মুড়ে থাকা পাহাড়ের চেয়েও বড় বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল পরদিন সকালে। যদিও পালামপুরের শুরুটাই হয়েছিল দারুণ অনুভূতি নিয়ে। কেননা, এত ছোট শহরে এমন আধুনিক আর দারুণ নান্দনিক এবং একই সঙ্গে বাজেটের মধ্যে এত বিলাসী রুম পেয়ে যাব সেটাও ভাবতে পারিনি। প্রথম হোটেল দেখেই আমরা খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর ছোট শহরের অদূরে অল্প উঁচু-নিচু বাজারে গিয়ে চমৎকার খাবার পেয়েছিলাম পরিবারের জন্য। যেটা দিয়েছিল বাড়তি আনন্দ। 

রাতে চমৎকার খাওয়া-দাওয়া, আরামদায়ক রাজকীয় বিছানায় দারুণ ঘুম শেষে সকালের প্রথম সূর্যের আলোয় ছিল আমাদের জন্য আরও বিস্ময়ে ভরা। রুম জোড়া বিশাল কাচের জানালার বাইরের চোখ রাখলেই গাছ আর অন্যান্য ভবনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে উঁকি মারছিল শ্বেতশুভ্র পাহাড়-চূড়া! আর জানালার বেদী এত চওড়া ছিল যে সেখানে উঠে বসে শহর দেখা, বরফ চূড়ায় চোখ রেখেই ঠোঁট রেখেছিলাম ধূমায়িত কফির মগে! সে এক অদ্ভুত সুখের মুহূর্ত। 


কিন্তু পালামপুর তার মূল বিস্ময় তখনো মেলে ধরেনি, কারণ পালামপুর নিয়ে আগে কোনো পড়াশোনা বা জানাশোনার সুযোগ হয়নি। সকালে ফ্রেশ হয়ে যখন বের হলাম ডালহৌসির উদ্দেশে, গাড়ি চলতে শুরু করতেই দুটি রোমাঞ্চকর এবং একই সঙ্গে বিস্মিত হবার মতো ব্যাপার জানতে পারলাম। এই পালামপুর হলো সেই পালামপুর, যে পালামপুরের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তির ওপরে কিছুদিন আগেই তৈরি হওয়া সিনেমা দেখেছি। হ্যাঁ, সিদ্ধার্থ মালহোত্রা আর কিয়ারা আদভানির খুবই জনপ্রিয় সিনেমা ‘শেরশাহ’, যেটা এই পালামপুরেরই বীর যোদ্ধা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অকুতোভয় সদস্য বিক্রম বাত্রার নিজের আবাস্থল। পুরো পালামপুরেই বিক্রম বাত্রার নানারকম স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে সবার ভালোবাসায়। যেটা কিছুদিন আগে তৈরি হওয়া সিনেমার কারণে আরও বেশি করে সমাদৃত এবং সবার কাছে নতুন করে সম্মানিত হয়েছে। 

আর দ্বিতীয় বিস্ময় হলো, পালামপুর কখনো তুষারপাত হয় না; কিন্তু তুষারপাতের সময় পাশের পাহাড়ের দিকে চোখে রাখলেই দূরের বরফমোড়া পাহাড়ে পাহাড়ে তুষারপাতের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। 

ওপরের দুটি নতুন আর দারুণ ঘটনাই আমাদের যারপরনাই আনন্দিত আর বিস্মিত করেছিল এবং একটু হলেও আফসোসে পুড়েছি এই ভেবে যে আগে এসব জানলে নিশ্চিতভাবেই পালামপুরে একদিন থাকার পরিকল্পনা করে রাখতাম। গাড়ি চলতে চলতে ফুয়েল নেওয়ার জন্য একটা পাম্পে থেমে গেল। আরে এটা যে সেই খ্যাতিমান বীর যোদ্ধা, ভীষণ জনপ্রিয় আর সম্মানিত বিক্রম বাত্রারই পাম্প! যেখানে তার নানা সময়ের ছবি আর স্মৃতি সাজিয়ে রাখা হয়েছে দারুণ যত্নে আর ভালোবাসায়। তার বাড়ির উল্টো দিকে বেশ অনেকটা পথ চলে এসেছি বলে আর দেখতে যাওয়া হলো না। তবে আবার যখন ওদিকে যাব সেবার শুধু পালামপুরের জন্যই একটি দিন রেখে দেব ঘুরে ঘুরে দেখতে। 

ছোট্ট পাহাড় ঘেরা সবুজ শহর পালামপুর আর পালামপুরের খ্যাতিমান যোদ্ধা শেরশাহ্-খ্যাত বিক্রম বাত্রার আবাস দেখার জন্য। চমৎকার সবুজে ঘেরা, পথের দুপাশে নানা ফুলে সেজে থাকা, ঢেউ খেলানো পথে আমরা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম পালামপুর থেকে বনেদী, বিলাসী আর প্রাচীন পাহাড়ি শহর ডালহৌসির দিকে। 

দুর্দান্ত ডালহৌসি! 

পুরো ভারতের প্রায় সকল পাহাড়ি অঞ্চলেই যাওয়ার এবং দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বাড়ির কাছের দার্জিলিং, একটু দূরের সিকিম, অন্যপাশের মেঘালয়, দুর্গম নাগাল্যান্ড, দূরের উত্তরাখাণ্ড, অপূর্ব কাশ্মীর, দুর্লভ লাদাখ, দক্ষিণের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, সব সময়ের প্রিয় হিমাচল প্রদেশের শিমলা-মানালি। এত এত জায়গার নানারকম পাহাড়ি অঞ্চল দেখছি এতদিনে; কিন্তু এতটা সবুজ, এতটা অরণ্যে জড়ানো, এতটা প্রকৃতি দিয়ে মুড়ে থাকা এবং পরিচ্ছন্ন, সেইসঙ্গে দারুণ জৌলুসে ভরা পাহাড়ি শহরের দেখা আগে পাইনি। যেটা এবারের ডালহৌসির পাহাড় ঘেরা জনপদে পেয়েছি। 


সত্যি বলতে কি, একই সঙ্গে এতটা ন্যাচারাল, এতটা বুনো অরণ্যে ঘেরা, এত সবুজের মাঝেও যে এত চমৎকার সব আবাসিক হোটেল থাকতে পারে সেটা ভাবনাতেও ছিলনা। দুই-একটা উদাহারন দিলেই সেটা বোঝা যাবে। 

দার্জিলিং-পাহাড়, অরণ্য দুটিই আছে; কিন্তু ওই এত মানুষের ভিড় আর বেশ ঘিঞ্জি হয়ে গেছে আজকাল। 

উত্তরাখণ্ড-সবই আছে কিন্তু খাবার-দাবার নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। 

লাদাখ-প্রকৃতিগত সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সেরা নিঃসন্দেহে; কিন্তু নানা রকম অনিশ্চয়তা আর নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব আছে, তার উপর আবহাওয়াগত অসুবিধা তো আছেই। 

কাশ্মীর-স্বর্গীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে লীলাভূমি; কিন্তু নিরাপত্তা, খরচ আর নানারকম বিধিনিষেধ মনের মতো করে যেখানে-সেখানে যেতে দেয় না। শিমলা-মানালি-সবকিছুই চমৎকার; কিন্তু আজকাল এই দুই হট টুরিস্ট স্পটের খরচ এতটাই বেড়ে গেছে যে আমার মতো মানুষের খরচ কুলিয়ে ওঠা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। 


এমন নানারকম ছোটখাটো অসংগতি সব জায়গাতেই আছে, থাকবে সেটাই স্বাভাবিক; কিন্তু একই সঙ্গে এমন চমৎকার পাহাড়ি শহর, সেই পাহাড়ি শহরের পুরোটাই একদম আদিম অরণ্য দিয়ে ঘেরা, শত বছরের পুরনো পাইন আর ওক গাছের আচ্ছাদনে ঘেরা ঘন জঙ্গলের মাঝে অসাধারণ আর আধুনিক সকল আয়োজনের সব হোটেল, রিসোর্ট; যা বাইরে থেকে দেখলে একদমই বোঝা যায় না, অথচ দামটা একদম সাধ্যের নাগালেই। এতটা পরিছন্ন, ভিড় বা মানুষের কোনোরকম কোলাহল নেই, একই সঙ্গে এবং একই দিনে পাহাড়ের এত এত রূপ অবলোকন করার এমন অভূতপূর্ব জায়গা পেয়ে আমি যারপরনাই পুলকিত! 

এখানে একই দিনে, একই জায়গায় বসে আমি পাহাড়ের চার রকমের রূপের দেখা পেয়েছি। ভোরে বজ্রসহ তুমুল ঝড়বৃষ্টি! বিছানায় আধো ঘুমে থেকে ভাবলাম, যাহ বাবা, আজকের দিনটাই বুঝি মাটি হয়ে গেল! আজ তো আর কোথাও বের হবার কোনো উপায় থাকবে না! এই ভাবনা ভেবে বিছানা ছেড়ে কফি বানিয়ে জানালায় দাঁড়াতেই দেখি মুহূর্তেই বৃষ্টি উধাও! একটু আগেই যে ঝড় হয়েছে তাও বজ্রসহ, সেটা আকাশ বা পাহাড় দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই! 

কারণ জানালার বাইরের পাহাড়ে তখন ঝকঝকে রোদ! দূরের পাহাড়ে ধৌলাধারের বরফ মোড়ানো শুভ্র চূড়ার সারি! আর জানালা খুলে কান পাতলেই পাহাড়ি অরণ্যে হাজার পাখির চিৎকার! বুনো হনুমানের গাছে ডালে ডালে লাফিয়ে বেড়ানোর দৃশ্য! 


সেই একই পাহাড়ের বারান্দায় একটু পরে ফ্রেশ হয়ে এসে আর দাঁড়ানোর উপায় রইল না-টিপটিপ বৃষ্টির জন্য! কিন্তু আবার যখন মনটা খারাপ করে রুমে থাকা ব্রেড আর বাটারের স্বাদ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই বৃষ্টি শেষে একদম ঝলমলে রোদের আনন্দ। দূরের পাহাড়ের মেঘেদের দলের উড়াউড়ির এক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো মুগ্ধতা!

ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম সারা দিনের মতো। সত্যি বলতে কি প্রায় পুরোটা দিন এত এত চমৎকার রৌদ্র ঝলমলে সারা দিন উপভোগ করেছি পাহাড়ের ভ্যালিতে, ঘন পাইনের অরণ্যে, পাহাড়ি ঝরনাধারায় অবগাহন, চমৎকার আর বনেদী সব পাহাড়ি স্থাপনা দর্শন, পাহাড়ের চূড়ায় বরফের শুভ্রতা উপভোগ! মোট কথা, পাহাড়ের কাছ থেকে যা যা সুখস্মৃতি জমিয়ে নেওয়া যায় তার সবকিছুই পাওয়া গেছে, পাওয়া যায়, পাওয়া যাবে শুধু ডালহৌসি থেকেই। বিশেষ আর উপরি পাওনা হিসেবে পাওয়া যাবে সাধ্যের মধ্যেই চমৎকার সব আবাসনের ব্যবস্থা। এমনকি চাইলে সেই আবাসের কাচের জানালায় বা রুমের বারান্দায় অথবা উন্মুক্ত বেলকনিতে দাড়িয়ে বা বসে থেকেই উপভোগ করা যাবে উপরে বর্ণিত সকল পাহাড়ি সুখই! 


তাই তো এই পাহাড়ি শহরের আমি নতুন করে প্রেমে পড়ে গেছি সত্যি! এখন আমি একটু বেশি সময় পেলেই একবার দুই, তিন বা চার দিনের জন্য নয়; একবার যাওয়া-আসা ছাড়াই পুরো একটি সপ্তাহ কাটাতে চাই এই নির্জন, নির্মল, কোলাহলহীন, পরিচ্ছন্ন আর সাধ্যের মধ্যেই সকল পাহাড়ি আনন্দ দিতে পারা এই অপূর্ব, ভিন্ন আর দুর্দান্ত পাহাড়ি শহর ডালহৌসিতে। 

আমার ভীষণ ভালো লেগে যাওয়ার আর একটা নতুন পাহাড়ি গন্তব্য ডালহৌসি। আর যাওয়াটাও খুব কঠিন বা ঝামেলার নয় তেমন। শুধু লম্বা একটা ট্রেন জার্নি শেষে মাত্র ৮৫ কিলোমিটার বাসে বা জিপে করে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে প্রিয় পাহাড়ি শহর ডালহৌসিতে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫