
টেকনাফের একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
টেকনাফ বাংলাদেশের দক্ষিণতম সীমানা। পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর সীমান্ত ঘেরা এক নিঃশব্দ জনপদ। যেখানে সূর্য অস্ত যায় অন্য দেশের ভূমিতে আর বাতাসে মিশে থাকে রাখাইন সংস্কৃতির কোমল ধ্বনি। এই নিভৃত জায়গায়, বহু বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক রহস্যময় কূপ, যার নাম মাথিনের কূপ। এই কূপ শুধু পানি দেয় না, তার প্রতিটি ফোঁটা জলে মিশে আছে এক প্রেমবিদ্ধ হৃদয়ের নিঃশ্বাস, এক নারীর দীর্ঘ অপেক্ষা, আর এক অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প।
ভালোবাসার উন্মেষ
রাখাইনকন্যা মাথিন, গ্রামের প্রতিদিনের নিয়মে কূপে আসতেন পানি তুলতে। নামের মতোই ছিলেন শান্ত, স্নিগ্ধ আর সহজ। সেই কূপপারেই একদিন দেখা হয় ভারত থেকে বদলি হয়ে আসা তরুণ পুলিশ অফিসার বীরেন্দ্রর সঙ্গে। বীরেন্দ্র তখন নিযুক্ত ছিলেন টেকনাফ থানায়। তার চাহনিতে ছিল আত্মবিশ্বাস, মুখে ছিল হালকা এক লাজুক হাসি, আর অন্তরে ছিল সদ্য জাগা আকর্ষণের আলোড়ন।
প্রথম দেখা থেকেই শুরু হয় দুজনার কথোপকথন। রাখাইন ভাষা জানতেন না বীরেন্দ্র, আর মাথিনও বাংলা জানতেন সামান্যই। তবু চোখের ভাষায় গড়ে ওঠে গভীর সেতুবন্ধ। দিনদিন সেই বন্ধন রূপ নেয় নিঃশব্দ এক প্রেমে।
প্রেম যখন সমাজের দেওয়ালে আটকে যায়
প্রেম গড়ে ওঠার পর বীরেন্দ্র নিজের পরিবারে চিঠি লেখেন মাথিনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানাতে। কিন্তু সামাজিক প্রথা, ধর্মীয় বিধিনিষেধ আর পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির দেওয়াল ভেঙে সে প্রেম এগোতে পারেনি। বীরেন্দ্রর পরিবার সাফ জানিয়ে দেয়, এক রাখাইন মেয়েকে হিন্দু পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেওয়া অসম্ভব।
মন খারাপ করে, প্রেম ভেঙে বুকভরা যন্ত্রণায় বীরেন্দ্র ফিরে যান ভারতে। মাথিনের জীবনে রেখে যান অনিশ্চয়তা, অভিমান আর চিরন্তন অপেক্ষা।
মাথিনের প্রতীক্ষা
বীরেন্দ্র চলে যাওয়ার পর মাথিন আর কারো প্রেমে পড়েননি, বিয়েও করেননি। জীবনের বাকিটা সময় কেটেছে সেই কূপের আশপাশে, প্রহর গুণে, একদিন হয়তো সেই প্রিয় পুরুষ ফিরে আসবে এই আশায়। দিন গেছে, মাস গেছে, বছর গেছে, কিন্তু সেই অপেক্ষার ইতি আসেনি।
মাথিনের মৃত্যু হয় নিঃশব্দেই। কিন্তু তার অপেক্ষার গল্প রয়ে গেছে টেকনাফের আকাশ-বাতাসে, কূপের জলে, রাখাইন নারীদের মুখে মুখে।
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
এই কূপ এখন শুধু একটি প্রেমের নিদর্শন নয়, টেকনাফের একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থানও। স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায় ও প্রশাসনের সহায়তায় এখানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। কূপের চারপাশ সাজানো হয়েছে বাঁশ ও কাঠের তৈরি রাখাইন স্থাপত্যশৈলীতে। প্রতি বছর হাজারো পর্যটক আসে মাথিনের কূপ দেখতে, শ্রদ্ধা জানাতে এক অতল প্রেমকে।
‘মাথিনের কূপ’ আজ আর কেবল একটি জলাধার নয়, এটি এখন এক প্রতীকমূলক স্মারক। প্রেমের অঙ্গীকার, ধর্ম ও জাতিভেদে ভালোবাসার ব্যর্থতা, নারীর অসীম ধৈর্য আর চিরন্তন অপেক্ষার প্রতিচ্ছবি এই কূপ। এই কূপ আমাদের শেখায় ভালোবাসা শুধু জয়ের গল্প নয়, হারিয়েও ভালোবাসা অমর হতে পারে। কূপের প্রতিটি জলে বাজে হৃদয়ের নিঃশব্দ আহ্বান।
টেকনাফের কূপটি আজও যেন কথা বলে মাথিনের কণ্ঠে, এক প্রেমিক নারীর আর্তি হয়ে। আমাদের হৃদয়ের কোনো এক কোনায় হয়তো আমরা সবাই একটু মাথিন কিংবা একটু বীরেন্দ্র। এই কূপ সেই চিরন্তন ভালোবাসার নিঃশব্দ সাক্ষী।