
নিঝুম দ্বীপের অপরূপ রূপ। ছবি: সংগৃহীত
যেখানে হাঁটতে গেলে দেখা মিলে হরিণের, চারপাশে রয়েছে সবুজের সমারোহ, রাতের নিস্তব্ধতায় চোখে পড়ে তারাদের হাতছানি, চাঁদের ইশারা সেই দ্বীপটির নাম নিঝুম দ্বীপ। এখানে প্রায় ৪০,০০০ হরিণ রয়েছে বলে হাঁটার পথে দেখা যায় তাদের। তাই এই দ্বীপকে অনেকে হরিণের অভয়ারণ্য বলে।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে নোয়াখালির হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে জেগে উঠেছে ছোট্ট দ্বীপ। নাম নিঝুম দ্বীপ। জানা যায়, স্থানীয় জেলেরা ১৯৫০ সালের দিকে নিঝুম দ্বীপকে আবিষ্কার করে। তবে ১৯৭০ সালের পূর্বে এখানে জনবসতি ছিল না। দ্বীপটির মোট আয়তন ১৪,০৫০ একর। নিঝুম দ্বীপে অনেক চিংড়ি মাছ পাওয়া যায় বলে এই দ্বীপটিকে স্থানীয়রা ইছামতীর দ্বীপ বলেও ডাকে। দ্বীপটিকে কেউ কেউ বাইল্যার চর বলেও ডাকে। কারণ এখানে ছোট ছোট টিলা বা ঢিবির মতো দেখা যায়। বাইল্যার চর বা বালুয়ার চর পরবর্তীতে বল্লার চর হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পায়।
নিঝুম দ্বীপ অনেকগুলো ছোট ও বড় চরের সমন্বয়ে গঠিত। চরগুলো হলো বল্লার চর, কমলার চর, চর ওসমান, চর মুরি ইত্যাদি। দ্বীপটি মূলত নীরব ও নিস্তব্ধ। তাই এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছে নিঝুম দ্বীপ।
আগত দর্শনার্থীরা নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বলে, নিঝুম দ্বীপ থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখতে, সাগরের গর্জন শুনতে সত্যিই চমৎকার লাগে। সমুদ্রের বুকে নৌকা কিংবা ট্রলার নিয়ে ঘুরলে দারুণ উপভোগ করা যায়। সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে চারদিকের অন্ধকার দূর হয়ে যায়। নিঝুম দ্বীপের সূর্যাস্তের দৃশ্য চমৎকার। মন মাতানো সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করা যায় এই দ্বীপ থেকে। এছাড়া বর্ষা ও শীতকালে নিঝুম দ্বীপ অপরুপ সাজে সজ্জিত হয়। নিঝুম দ্বীপে বিভিন্ন প্রকারের গাছপালা দেখা যায়। বেশি দেখা যায় কেওড়া গাছ।
বিদ্যুৎ নেই বলে এখানের রাতের দৃশ্য অসাধারণ। বিশেষ করে পূর্ণিমা রাতের মধুময় চাঁদ দেখা যায় মন ভরে। তাছাড়া রাতের আকাশের হাজারো তারার হাতছানি দেখা যায় এই দ্বীপে। দ্বীপের অভ্যন্তরে চলাফেরার জন্য সাইকেল ও রিকশা ব্যবহার করা হয়। মোটরসাইকেলও চলে দ্বীপের ভেতর। নিঝুম দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য একজন গাইড সাথে রাখা ভালো। গাইড ছাড়া ঘুরলে অনেক কিছু অদেখা থেকে যেতে পারে।
নিঝুম দ্বীপের যে অংশে জনবসতি গড়ে উঠেছে তার নাম হলো নামা বাজার। এই দ্বীপের প্রধান সড়ক একটি হলেও এখানে বাজার আছে তিনটি। নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই যার কারণে রাত হলে পুরো দ্বীপ নিস্তব্ধ থাকে। তবে নামা বাজারে রাত পর্যন্ত জেনারেটর চলে। অন্যান্য স্থানে জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ নেই বলে সন্ধ্যা হলেই মনে হয় মানুষের ঘরে ঘরে রাত নেমে আসে।
নিঝুম দ্বীপে চিত্রা হরিণ দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। হরিণ ছাড়াও নিঝুম দ্বীপে মহিষ, শেয়াল, সাপ, মোরগ, বন মোরগ, বিড়াল, বন বিড়াল, ইঁদুর, বন্য শূকর, বানর ইত্যাদি দেখা যায়। শীতকালে নিঝুম দ্বীপে উত্তরের দেশ থেকে উড়ে আসে নানা প্রজাতির পাখি।
শীতকালে এই দ্বীপে উড়ে আসে গাংচিল, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, সারালি, রাঙ্গামুড়ি, লেঞ্জা, পিয়ং, চখাচখি, কাদাখোঁচা, জিরিয়া, গুলিন্দা, বাটান, সামুদ্রিক ঈগল, শঙ্খচিল, বক সহ আরো অনেক ধরনের পাখি। মোট ৩৫ প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায় শান্ত ও নীরব এই দ্বীপে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে দুইভাবে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়।
সড়ক পথের রুট: ঢাকা-সোনাপুর(নোয়াখালী)-চেয়ারম্যান ঘাট-হাতিয়ার নলচিরা ঘাট(সী-ট্রাক বা ট্রলারে)-হাতিয়ার অপর প্রান্ত জাহাজমারা বাজার-নিঝুম দ্বীপ যাবার ঘাট(খেয়া পারাপার)-নিঝুম দ্বীপ বন্দরটিলা ঘাট-নামার বাজার।
ঢাকার সায়দাবাদ এবং কমলাপুর থেকে প্রতিদিন অসংখ্য বাস নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ৪-৫ ঘণ্টা। ভাড়া বাস ভেদে ৩০০-৩৫০ টাকা। সোনাপুর নেমে আবার বাসে চেয়ারম্যান ঘাট। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা। ভাড়া ৬০-৮০ টাকা। চেয়াম্যান ঘাট থেকে প্রতিদিন দুপুর ২টার দিকে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সি ট্রাক। সেগুলোতে চড়ে চলে যাবেন হাতিয়া। ভাড়া নেবে চেয়ারে ১৫০ টাকা এবং ডেকে ১০০ টাকা। সময় লাগবে ১.৩০ মিনিট। আপনাকে হাতিয়ার যে ঘাটে নামিয়ে দেবে সে ঘাটের নাম ‘নলচিরা ঘাট’। নলচিরা ঘাট থেকে ‘চান্দের গাড়িতে’ যাবেন হাতিয়ার অপর প্রান্ত জাহাজমারা বাজার।
সময় লাগবে ৩ ঘণ্টার মতো। ভাড়া নেবে ৮০-১০০ টাকা। জাহাজমারা বাজারে রাতে থাকবেন। ভাড়া নেবে ১০০-১২০ টাকা জনপ্রতি। সকালে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার জন্য আপনাকে ঘাটে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে মোটরসাইকেল ছাড়া আর কোন যানবাহন নেই। একটি মোটরসাইকেলে তিনজন পর্যন্ত উঠা যায়। ভাড়া জন প্রতি ৬০-৮০ টাকা। আগেই দরদাম করে নেবেন। ঘাটে পৌঁছাতে সময় লাগবে ৩০ মিনিটের মত। ঘাটে দাঁড়ালেই অপর পাশে দেখতে পাবেন স্বপ্নের নিঝুম দ্বিপের বনাঞ্চল।
সকাল ৯ টায় নিঝুম দ্বীপ যাবার নৌকা ছাড়ে। ভাড়া ২০-৩০ টাকা। সময় লাগবে ৩০ মিনিট। নদী পার হওয়ার পথে অসংখ্য পাখি দেখতে পাবেন। নিঝুম দ্বীপে আপনাকে নামিয়ে দেবে যে ঘাটে তার নাম ‘বন্দরটিলা ঘাট’। এখানে নেমে মোটরসাইকেলে সরাসরি চলে যাবেন ‘নামার বাজার’। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। গেলে দলবল নিয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ সদলবলে ঘোরার মজাই আলাদা।
নৌ পথেঃ ঢাকা-তমরুদ্দি(হাতিয়া)-হাতিয়া বন্দরটিলা-নিঝুম দ্বীপ বন্দরটিলা-নামার বাজার। ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সহজ রুট সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে হাতিয়ার তমরুদ্দি। এ পথে এমভি পানামা এবং এমভি টিপু-৫ নামে দুটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে।
ভাড়া ডাবলকেবিন ১২০০ আর সিঙ্গেল ৬৫০ টাকা। ডেকে জনপ্রতি ২০০ টাকা খরচ হবে। ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকেলে আর তমরুদ্দি থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে দুপুর সাড়ে বারোটায়। আর তমরুদ্দি থেকে স্কুটারে বন্দরটিলা ঘাট খরচ হবে ৪৫০-৫৫০ টাকা। স্কুটি ছাড়া বাস এবং রিকসা করেও বন্দরটিলা ঘাটে যাওয়া যায়।
বাস ভাড়া ৩০-৪০ টাকা, রিকসা ভাড়া ৫০-৬০ টাকা। সেখান থেকে ট্রলারে চ্যানেল পার হয়ে নিঝুম দ্বিপের বন্দরটিলা। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে যেতে হবে নামার বাজার।